‘যদি শিক্ষকতার পেশায় না এসে চা বিক্রেতা হতাম তাহলে অন্ততঃ ঈদে বউ বাচ্চাদের নতুন পোশাক কিনে দিতে পারতাম। গত ২১টি বছর শিক্ষকতা করে কিছুই দিতে পারেননি পরিবারের সদস্যদের।’ এমন আক্ষেপের কথা দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বললেন যশোরের মণিরামপুর উপজেলার মহাদেবপুর জুনিয়র স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমান। একই আক্ষেপের কথা জানিয়েছেন সিটি কে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মলয় কুমার রায়। বিদ্যালয়গুলো দীর্ঘদিন আগে স্থাপিত হলেও এখনও এমপিওভুক্ত হয়নি।
শিক্ষক মলয় কুমার রায় দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, গত ২৫টি বছর শিক্ষকতা করে চলেছি, কোন দিন স্ত্রী-সন্তানদের বলতে পারেননি আজ আমার বেতন হয়েছে। চার বছর পরেই অবসরে যাবো, কিন্তু বেতন সৌভাগ্যে আছে কিনা তাও বলতে পারছিনা। শুধু মিজানুর এবং মলয় নয়, উপজেলার ৪টি কলেজ, ৮টি দাখিল মাদরাসা এবং ৮টি মাধ্যমিক ও জুনিয়র স্কুলের চার শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারী বেতন না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন দীর্ঘদিন ধরে। প্রতিবছর ঈদ এবং পূজা এলেই দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন শিক্ষকরা।
আরও পড়ুন : দৈনিক শিক্ষাডটকম পরিবারের প্রিন্ট পত্রিকা ‘দৈনিক আমাদের বার্তা’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমানের বিদ্যালয় মহাদেবপুর জুনিয়র স্কুলটি ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত হয়। এ বিদ্যালয়টিতে ৭ জন শিক্ষক-কর্মচারী এমনই বেতন না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
৩৩ বছর এমপিওভুক্ত না হওয়া বড় চেৎলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিতাই বসু দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। বর্তমানে বিদ্যালয়টি পূর্ণাঙ্গ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ১৭ জন শিক্ষক-কর্মচারী দীর্ঘদিন কর্মরত আছি। খুব শিগগিরই আমি প্রধান শিক্ষক নিতাই বসু এবং কৃষি শিক্ষক গোবিন্দ চন্দ্র অবসরে যাচ্ছি। কিন্তু বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে গত ৩৩টি বছর বেতন হিসেবে সরকারের একটি টাকাও ভাগ্যে জোটেনি। আর জোটবে কিনা তাও অনিশ্চিত। তবে বেতন না পেয়ে যেমন কষ্টের মধ্যে শিক্ষক পরিবারগুলো রয়েছেন তা কেবলমাত্র ভুক্তভোগীরা ছাড়া আর কেউ অনুভব করতে পারবেন না।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বিকাশ চন্দ্র সরকার দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, মণিরামপুর উপজেলার ২১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত না হওয়ায় সেখানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীরা বছরের পর বছর অর্থাভাবে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব ও ফেসবুক পেইজটি ফলো করুন
ঢাকুরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ তাপস কুমার কুন্ডু দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানিয়েছেন, ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে কলেজটি স্থাপিত করা হয়েছে। কলেজটি আজও পর্যন্ত এমপিওভুক্ত হয়নি। যার ফলে ২৯ জন শিক্ষক-কর্মচারী অর্থাভাবে চরম কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। এরই মধ্যে কলেজের সরকারিভাবে দেয়া তিন তলা বিশিষ্ট ভবনও করা হয়েছে। কিন্তু তাতে কি হবে শিক্ষক-কর্মচারীদের।
চিনাটোলা কলেজের অধ্যক্ষ সাজ্জাদ হোসেন দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, ২০০২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে কলেজে ৩২ জন শিক্ষক-কর্মচারী বেতন না পেয়ে অর্থাভাবে চরম কষ্টে দিন কাটাতে হচ্ছে। বহু চেষ্টা করেও আজ পর্যন্ত এমপিওভুক্ত করা সম্ভব হয়নি।
এছাড়া এ আর মুক্তিযোদ্ধা মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মিলন কুমার ঘোষাল দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান, বেতন না পেয়ে এখন শিক্ষক-কর্মচারীদের মাঝে কাজে অনিহা সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষক কর্মচারীদের ধারণা প্রতিষ্ঠান মনে হয় আদৌ এমপিওভুক্ত হবেনা। এখানকার অধিকাংশ শিক্ষক-কর্মচারীরা পরিবারের ভরণপোষন মেটাতে বিনা বেতনের চাকরির পাশাপাশি দিন মুজুরির কাজও করছেন।
বেতন না পাওয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছেন মাতৃভাষা কলেজ এবং সবুজ পল্লী কলেজও। এরমধ্যে মাতৃভাষা কলেজে অবকাঠামো দৃশ্যমান রাখতে সরকার কোটি টাকা ব্যায়ে ভবন করে দিয়েছেন। যে কারণে অনেকেই কর্মক্ষেত্রে অনিহা দেখা দিয়েছে।
মহাদেবপুর-জয়নগর দাখিল মাদরাসার সুপার জসিম উদ্দীন একই কষ্টের কথা জানিয়েছেন। তিনি দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, ১৭ জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়ে সেই গত ২০০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বিনা বেতনে চাকরি করে যাচ্ছি। কবে সরকারের মর্জি হবে তাও বলা মুশকিল। এ অবস্থায় শিক্ষক-কর্মচারীদের অর্থাভাবে চরম কষ্টে দিন কাটছে। তিনি আরও বলেন, বড় কষ্টের দিন হচ্ছে প্রতি বছরের দুইটি ঈদ উৎসবের সময়। এ সময় শিক্ষকরা ইচ্ছা করলেই তাদের সন্তানদের চাহিদা মেটাতে পারেন না। পারেন না অন্য কোন উপায়ে অর্থ উপার্জন করতে। ফলে নিদারুন কষ্টের দিন কাটাতে হচ্ছে তাদের।
নেহালপুর দাখিল মাদরাসার সুপার আজিজুর রহমান দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, বয়সের যে পর্যায়ে পৌছেছি তা শিক্ষকতা ছেড়ে এখন অন্য কিছু করাও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে চরম কষ্টে কাটাতে হচ্ছে বছরের পর বছর।
মদিনাতুল উলুম মহিলা দাখিল মাদরাসার সুপার গোলাম রব্বানী দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, এভাবে আর জীবন চলে না। অর্থ নষ্ট করে প্রতিষ্ঠান গড়ে বছরের পর বছর বেতন না পেয়ে শিক্ষক-কর্মচারীরা এখন চরম কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন।
লক্ষণপুর আদর্শ মহিলা মাদরাসা, পাড়দিয়া মহিলা দাখিল মাদরাসা, দিঘীরপাড় মহিলা দাখিল মাদরাসা এবং ইত্যা স্লুইচগেট দাখিল মাদরাসার শিক্ষক-কর্মচারীদেরও অবস্থা একই।
সুপার রুহুল আমিন দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান, রোজা থেকেও পয়সার অভাবে অন্যের ক্ষেতে দিন মুজুরির কাজ করছে শিক্ষক-কর্মচারীদেও কেউ কেউ। এছাড়া কয়দিন বাদে ঈদ। বউ বাচ্চাদের হাতে কিছু দিতে এখন অনেকেই অন্যের জমিতে শ্রম বিক্রি করছেন।
এর বাইরেও উপজেলার পৌরসভা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, চাঁদপুর-মাঝিয়ালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম-দশম শ্রেণিতে নিয়োগকৃত শিক্ষকরাও বছরের পর বছর বেতন পাননা। এ তালিকায় আরও রয়েছে গোপালপুর স্কুল এন্ড কলেজ, নেংগুড়াহাট কলেজিয়েট এবং রাজগঞ্জ মহিলা আলিম মাদরাসায় একাদশ শ্রেণির জন্য কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীরাও সরকারী বেতনভাতা পাননি আজও। এসব শিক্ষক-কর্মচারীদের অধিকাংশই অপেক্ষার পর অপেক্ষা করে বয়সের শেষ প্রান্তে পৌছেছেন। এ অবস্থায় তাদের সংসার জীবনও থমকে পড়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য ভুক্তভোগী শিক্ষক-কর্মচারীরা বেতন পাওয়ার ব্যবস্থা করতে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।