ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন বলেছেন, পাঠক্রম পরিবর্তন করার মধ্য দিয়ে কারিগরি শিক্ষাকে মেইনস্ট্রিম করার চেষ্টা করা হচ্ছে। উচ্চতর গণিত বাদ দেওয়া হলো। বিজ্ঞানের ৩টা বই মিলে একটি বই হচ্ছে, যা বিজ্ঞান শিক্ষাকে সংকুচিত করবে। ভবিষ্যতে যারা বিজ্ঞান পড়তে চাইবে তারা মারাত্মক সংকটে পড়বে। মূল কথা হলো সবাই সবকিছু পড়বে- এভাবে একটা এভারেজ জাতি তৈরি হবে। কোনো বিজ্ঞানী তৈরি হবে না। বিজ্ঞান না পড়িয়ে ‘জীবন ও জীবিকা’ পড়াবে সবাইকে। অর্থাৎ শুরু থেকেই বিজ্ঞানী, গবেষক নয়, বরং জীবিকার কথা ভাবানো হচ্ছে। সবমিলে এ রূপরেখা জাতিকে ধ্বংস করার রূপরেখা।
বৃহস্পতিবার (৭ অক্টোবর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে মুনীর চৌধরী মিলনায়তনে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন তিনি। সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়।
অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন বলেন, ‘এ দেশের সরকার কখনোই আন্দোলন ছাড়া কিছু করেনি। শিশুদের শিক্ষকরা হবেন মডেল। এরকম শিক্ষক আমাদের দেশে কতজন আছে? এরকম শিক্ষকের ব্যবস্থা না করে এখন ভাবতে পারেন পরীক্ষা থাকবে না? স্কুল এখন শিক্ষকরা চালায় না, চালায় গভর্নিং বডি।’
তিনি আরও বলেন, শিক্ষার বাজেট জিডিপির ২ শতাংশ। এটা দিয়ে শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। সরকার একের পর এক মেগা প্রজেক্ট নিচ্ছে। কিন্তু শিক্ষায় মেগা প্রজেক্ট নেওয়া হয় না।
সংগঠনের সভাপতি মাসুদ রানার সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক রাশেদ শাহরিয়ারের সঞ্চালনায় সভায় আরও বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম, শিক্ষা ও শিশু রক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক কথা সাহিত্যিক রাখাল রাহা, ঝিগাতলা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ইসহাক সরকার, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক বিধান রিবেরু, শহীদুল্লাহ স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক শামীম জামান।
অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, ‘এই শিক্ষাক্রম বাস্তবে প্রয়োগ অসম্ভব। সরকার এটা করছে কেন? সাম্প্রতিক সময়ে দেশের শিক্ষার মান নিয়ে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। র্যাংকিং হচ্ছে। বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় সবার নিচে। তাতে সরকার চাপে পড়ে কিছু করে দেখাতে চাইছে। বাহবা নিতে চাইছে সম্ভবত। কিন্তু এর জন্য তারা সময় নিয়েছে মাত্র দু’বছর। এ সময়ে পাঠ্যপুস্তক তৈরি, শিক্ষক প্রশিক্ষণ দিয়ে এটা বাস্তবায়ন করা অসম্ভব। এজন্য পর্যাপ্ত বাজেটের প্রয়োজন। শিক্ষাক্রমে এ বিষয়ে কোনো কথা নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রমে ইংরেজি শিক্ষার নম্বর ও ক্লাসের সময় কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে বাংলা মাধ্যমে যারা পড়বে তারা ইংরেজির ভিত আরও দুর্বল হবে। ইংলিশ ভার্সন, ইংলিশ মিডিয়ামের দিকে অনেকেই ঝুকবে। শিখনকালীন মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অ্যাটেনডেন্স ও মাসিক পরীক্ষার ভিত্তিতে নম্বর দেওয়া যেতে পারে কিন্তু সরাসরি শিক্ষকের হাতে নয়। এটা দেশের বর্তমান বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।’
শহীদুল্লাহ স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক শামীম জামান বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রমে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা থাকবে না অথচ ক্লাস ফোরে উঠেই তাকে ৬টি পরীক্ষা দিতে হবে। এটা অনেক চাপ হবে। আবার বই থাকবে না এটাও ভয়াবহ হবে। পিইসি-জেএসসি পরীক্ষা বাতিলের কথা আমরা আগেও বলেছি, এখনও বলছি। এখন আবার দশম, একাদশ, দ্বাদশ পরপর তিনটি পরীক্ষা নিলে শিক্ষার্থীদের জন্য চাপের হবে।’
সভাপতির মাসুদ রানা বলেন, ‘শিখনকালীন মূল্যায়ন বা ধারাবাহিক মূল্যায়ণ নিঃসন্দহে একটি উন্নত প্রক্রিয়া। কিন্তু স্থান,কাল বিবেচনায় না নিলে উন্নত প্রক্রিয়াও সব সময় উন্নত ফল দেয় না। এর জন্য পর্যাপ্ত ও দক্ষ শিক্ষক আমাদের নেই। শিক্ষকদের একটা অংশও নানা কারণে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়তে পারেন। বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে শিক্ষকরা ছাত্রদের জোড় করে নিজের কাছে পড়া,বা কোচিং এ পড়তে বলবেন। যারা পড়বে তারাই বেশি নম্বর পাবে। । শুধু তাই নয়, এতে স্বজনপ্রীতির সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে। পরপর তিনটি পাবলিক পরীক্ষা ছাত্রদের জন্য হবে চাপের।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষার কাজ হওয়া উচিৎ স্বাধীন চিন্তা ও বিচারের জন্য প্রয়োজনীয় সামর্থ্য তৈরি করা। সরকার সে পথে হাটছে না। তারা চায় ব্যবসায়িক মুনাফা অর্জনে সক্ষম একদল শ্রমিক তৈরি করা। আওয়ামী সরকার এর আগের সৃজনশীল প্রশ্ন চালু করে বলেছিল, চিন্তার ক্ষমতা বাড়বে, মুখস্থ নির্ভরতা কমবে। কিন্তু ফল হয়েছে তার উল্টো। আর এসব কর্মকাণ্ডের বলি হয়েছে শিক্ষার্থীরা। ভালো ভালো কথার মোড়কে জাতীয় শিক্ষাক্রমও একই পথে যাত্রা শুরু করবে। যা গোটা শিক্ষা ব্যবস্থায় বিপর্যয় ডেকে আনবে। তাই এই শিক্ষাক্রম বাতিলের দাবিতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।