জেনারেল খালেদ মোশাররফ ছিলেন অসম সাহসী যোদ্ধা ও রণকৌশলবিদ। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধে তার বীরত্ব সর্বজনবিদিত। তিনি বাংলাদেশ বাহিনীর সেক্টর ২ এর কমান্ডার ও কে ফোর্স ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন। তিনি আরও ছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের নেতা। যে প্লাটুন ঢাকা শহরে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে পাকিস্তান বাহিনীতে ভীতির সঞ্চার করেছিলো।
এসব অভিযানের কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বুঝতে পেরেছিল, মুক্তিযোদ্ধারা খুবই সক্রিয়, অত্যন্ত কার্যকর ও শক্তিশালী হয়ে উঠছে। মুক্তিযোদ্ধাদের একের পর এক সফল অভিযানে শেষ পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্ব পরিস্থিতি অনুধাবন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।
বস্তুত, খালেদ মোশাররফ ভালোভাবেই জানতেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী অত্যন্ত শক্তিশালী ও সুসংহত বাহিনী। পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) বিরুদ্ধে তারা সমস্ত শক্তি ব্যবহার করবে। তাই তিনি তরুণদের গেরিলা যুদ্ধে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। তিনি ভিয়েতনাম ও ল্যাটিন আমেরিকার প্যাটার্ন অনুসরণ করেছিলেন, যেখানে সাধারণ যুদ্ধে তারা এই কৌশল অবলম্বন করেছিল। কঠিন যুদ্ধজয়ের জন্য সেটিকে অন্যতম কৌশল হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন খালেদ মোশাররফ। তাই তিনি ঢাকা শহরের তরুণদের নিয়ে ক্র্যাক প্লাটুন তৈরি করেছিলেন এবং অত্যন্ত সফল হয়েছিলেন।
যুদ্ধের সময় জেনারেল খালেদ ও ক্র্যাক প্লাটুনের যোদ্ধাদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে কথোপকথন হয়। একবার শাহাদাত চৌধুরী (বিচিত্রা পত্রিকার সম্পাদক) ২ নম্বর সেক্টরের তরুণ ও সুদর্শন সেক্টর কমান্ডারকে প্রশ্ন করেন, ‘বাংলাদেশি সেনাবাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধারা কীভাবে ঢাকাকে কবরস্থানে পরিণত করবে, যখন ঢাকায়, এই সেক্টরে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের পিতামাতা ও আত্মীয়স্বজনরা থাকে। সেক্টর কমান্ডার হয়েও ঢাকায় আপনার নিজস্ব সম্পর্ক আছে। আপনি কি আপনার নিজের লোকদের মারা যেতে দেবেন?’
জবাবে খালেদ মোশাররফ বলেন, ‘শাহাদাত, আপনি শুধু শিল্পী নন, সাংবাদিকও। আপনি একটি জিনিস খুব স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছেন - এটি একটি যুদ্ধ এবং একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, আমাদের একটি প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে এবং এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে যাবেন না যে, আমাদের এই যুদ্ধে জয়ী হতে হবে।’
এই কথোপকথন থেকে এটা স্পষ্ট, খালেদ মোশাররফ এই দীর্ঘ যুদ্ধের জন্য তার বাহিনীকে প্রস্তুত করছিলেন। তিনি ছিলেন তার বাহিনী, পরিবার, আত্মীয়-স্বজনদের অনুপ্রেরণা - যুদ্ধের তুলনায় সবকিছুই তার কাছে গৌণ ছিল।
আখাউড়া ও কসবার যুদ্ধে খালেদ মোশাররফ অসাধারণ বীরত্ব ও সাহসিকতার পরিচয় দেন। এই দুটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কঠিন এবং দীর্ঘ লড়াই। গ্রেনাডা টিভি ইউকে প্রযোজিত ‘খালেদের যুদ্ধ’ নামের একটি ডকুমেন্টারিতে সেগুলো প্রচার করা হয়। এই তথ্যচিত্রটি সারা বিশ্বে বহুবার দেখানো হয়েছে। এই তথ্যচিত্রে খালেদকে সাক্ষাৎকার দিতে দেখা যায়।
তিনি বলেন, ‘আমরা একটি ক্ষয়ক্ষতির যুদ্ধ করছি, সেক্ষেত্রে আমরা আত্মরক্ষায় হত্যা করি, হত্যা করি, হত্যা করি।’
তিনি এই দীর্ঘ যুদ্ধ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন, কারণ তিনি জানতেন, পাকিস্তানি বাহিনী আরও নিরীহ বেসামরিক মানুষকে হত্যা করবে এবং এতে জনগণের জন্য দুর্ভোগ সৃষ্টি হবে।
এই সাহসী অফিসার বলেছিলেন, ‘তারা বাংলাদেশকে এর জনগণের কাছ থেকে খালি করুক, কিন্তু তারা কখনই আমাদের মাটি নিতে পারবে না।’
এভাবে বহু ঘটনায় দেশের প্রতি তার ভালোবাসা মূর্ত। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন তিনি। এটা ছিল দেশের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি।
অক্টোবরের শেষের দিকে, খালেদ মোশাররফ সম্মুখ যুদ্ধে গুরুতর আহত হন। তার কপালে একটি স্প্লিন্টার আঘাত করে। মুক্তিযোদ্ধারা খবর জানতে পেরে গভীর শোকে পড়ে যান। খালেদ ছিলেন তাদের প্রিয় নেতা, তিনি ছিলেন তাদের অভিভাবক ও রক্ষক। তিনি ছাড়া তাদের কে দেখবে? সৌভাগ্যবশত, সেকেন্ড-ইন-কমান্ড লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ. টি. হায়দার তাদের উদ্ধারে এগিয়ে আসেন এবং তার কমান্ডারের কাছ থেকে দায়িত্ব নেন।
খালেদকে তাৎক্ষণিকভাবে ভারতের লখনৌতে নিয়ে যাওয়া হয়। ভারতের চিকিৎসকরা তার অস্ত্রোপচার করেন। তাদের প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় খালেদ মোশাররফ সুস্থ হয়ে ওঠেন।
তারপর খালেদ মোশাররফ বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে ফিরে আসেন। নতুন বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীতে যোগ দেন। যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্বের জন্য তিনি বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত হন।
কিন্তু স্বাধীনতার চার বছর পর ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে, খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম, কর্নেল খন্দকার হুদা বীর প্রতীক ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল এটিএম হায়দার বীর উত্তমকে বাংলাদেশের বিপথগামী কিছু সেনা কর্মকর্তা হত্যা করে।
১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হলে গোটা দেশ শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে।. খন্দকার মোশতাক বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুক, রশিদ, ডালিমরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। তারা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের শাসন করতে শুরু করেন। তাতে দেশ বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়ে।
সে সময় কর্নেল শাফায়েত জামিল সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে ও হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু, জিয়া এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অসহযোগিতা করেন। আমরা বুঝতে পারি, জিয়া সবসময় মোশতাক গ্রুপের অংশ ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে হত্যার আগে ফারুক-রশিদ গ্রুপ জিয়ার সঙ্গে পরামর্শ করে। হত্যাকাণ্ডের ফলে তিনি সবচেয়ে বেশি লাভবান হন।
খালেদ মোশাররফ ২ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সমূলে উৎপাটনে প্রথম পদক্ষেপ নেন। প্রথমে তিনি জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করেন।
জিয়া তখন বামপন্থি জেএসডি নেতা লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহেরকে (অব.) ফোন করে তাকে রক্ষার অনুরোধ করেন।
মোশতাক গোপনে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানকে হত্যার নির্দেশ দেন।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার পরিকল্পনাকারী খালেদ মোশাররফের জন্য এটা ছিল বড় ধাক্কা। ৪ নভেম্বর এক আদেশের মাধ্যমে খালেদকে মেজর জেনারেল ও চিফ অব আর্মি স্টাফ হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এরপর তিনি অবিলম্বে চার ত্যাগী নেতার জেল হত্যার বিষয়ে কমিশন গঠনের নির্দেশ দেন।
৫ নভেম্বর খালেদের সহকর্মীরা তাকে রেডিও ও টিভিতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলে তিনি পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেন। তার মতে, নতুন রাষ্ট্রপতির শুধু ভাষণ দেওয়ার অধিকার ছিল।
সেদিনই জাসদ তাদের গণবাহিনী ও সৈনিক সংস্থার সাথে নিজেদের ষড়যন্ত্র করছিল। কর্নেল তাহের একটি তথাকথিত বিপ্লব শুরু করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এই তথাকথিত বিপ্লব ছিল খুবই অযৌক্তিক। যার শুরু হয়েছিল রক্তপাতে। শ্রেণিহীন সমাজতান্ত্রিক দেশের আকাঙ্ক্ষায় ৬ নভেম্বর থেকে তারা খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে সেনানিবাসে উস্কানি দেয়। তারা পরিকল্পনা করে সৈন্যদের মাঝে লিফলেট বিতরণ করেছিলো। লিফলেটে বলা ছিলো, খালেদ মোশাররফ ভারতের গুপ্তচর। তিনি দেশটিকে ভারতের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। এর প্রভাব সৈন্যদের ওপর পড়ে। তারা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তারা স্লোগান দিতে থাকে, ‘সৈনিক-সৈনিক ভাই-ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই’।
এই ষড়যন্ত্র জাসদের নেতাকে সহায়তা করে। তিনি সৈনিক সংস্থার সহায়তায় জেনারেল খালেদ মোশাররফের কাছ থেকে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেন। ১৫ আগস্টের বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ট্যাংকগুলো সেনানিবাসে ফেরত যাওয়ার কথা থাকলেও ঢাকা শহরে সেনাবাহিনীর দুটি ইউনিট দেখা যায়। জিয়া গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি পান। জাসদের সাথে মোশতাক, ফারুক ও রশিদ, কিছু সৈনিক ও অফিসার জেনারেল খালেদ মোশাররফের প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে।
খালেদ মোশাররফের কাছে উচ্ছৃঙ্খল সৈনিক ও জাসদের চক্রান্তের খবর জানাজানি হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেরি হয়ে যায়। পরিস্থিতির অবনতি হলে খালেদ মোশাররফ ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
জেনারেল খালেদ মোশাররফ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এটিএম হায়দার ও কর্নেল হুদা রেজিমেন্টে আশ্রয় নেন, যেটি অস্থায়ীভাবে বাংলাদেশ সংসদ ভবনের কাছে ছিল। কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল ও বিপজ্জনক সৈন্যরা মেজর জলিল ও মেজর আসাদের নেতৃত্বে ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টে উপস্থিত হয়। মেজর জলিল ও মেজর আসাদ পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্কে তিন সাহসী অফিসারকে গুলি করে। বাংলাদেশের সাহসী বীররা বাংলাদেশের মাটিতে, বাংলাদেশি সেনাদের হাতে নিহত হন।
খালেদ মোশাররফ অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন। যারা স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছিল এবং বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছিলো তাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। তাই ৭ নভেম্বর ছিলো বিপথগামীদের অভ্যুত্থান, কোনো বিপ্লব ছিল না।
যদিও বিএনপি ৭ নভেম্বরকে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস বলে। তারা বলতে চেষ্টা করে, সেদিন সাধারণ সেনারা জিয়াকে মুক্ত করেছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে যে সৈন্যরা বিদ্রোহ করেছিল তারা ছিল গণবাহিনী, সৈনিক সংস্হা ও ফারুক-রশীদের অনুগত সৈনিকদের একটি অংশ, যারা জাসদের সহায়তায় জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেছিল।
১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের আগস্টের মাঝামাঝি থেকে দায়িত্বে থাকা দখলদারদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার পরিস্থিতি তৈরি করার ক্ষেত্রে খালেদ মোশাররফ অবশ্যই সঠিক পথে ছিলেন। যে অফিসাররা সশস্ত্র বাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতিকে গাইড করেছিলেন, তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিলো।
আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার গর্বিত কন্যা। আমার বাবা শুধু আমাদের দেশের জন্য লড়াই করেননি, তার বিশ্বাসের জন্য জীবনও দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার যেনো সত্য খুঁজে বের করে হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনেন। একই সঙ্গে যারা জেনারেল খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে, গুজব ছড়িয়েছে, অসম্মান করেছে তাদেরও যেনো জবাবদিহির আওতায় আনেন। ৭ নভেম্বরের প্রকৃত ইতিহাস, মুক্তিযোদ্ধাদের আসল উদ্দেশ্য জানার অধিকার বাংলাদেশিদের আছে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য, জেনারেল খালেদ মোশাররফের কন্যা ও চেয়ারম্যান, খালেদ মোশাররফ ট্রাস্ট