সাতক্ষীরার একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তিন জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের পাতানো বোর্ড বন্ধ করা হয়েছে। সদর উপজেলার খেজুরডাঙা আর কে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এ নিয়োগ পরীক্ষা গতকাল শুক্রবার ছুটির দিনে শহরের দক্ষিণ কাটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গোপনে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাহিদুর রহমানের তদারকিতে পাতানো এ নিয়োগ বোর্ডের খবর পেয়ে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নিয়োগ বোর্ড বাতিল করে দেন। অভিযোগ আছে, এ নিয়োগের জন্য ৪০ লাখ টাকার ঘুষ লেনদেন হয়েছে।
গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে দক্ষিণ কাটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বেশ কিছু অচেনা লোকের আনাগোনা দেখে স্থানীয়রা বিষয়টি সাংবাদিকদের জানান। খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে ওই বিদ্যালয়ের একটি শ্রেণিকক্ষে দু’নারীসহ ১১ জনকে বসে থাকতে দেখা যায়। তাদের কাছে পরীক্ষা সংক্রান্ত প্রবেশপত্র ছিল। তবে তারা কোন বিষয়ে পরীক্ষা দিবেন তা তাৎক্ষণিক কেউ মুখ খোলেননি।
সেখানে তদারকির দায়িত্বে থাকা হাবিবুর রহমান নিজেকে খেজুরডাঙা আর কে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক উল্লেখ করে দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, এখানে একটা মিটিং হচ্ছে। কিসের মিটিং হচ্ছে জানতে চাইলে ওই বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাহিদুর রহমানের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। একপর্যায়ে প্রধান শিক্ষক হাবিবুর রহমান তার বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ঈদুজ্জামান ইদ্রিসের কাছে ফোন ধরিয়ে দিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে বলেন। ঈদুজ্জামান ইদ্রিস বলেন, সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে একজনের স্থায়ীকরণ, একজন প্রহরী ও একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মীর নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
বিষয়টি প্রকাশ হলে একপর্যায়ে ক্ষেপে গিয়ে প্রধান শিক্ষক দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, তিনি আশাশুনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ বি এম মোস্তাকিমের চাচাত ভাই। তার বোন ফারজানা আক্তার কারিমা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাই সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাহিদুর রহমান নিয়োগ বোর্ডের সবাইকে ম্যানেজ করেই আগে থেকে প্রহরী পদে ও পরিচ্ছন্নতা কর্মী পদে তাহমিদ ও জাহিদকে নিশ্চয়তা দিয়েই বিশেষ প্রক্রিয়ায় কোরাম পূর্ণ করে এ নিয়োগ পরীক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। নিয়োগের ব্যাপারে স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয় বলে জানান তিনি। দক্ষিণ কাটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে তিনি এ সেখানে পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। বিষয়টি কোন পত্রিকায় সংবাদ পরিবেশন না করার জন্য তিনি অনুরোধ করেন।
আগে থেকে ঠিক করে রাখা সহকারী প্রধান শিক্ষক গোপীনাথপুরের দেবেন গাইন দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, তিনি ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি থেকে ওই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে এমপিওভুক্ত। তার বেসিক বেতন ২২ হাজার টাকা। বর্তমানে তিনি সহকারী প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করলেও অনুমোদিত না হওয়ায় সহকারী প্রধান শিক্ষকের বেতন অনুযায়ী ২৩ হাজার টাকা বেসিকে বেতন পাচ্ছেন না। তাই সকলের সহযোগিতায় তিনি ওই পদে নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অনুমোদন পাওয়ার জন্য এ নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন। তবে কোরাম পুরণের জন্য প্রধান শিক্ষকের বোন কারিমা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারজানা আক্তার ও বাঁশদহা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তৃপ্তি রানীকে আনা হয়েছে।
খেজুরডাঙা গ্রামের কণ্ঠরাম সরকারের ছেলে প্রবেশ সরকার দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, তাকে প্রহরী পদে নিয়োগ দেয়ার জন্য দাবি করা আট লাখ টাকার পরিবর্তে ছয় লাখ টাকা নেয়া হলেও চাকরির বয়স নেই দেখিয়ে তাকে নিয়োগ পরীক্ষার কার্ড দেয়া হয়নি।
খেজুরডাঙা গ্রামের আবদুর রহমানের ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান সাজু বলেন, পাঁচ মাস আগে পাতানো নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে একজন প্রহরী নেয়ার চেষ্টা করলে তিনি আদালতের দারস্ত হন। মামলার কারণে ওই সময় পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। এখনো প্রধান শিক্ষক শিক্ষা কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমঝোতা করে তিনজনের কাছ থেকে কমপক্ষে ৪০ লাখ টাকা নিয়ে ওই পাতানো নিয়োগ বোর্ডের মাধ্যমে নিয়োগ দেয়ার চেষ্টা করছেন বলে তিনি জেনেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক বলেন, এ ধরণের পাতানো নিয়োগ বোর্ডের আয়োজনে বেশ দক্ষ সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাহিদুর রহমান। শুক্রবারের এ নিয়োগ বোর্ড আয়োজন করার জন্য তিনি ৫ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন।
সাতক্ষীরা সদরের খেজুরডাঙা আর কে মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি লাবসা ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল আলীম দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান, পরীক্ষা হওয়ার কথা তিনি জানেন। তবে কোথায় হচ্ছে-এটা তাকে জানানো হয়নি। তবে এতে কোন অর্থনৈতিক লেনদেনের অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
দক্ষিণ কাটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির নবনির্বাচিত সভাপতি জুনায়েত হোসেন বায়রন বলেন, তাদের বিদ্যালয়ে নিয়োগ পরীক্ষা হচ্ছে-এমনটি তাকে কেউ জানায়নি।
নৈশপ্রহরী আল আমিন বলেন, শুক্রবার সকাল ৯টায় কাটিয়া সরকারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পিয়ন মিলন তাকে তাদের বিদ্যালয়ের একটি নির্ধারিত মিটিং দক্ষিণ কাটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে করানোর জন্য তার কাছে সহযোগিাত চান। বিষয়টি প্রদান শিক্ষক জানেন না। তবে দু’টি ঘর খোলা এবং সেখানে লোকজন রয়েছে এমন কথা বলার পর তিনি বলেন, এখনই তিনি সাধারণ ডায়েরি করবেন।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষাক কর্মকর্তা জাহিদুর রহমান দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, নিয়ম মেনেই নিয়োগ বোর্ড পরিচালনা করা হচ্ছে। কেন গোপনে বোর্ড বসানো হয়েছে-এমন প্রশ্নের জবাবে প্রথমে তিনি বলেন, স্কুলের সভাপতি আসতে দেরি করার কারণে বোর্ড বাতিল হয়েছে। সভাপতি বোর্ড বসানোর স্থান সম্পর্কে জানেন না, এমন কথা জানানো হলে তিনি বিষয়টি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সাথে কথা বলতে বলেন। আর ৫ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।
সাতক্ষীরা জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, নিয়োগের বিষয়টি তাকে জানানো হয়নি। তবে খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক ওই পাতানো নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল করে দেয়া হয়েছে।