২৫ শতাংশ পর্যন্ত শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে - দৈনিকশিক্ষা

২৫ শতাংশ পর্যন্ত শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে

নিজস্ব প্রতিবেদক |

করোনা মহামারীর কারণে প্রায় চৌদ্দ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ অবস্থায় শিক্ষাব্যবস্থা এগিয়ে নিতে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তা তেমন কাজে আসেনি। প্রাথমিক পর্যায়ে ১৯ ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনার বাইরে চলে গেছে বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে মহামারীর চেয়েও সন্তানদের শিক্ষাজীবন নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন অভিভাবকরা। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড গভর্নেন্স (বিআইজিডি) যৌথভাবে গবেষণাটি করেছে। গতকাল সোমবার এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। ব্যাপকভাবে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া ঠেকাতে দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ারও সুপারিশ করা হয়েছে এ গবেষণায়।

করোনায় দেশে দারিদ্র্যের রূপ কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে, তা জানতে দেশজুড়ে তিন ধাপে একটি টেলিফোন জরিপ করে পিপিআরসি ও বিআইজিডি। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত এটি পরিচালিত হয়। গবেষণার তৃতীয় ধাপের দ্বিতীয় অংশ হলো, ‘কভিড ইমপ্যাক্ট অন এডুকেশন লাইফ অব চিলড্রেন’। শহর ও গ্রামের ৬ হাজার ৯৯টি পরিবারের মধ্যে জরিপটি করা হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো স্কুলের ধরন, স্থান ও লিঙ্গ। হতদরিদ্র, মাঝারি দরিদ্র, ঝুঁকিপূর্ণ দরিদ্র এবং দরিদ্র নয় এমন পরিবারগুলোর ওপর এই গবেষণা করা হয়।

পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান ও বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন গবেষণাটির ফল উপস্থাপন করেন। এতে দেখা যায়, যেসব শিশু সমাজের দরিদ্র শ্রেণিভুক্ত, তাদের অবস্থা মহামারীতে সংকটাপন্ন। দীর্ঘদিন ধরে স্কুল বন্ধ থাকার ফলে শিক্ষায় ঘাটতি, শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া, মানসিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাসহ দীর্ঘমেয়াদি নানান ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা মহামারী শুরুর আগে মাধ্যমিক স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের ২১ ও প্রাথমিক স্কুলগামী শিশুদের ১৪ শতাংশ ঝরে যেত। গ্রামের চেয়ে শহরের বস্তিতে থাকা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিশুদের মাঝে ঝরে পড়ার হার বেশি। যারা স্কুলে ভর্তি হয়েছিল, মহামারীতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তাদের সব রুটিন এলোমেলো হয়ে গেছে। যদিও অনেকেই পড়াশোনা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে, তবুও অধিকাংশ শিক্ষার্থী ছয়টি উপায়ে তাদের পড়াশোনা চালিয়েছে। এগুলো হলো তদারকবিহীন নিজস্ব পড়াশোনা, পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় পড়াশোনা, অনলাইনে বা টিভির মাধ্যমে দূরবর্তী শিক্ষণ, কোচিং-প্রাইভেট এবং স্কুল থেকে মাদ্রাসায় ভর্তি। তবে এসব ক্ষেত্রেও অনেক অনিয়ম ছিল।

গবেষণায় শহরের শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষণ ঘাটতির ঝুঁকি বেশি বলে পরিলক্ষিত হয়েছে, মেয়েদের ২৬ ও ছেলে শিক্ষার্থীদের ৩০ শতাংশ এই ঝুঁকিতে রয়েছে। দরিদ্র শ্রেণির মানুষদের মাঝে যারা অতিদরিদ্র, সেসব পরিবারের মাধ্যমিক স্কুলগামী ৩৩ শতাংশ ছেলে শিক্ষার্থীর করোনা সৃষ্ট অর্থনৈতিক ধাক্কায় স্কুল ছেড়ে দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলাফলে আরও দেখা গেছে, দূরবর্তী শিক্ষণের জন্য যেসব সুবিধা থাকা দরকার তা আছে বা ব্যবহার করছে মাত্র ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী। ফলে সরকারি ও বেসরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে লেখাপড়া শেখার হার খুব কম। অবশ্য যারা দরিদ্র নয় এবং শহরের বস্তিতে থাকে মাধ্যমিক পর্যায়ের, সেসব শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে এই হার একটু বেশি। একই সঙ্গে কোচিংয়ে বা প্রাইভেট টিউশনে যাওয়ার প্রবণতা মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মাঝে ৬১ শতাংশ, বিশেষত যারা দরিদ্র নয়, তাদের মাঝে এই হার ৭৪ শতাংশ। আবার শহরের বস্তি এলাকায় খরচ বেশি হওয়ায় কোচিংয়ে যুক্ত হওয়ার হার কম। পড়াশোনায় যুক্ত থাকার আরেকটি পদ্ধতি হলো পিতা-মাতা বা ভাইবোনের সহায়তায় পড়া। যদিও প্রাথমিক পর্যায়ের চেয়ে মাধ্যমিক পর্যায়ে এই সহায়তাপ্রাপ্তির হার কম। মাদ্রাসায় বদলি হওয়ার প্রবণতা বেড়ে আগের চেয়ে চার গুণ হয়েছে এবং মাধ্যমিকের চেয়ে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়ার খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ।

গবেষণায় বলা হয়, যদিও ৯৫ শতাংশ অভিভাবক তাদের সন্তানকে স্কুলে পুনরায় পাঠাতে আগ্রহী; তবুও অর্থনৈতিক অবস্থাটি এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ২০২০ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের মার্চ অবধি শিক্ষা খরচ বেড়েছে ১২ গুণ। ফলে শিক্ষার সুযোগপ্রাপ্তিতে সংকট তৈরি হয়েছে। স্কুলগামী ছেলেশিশুদের ৮ ও মেয়েশিশুদের ৩ শতাংশ কোনো না কোনো উপার্জন প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়েছে। গ্রামীণ অঞ্চলে যেখানে শহরের তুলনায় মানুষের আয় পুনরুদ্ধারের ও কাজের ভালো সুযোগ রয়েছে, সেখানেও এই হার বেশি।

মহামারীতে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যে প্রসঙ্গে গবেষণা বলছে, শহরে বসবাসরত ১০ থেকে ২০ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের ১৫ দশমিক ৭ ও গ্রামের ৮ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী দ্বিগুণ মানসিক চাপে রয়েছে। অভিভাবকদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, এই মানসিক চাপের লক্ষণগুলো হলো অধৈর্য ভাব প্রকাশ, রাগ বা উগ্রভাব এবং বাইরে যেতে ভয় পাওয়া। ঘরের বাইরে যেতে ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা আবার গ্রামের চেয়ে শহরের তরুণদের মাঝে বেশি।

গবেষণায় পিতা-মাতার ব্যবহার ও সম্পৃক্ততাও পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, ৪৮ শতাংশ অভিভাবক শিক্ষার ঘাটতি এবং ৫৯ শতাংশ অভিভাবক শিশুদের পড়াশোনার অনুৎসাহ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। ৪৬ শতাংশ অভিভাবক শিক্ষার ব্যয়ভার নিয়ে শঙ্কিত। এর তুলনায় মাত্র ১৪ শতাংশ অভিভাবক করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে চিন্তিত। যদিও অর্ধেক অভিভাবক বিলম্বিত বা স্নাতক পাস সম্পর্কে উদ্বিগ্ন, প্রায় ৪৪ শতাংশ স্থগিত পরীক্ষা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাস হলে ভবিষ্যতের কর্মসংস্থান সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন ৩১ শতাংশ অভিভাবক।

সমাপনী বক্তব্যে ড. হোসেন জিল্লুর রহমান স্কুল বন্ধের ফলে সৃষ্ট তিনটি প্রধান সংকটের কথা তুলে ধরেন এগুলো হলো শিক্ষণ ঘাটতি, শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি ও বিভিন্ন স্তরের সামাজিক দূরত্ব। তিনি বলেন, ‘আমরা কভিডের কারণে একটি অনিশ্চয়তার মাঝে বাস করছি। করোনার দ্বিতীয় ঢেউকে আমলে নিয়ে পিপিআরসি-বিআইজিডির পরামর্শ হচ্ছে, শিক্ষার ঘাটতি ঠেকাতে, শিক্ষায় অনাগ্রহ কমাতে এবং অভিভাবকদের শিক্ষাসংক্রান্ত আশঙ্কা দূর করতে পুনরায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া দরকার।’

ড. ইমরান মতিন বলেন, ‘স্কুলগামী শিশুদের একটা বড় অংশ শিক্ষণ ঘাটতির ঝুঁকিতে রয়েছে। সুতরাং, শিক্ষার ঘাটতি পূরণে এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে শিশুদের খাপ খাওয়াতে পুনরায়  স্কুল খোলার সময় প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার একটি মিশ্র পদ্ধতি গ্রহণ করা দরকার।’

প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038638114929199