ঢাকা শহরের কাছাকাছি এলাকায় ১০ মাধ্যমিক স্কুল স্থাপন প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি কিংবা দুর্নীতির চেষ্টা বা অভিপ্রায়ের তথ্য পায়নি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের এই প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তারা। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মামলার বাদির দুর্নীতি ও অনিয়ম সংক্রান্ত সবগুলো অভিযোগই ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়েছে।
এ দিকে এই মামলার বাদি বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত সরকারি কলেজের প্রভাষক ও প্রকল্পটির সাবেক গবেষণা কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে 'আপত্তিকর ও মানহানিকর পোস্ট' দেওয়ার অভিযোগ এনে রাজধানীর থানায় সাধারণ ডায়েরি করে মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের চারজন কর্মকর্তা। মহাপরিচালক দৈনিক আমাদের বার্তাকে তার জিডি করার কথা নিশ্চিত করেছেন।
পিবিআইর তদন্তে বলা হয়েছে, বাদীর অভিযোগ অনুযায়ী তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিটি ঘটনাস্থলে সরেজমিন গেছেন এবং সরকারি প্রকল্প গ্রহণ, প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সংক্রান্ত নথিপত্র যথাযথভাবে যাচাই করেছেন। তদন্ত রিপোর্টে প্রতিটি তথ্যের সমর্থনে যথাযথ প্রমাণও সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, একটি বাংলা দৈনিকে প্রকাশিত একটি রিপোর্টের ভিত্তিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে মাউশি অধিদপ্তরের ১০ স্কুল স্থাপন প্রকল্পে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে তদন্ত হয়।
যে কারণে তদন্ত : আলোচিত ১০ স্কুল স্থাপন প্রকল্পের সাবেক গবেষণা কর্মকর্তা প্রভাষক আব্দুর রাজ্জাক বাদী হয়ে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ডিসেম্বর ঢাকার একটি আদালতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুকসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে একটি সিআর মামলা (৩২৬/২০) করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে মামলায় বাদীর অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেন আদালত। সে অনুযায়ী মামলা তদন্ত করে আদালতে রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে যা আছে : তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মামলায় বাদী অভিযোগ করেছিলেন, মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ অভিযুক্ত পাঁচজন কর্মকর্তা ঢাকার কাছে ১০ স্কুল স্থাপন প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণের প্রায় ৭৪৪ কোটি টাকার মধ্যে ৪৭৮ কোটি টাকা অতিরিক্ত বিল করে এবং প্রকল্পের ব্যয় ৬৭৩ কোটি থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ১২৪ কোটি টাকা দেখিয়ে সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব একনেকে অনুমোদনের চেষ্টা করেছেন। বাদী অভিযোগ করেন, সাবেক প্রকল্প পরিচালক বাদীকে প্রকল্পে দুর্নীতিতে সহায়তা করার প্রস্তাব দিয়ে চাপ প্রয়োগ এবং ঘুষ দেওয়ার চেষ্টাও করেছেন। এই অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাদী যে ৪৭৮ কোটি টাকার অতিরিক্ত বিল তৈরির কথা বলেছেন, তা আসলে বিল নয়, ব্যয়ের প্রাক্কলন। তা ছাড়া রিভাইজড ডেভেলপমেন্ট প্রোজেক্ট প্রোপোজাল (আরডিপিপি) অনুমোদনের ফাইল মামলার বাদী আব্দুর রাজ্জাক নিজেই অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করেন। প্রসঙ্গত, আরডিপিপি প্রস্তুত করে প্রকল্প পরিচালক, পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) এবং মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক স্বাক্ষর করে তা অনুমোদনের জন্য শিক্ষা সচিব বরাবর পাঠান। কিন্তু শিক্ষা সচিব আরডিপিপিতে স্বাক্ষর করেননি। পরবর্তী সময়ে প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটির সভায় আরডিপিপি অনুমোদন প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়। পিবিআইর সার্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর আগেই আরডিপিপি স্থগিত হয়ে যাওয়ায় দুর্নীতি কোনো পর্যায়ে পৌঁছায়নি। এ কারণে কোনো দুর্নীতি হয়নি। মাউশি অধিদপ্তরের চারজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ভূমি অধিগ্রহণ এবং অন্যান্য ব্যয় বাড়ানোর চেষ্টার অভিযোগ বিষয়েও কোনো সত্যতা মেলেনি।
৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে জমির মালিকের সঙ্গে গোপন চুক্তির অভিযোগ সম্পর্কে পিবিআইর তদন্তে বলা হয়, বাদী যে চুক্তির কপি দিয়েছেন, সেটি রেজিস্ট্রিকৃত নয়। ফলে এর আইনি ভিত্তিই নেই। সার্বিক পর্যালোচনায় বলা হয়, বাদী আব্দুর রাজ্জাক পেনাল কোডের ধারায় যে সব অভিযোগ এনেছেন তার কোনোটির পক্ষেই দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
প্রকল্প পরিচালক ড. মো. আমিরুল ইসলাম রাজ্জাককে দুই দফায় ২০ কোটি ও বিশ লাখ টাকা ঘুষ দিতে চেয়েছেন, এই অভিযোগের কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ পায়নি পিবিআই।
পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘গত ৩০ জুন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে উল্লিখিত প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয় নাই বলে বক্তব্য পেশ করেন।’
রাজ্জাকের বিরুদ্ধে জিডি : সিআর মামলার বাদী ও বর্তমানে ঢাকার একটি সরকারি কলেজের প্রভাষক আব্দুর রাজ্জাক গত ২৩ অক্টোবর দুপুর ১২টা ২১ মিনিটে ফেসবুকে ‘বিসিএস এডুকেশন’ গ্রুপে একটি পাবলিক পোস্ট দেন। সেখানে তিনি মন্তব্য করেন, ‘আজ শুনলাম আমাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। আমাকে কোথাও লাঞ্ছিত করা হলে নিম্নের ব্যক্তিবর্গ দায়ী থাকবেন।’
মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক জানান, একজন বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তা অন্য কর্মকর্তাদের নাম উল্লেখ করে এভাবে ফেসবুক পোস্ট দিতে পারেন না। এতে তিনি কর্মকর্তাদের সম্মান ক্ষুণ্ণ করেছেন। এ কারণে তার বিরুদ্ধে তিনি নিজেই জিডি করেছেন।
সরকারি লালমাটিয়া মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. মো. রফিকুল ইসলাম মোহাম্মদপুর থানায় জিডি করেছেন ২৩ অক্টোবর। জিডিতে নিরপেক্ষ তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির দাবি করেছেন শিক্ষা ক্যাডারের সিনিয়র এই কর্মকর্তা।
একই দাবি করে ২৪ অক্টোবর রমনা থানায় জিডি করেছেন প্রকল্পটির সাবেক প্রধান ড. মো. আমিরুল ইসলাম।