৪১তম বিসিএসের ১৫ হাজার চাকরিপ্রার্থীর লিখিত পরীক্ষার খাতায় প্রথম ও দ্বিতীয় পরীক্ষকের নম্বরের পার্থক্য গড়ে ২০ করে। এসব খাতা মূল্যায়নের জন্য তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে পাঠানো হয়েছে। এ কারণেই এ বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতে দেরি হচ্ছে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) ক্যাডার সার্ভিসের পরীক্ষা প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। শুক্রবার (২১ অক্টোবর) দেশ রুপান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন আশরাফুল হক।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, কমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, ‘কিছু জটিলতা হওয়ায় ৪১তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশে কিছুটা সময় লাগছে। আশা করি শিগগিরই ফল প্রকাশ করতে পারব।’
প্রথম পরীক্ষকের বাধা পেরিয়ে এবার তৃতীয় পরীক্ষকের ফেরে পড়েছে ৪১তম বিসিএস। এর আগে লিখিত পরীক্ষার খাতা আটকে ছিল ৩১৮ পরীক্ষকের কাছে। তারা খাতা মূল্যায়ন করে সময়মতো জমা না দেওয়ায় জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিল। পরীক্ষকদের ডেকে পিএসসিতে এনে সেই সমস্যার সমাধান করার পর দেখা দেয় নতুন বিপত্তি। দুই পরীক্ষকের দেওয়া নম্বরের পার্থক্য গড়ে ২০ করে। তাতেও সমস্যা হতো না। কিন্তু যখন দেখা গেল খাতার সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার তখন তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। গত মঙ্গলবার তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে খাতা পাঠানোর কাজ শেষ হয়। এবার তাদের কাছ থেকে খাতা ফেরত আনার পালা।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আশা করছেন, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে খাতা মূল্যায়ন শেষ হবে। ফলাফল হতে পারে তার পরের সপ্তাহে। ৪১তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন ২১ হাজার ৫৬ জন। আবশ্যিক বিষয়ে তাদের খাতার সংখ্যা ১ লাখ ২৬ হাজার ৩৩৬টি। ঐচ্ছিক বিষয়েরও খাতা রয়েছে। মোট খাতার সংখ্যা কত তা পিএসসি প্রকাশ করে না। এ অবস্থায় শুধু আবশ্যিক আমলে নিয়ে হিসাব করলে প্রতি আটটি খাতায় একটি খাতা অবমূল্যায়িত হয়েছে।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘১৫ হাজার খাতা সংখ্যায় অনেক বেশি। চাকরিপ্রার্থীদের এ অবস্থা থেকে মুক্তি দেওয়া উচিত। তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে খাতা পাঠানোর কোনো দরকার নেই। তৃতীয় পরীক্ষক থাকতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে অনেক কম শিক্ষার্থী থাকে। হাজার হাজার পরীক্ষার্থীর মধ্যে তৃতীয় পরীক্ষক প্রচলন করলে অনেক সময় লাগবে। আমাদের এত সময় কোথায়? বেকারত্বের অবসান হওয়া দরকার, পাশাপাশি সরকারেরও লোক দরকার।’
সাবেক এ সচিব আরও বলেন, ‘আগে একজন পরীক্ষকই খাতা দেখতেন। তার দেওয়া নম্বরই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হতো। সব পরীক্ষক একরকম মনোযোগ দিয়ে খাতা দেখেন না। তাদের বিবেচনার মানদ-ও সমান হওয়ার কথা নয়। তাই পিএসসি হয়তোবা লিখিত পরীক্ষায় আরও স্বচ্ছতার জন্য তৃতীয় পরীক্ষক ব্যবস্থা চালু করেছে। কিন্তু পিএসসির বিবেচনাবোধ নজিরবিহীন এবং বিলম্বিত বিসিএস পরীক্ষাকে আরও বিলম্বিত করছে। এমনিতেই এখানে স্বাধীনতার কিছুদিন পর থেকেই জট লেগেছিল। ক্ষেত্রবিশেষে বিসিএস শেষ করতে চার বছরও লেগেছে। তবে দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় সেটা প্রায় সোয়া দুই বছরে নেমে এসেছিল। সিভিল সার্ভিসের বাছাই শেষ হয় এক বছরের মধ্যেই। উপমহাদেশের এই ঐতিহ্য বাংলাদেশে ধরে রাখা যায়নি। কিছুটা কাছাকাছি হতে গিয়েও আবার বিপরীতমুখী হয়ে পড়েছে।’
পিএসসির একজন পরীক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সিভিল সার্ভিসে নিয়োগের জন্য একজন পরীক্ষকের তত্ত্বাবধানে খাতা মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু হয় ব্রিটিশ শাসনামলে। তখনো খাতা দেখতেন একজন পরীক্ষক। ভারত ও পাকিস্তানে এখনো এ ব্যবস্থাই চালু রয়েছে। বাংলাদেশেও ছিল। কিন্তু ৩৮তম বিসিএস থেকে বদলে যায় নিয়ম। ফলে অতিরিক্ত সময় লাগছে। দ্বিতীয় পরীক্ষকের ব্যবস্থা আছে কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষায়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত অনেক কলেজেও স্নাতক ও স্নাতকোত্তর চালু রয়েছে। এসব পরীক্ষায় পরীক্ষক থাকেন একজনই। এখানে দ্বিতীয় পরীক্ষকের ধারণাই চালু করা হয়নি। দ্বিতীয় পরীক্ষক না হলে সব ভুল হয়ে যায়, এমনটা তো নয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যত ছাত্রছাত্রী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান, তার চেয়ে বেশি ডিগ্রি পান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষকদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সীমিত। এখানে পরীক্ষকের জবাবদিহি থাকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে। সময়মতো খাতা না দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় পরীক্ষক হন সাধারণত অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের কোনো শিক্ষক। তারা পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে অল্প সময়ে ফল প্রকাশের বিষয়টি দুরূহ হয়ে ওঠে না। এ ক্ষেত্রে পিএসসির নিজস্ব কোনো পরীক্ষক নেই। তারা ধার করা পরীক্ষক দিয়ে খাতা দেখান। মূলত বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই তাদের পরীক্ষক বা ভরসা। পদ্ধতিগত কারণেই তাদের সংখ্যা সীমিত। ধার করা পরীক্ষক দিয়ে খাতা দেখালে এ ধরনের বিলম্ব হওয়াই স্বাভাবিক। দ্বিতীয় বা তৃতীয় পরীক্ষকের কারণে এখন প্রয়োজন পড়েছে তিন গুণ পরীক্ষকের।
২০১৯ সালের ৯ মে পিএসসির কাছে চাহিদাপত্র পাঠায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। একই বছরের ২৭ নভেম্বর ৪১তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পিএসসি। এতে বিভিন্ন পদে ২ হাজার ১৩৫ জন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হবে। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি নেওয়া হবে শিক্ষা ক্যাডারে। এ ক্যাডারে ৯১৫ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। এর মধ্যে বিসিএস শিক্ষায় ৯০৫ এবং কারিগরি শিক্ষা বিভাগে ১০ জন প্রভাষক নেওয়া হবে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩২৩ জনকে প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ দেওয়া হবে।
সাড়ে ছয় মাস আগে প্রকাশ করা হয়েছে ৪০তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল। এখন প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার পালা। কিন্তু ক্যাডার নিয়ন্ত্রণকারী জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এখনো তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শেষ করতে পারেনি। এ কাজে আরও কয়েক মাস সময় প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
১৪ মাসে নিয়োগ শেষ হয়েছে ৪২তম বিশেষ বিসিএসের। ৪৩তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ১ বছর ১০ মাস আগে এ বিসিএসের যাত্রা শুরু হয়। সাধারণত দুই বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার খাতা একসঙ্গে পিএসসিতে জমা থাকে না। কিন্তু ৪১তম বিসিএসের ফল প্রকাশে বিলম্ব হওয়ায় এবার তাই ঘটেছে।
৪৪তম বিসিএস শুরু হয়েছে ২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর। এই বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয় গত ২২ জুন। প্রিলিমিনারির ফলাফল প্রকাশের বিবৃতিতে লিখিত পরীক্ষা নিয়ে বলা হয়েছিল, ৪৪তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা চলতি বছরের অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তারিখ ও সময়সূচি কমিশনের ওয়েবসাইটে ও বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু পিএসসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দুই লিখিত পরীক্ষার খাতা পিএসসির হাতে। এ অবস্থায় তৃতীয় কোনো কোনো লিখিত পরীক্ষা এখনই শুরু করতে চান না তারা। তবে এই বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।
পিএসসি প্রতি বছর একটি বিসিএস নেওয়ার ক্যালেন্ডার করেছে। চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন দায়িত্ব নিয়ে জাতিকে এ প্রতিশ্রুতি দেন। সেই প্রতিশ্রুতি অনুসারে আগামী ৩০ নভেম্বর প্রকাশ করা হবে ৪৫তম সাধারণ বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিভিন্ন ক্যাডার নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয় থেকে তাদের শূন্য পদের সংখ্যা সংগ্রহের কাজ শেষ করে এনেছে। এই বিসিএস থেকেই ক্যাডারের পাশাপাশি নন-ক্যাডারের শূন্য পদের সংখ্যা উল্লেখ করা হবে। প্রার্থীদের ক্যাডারের মতো নন-ক্যাডারেও তাদের পছন্দক্রম ফরম পূরণের সময় জানাতে হবে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, পিএসসি সাধারণত কয়েক লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্য থেকে প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে বাছাই করে এক থেকে দুই হাজার প্রার্থীকে চাকরিতে নিয়োগের সুপারিশ করে। তাদের মেধা যাচাই প্রক্রিয়াগত কারণেই হয়ে যায়। বিসিএসে প্রার্থীর সংখ্যা থাকে অনেক। প্রিলিমিনারি বাছাই পর্বটি অনেকটাই কঠোর। দিনরাত দীর্ঘদিন পরিশ্রম করে অনেকে প্রিলিমিনারিতেই বাদ পড়ে যান। আর লিখিত ও মৌখিকে তো পড়েনই। কাজেই এসব ডিঙিয়ে যারা চাকরি পান তাদের আলাদাভাবে দেখতেই হবে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু মেধাবী তরুণ থাকেন তারা বিসিএসে আসতে চান না। সেটা বাদ দিলে বিসিএসে মেধাবীরাই আসেন। এখন সময় এসেছে মেধাবী তরুণদের সময় বাঁচানোর। তাদের সময়কে কাজে লাগাতে হবে।