‘সচেতন, সতর্ক ও পরিচ্ছন্ন থাকুন; নিজেকে, পরিবারকে ও দেশকে করোনা ভাইরাস মুক্ত রাখুন’ - দৈনিকশিক্ষা

‘সচেতন, সতর্ক ও পরিচ্ছন্ন থাকুন; নিজেকে, পরিবারকে ও দেশকে করোনা ভাইরাস মুক্ত রাখুন’

অধ্যক্ষ শরীফ আহমদ সাদী |

মানব ইতিহাসে এমন অনেক ভাইরাস ব্যক্টেরিয়া কিংবা আদিকোষী এককোষী ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণু ভয়ংকরভাবে পৃথিবীতে এসেছে। তছনছ করে দিয়েছে বহু দেশ জনপদ। সশস্ত্র যুদ্ধ মরণাস্ত্র বোমায় কোটি কোটি মানুষ জীবন দিয়েছে। আবার এই ক্ষুদ্র জীবাণুর আক্রমণে আরও বেশি সংখ্যক মানুষ অসহায়ভাবে প্রাণ বিসর্জন করেছে। বর্তমানে ভাইরাস নোভেল করোনা’র বিরুদ্ধে সকল পরাশক্তি মিলে আমরা মানবসমাজ যুদ্ধ ঘোষণা করেছি। অবশ্যই আমরা করবো জয়।

মানবসমাজকে বিভিন্ন সময়ে বিপর্যস্ত করেছে যে সমস্ত জীবাণু:

ভিব্রিও কলেরি (কলেরা) : এটি এক প্রকার ব্যাক্টেরিয়া। অতীতে এর কারণে লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুর মিছিলে গেছে। এই ব্যাক্টেরিয়া ভিব্রিও কলেরিকে আমরা বাংলাদেশ থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছি। কাজেই আজও ভয় নেই, মানবের হবে জয়।

প্লাজমোডিয়াম (ম্যালেরিয়া) : এটি এককোষী জীব, এর কয়েকটি টাইপ আছে। এখনও পৃথিবীর কোনো কোনো অঞ্চলে ভয়াবহরূপে  মানুষের জীবনহানি ঘটিয়ে চলছে। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে ৪ লাখ ১৬ হাজার, ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে ৪ লাখ ৫ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। একে কব্জায় এনে ফেলেছে চিকিৎসা বিজ্ঞান। বিশ্বের অন্যান্য দেশে থাকলেও বাংলাদেশ একে পরাভূত করেছে অনেক আগেই।

ভেরিওলা ভাইরাস (গুটিবসন্ত) : ১২০০ খ্রিষ্টাব্দে মারাত্মকত ছোঁয়াচে রোগ হিসেবে ইংল্যান্ডে শনাক্ত হয়। ষোড়শ শতাব্দিতে এটি মহামারি আকারে দেখা দেয়। আমাদের এ অঞ্চলেও একসময় এই মহামারি ছিল। এর টিকা আবিষ্কার করা হয়েছে। বিদায় হয়েছে ভেরিওলা ভাইরাস। বাংলাদেশ থেকে আমরা একে নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম হয়েছি। 

টিউবারকুলোসিস (যক্ষ্মা) : এক প্রকার ব্যাকটেরিয়া-মাইকোব্যাক্টেরিয়াম টিউবারকুলোসিস এর মাধ্যমে মানুষের ফুসফুস আক্রান্ত হয়। সারাবিশ্বে লাখ লাখ মানুষ যক্ষ্মায় মৃত্যুবরণ করেছে। এক সময় আমাদের দেশেও হাজার হাজার মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করত। অনেক দেশে এর প্রাদুর্ভাব থাকলেও বাংলাদেশ এখন যক্ষ্মামুক্ত। 

ডায়রিয়া/উদারময় : নরোভাইরাস, রোটাভাইরাস, এডিনোভাইরাস, এস্ট্রোভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া সেলমোনেলা, সিগেরা, এককোষী এন্টামিবা, ক্রিপ্টোস্পোরিডিয়াম এর বিভিন্ন প্রজাতি ভয়াবহ ডায়রিয়ার কারণ ঘটায়। এখনও সমগ্র বিশ্বে গড়ে প্রতিদিন ২ হাজার ১৯৫ শিশু ডায়রিয়ায় মারা যায়। এর প্রতিরোধী ব্যবস্থা আবিষ্কার হয়েছে। আমাদের দেশে ডায়রিয়ার মৃত্যু তেমন নেই বললেই চলে। অ্যাভিয়ান বার্ড/সোয়াইন ফ্লু: এটি ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস। শুকর কিংবা পাখি-বাহিত এ ভাইরাস মানবদেহে সংক্রমিত হয়। H1N1/H2N2/H3N2 এরূপ ৩ প্রকারের ভাইরাস। এ যাবৎ ৫ লাখ ৭৫ হাজার ৪০০ মানুষ এ রোগে প্রাণ হারিয়েছে। বর্তমানে এর ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়েছে। বাংলাদেশ একে জয় করেছে। 

এইচআইভি ভাইরাস (এইডস) : ১৯২০ এ আফ্রিকার কংগোর কিনসামা থেকে এর যাত্রা শুরু। আফ্রিকা, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা,  ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়ায় দাপটের সাথে এইচআইভি রাজত্ব করে চলেছে। এ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটলে মানবদেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। একে এখনো সম্পূর্ণভাবে জয় করতে পারেনি চিকিৎসা বিজ্ঞান। এইডস আক্রান্ত হলে মৃত্যুর কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ ছাড়া কিছুই করার থাকে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ভাইরাসটিকে কত সমীহ করে। ১লা ডিসেম্বরকে বিশ্ব এইডস দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। এইডস অন্যান্য অনেক দেশকে কাবু করতে পারলেও আমরা সগর্বে বলতে পারি বাংলাদেশকে পারেনি।

চিকনগুনিয়া : তাঞ্জানিয়ার মাকুন্দি জনগোষ্ঠীর ব্যবহৃত কিমাকুন্দি ভাষা থেকে চিকনগুনিয়া শব্দের উৎপত্তি যার অর্থ কুঞ্চিত বা বাঁকা হয়ে যাওয়া। মশা-বাহিত এ ভাইরাস ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশে প্রথম ধরা পড়ে। সারা বিশ্বে এ যাবৎ ৪৯ হাজার মানুষ চিকনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। আমাদের দেশে এটি মহামারি আকারে আসতে পারেনি। বাংলাদেশ একে তুড়ি মেরে ছুঁড়ে ফেলেছে।

ডেঙ্গু ভাইরাস : ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। মশকি বাহিত ভাইরাস এটি। ২০০০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ১শ দেশে ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৬ হাজার ২২২ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। এ যাবৎ ডেঙ্গুতে বাংলাদেশে ৫০ জনের প্রাণ গেছে। মশকীর প্রজনন নিয়ন্ত্রণ, সময়মতো পরিচর্যা ও চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে ডেঙ্গু-মুক্ত থাকা যায়। ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে আমরা বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্য  সচেতনতা এবং মশকী এনোফিলিসের  বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের হাতিয়ার দিয়ে ডেঙ্গুকে পঙ্গু করে দেয়া সম্ভব।

ইবোলা : ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম পশ্চিম আফ্রিকায় এই ভাইরাসটি ধরা পড়ে। কঙ্গোর ইবোলা নদীর নাম থেকে এই ভাইরাসটির নামকরণ। বানর, শুকর থেকে এবং ফল আহারী বাদুর থেকে মানবদেহে রোগ ছড়ায়। আফ্রিকায় ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ১১ হাজার ৩২৩ জন ইবোলায় প্রাণ হারিয়েছে। এই মারাত্মক ভাইরাস মোকাবেলায় ইবোলা ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়েছে। আমাদের দেশে ইবোলা আসতে পারেনি।

জিকা ভাইরাস : উগান্ডার জিকা নামক এক গ্রামে বানরের দেহে প্রথম এ ভাইরাস পাওয়া যায়। বানর থেকে মশা বাহিত হয়ে মানুষের দেহে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাজিলে ২ হাজার ৪০০ মানুষ জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য। জিকা ভাইরাস আমাদের দেশে আক্রমণ করতে পারেনি।

করোনা ভাইরাস : করোনা ভাইরাস বিভিন্ন টাইপের। মার্স করোনা, সার্স করোনা, নোবেল করোনাসহ আরও কয়েক রকমের আছে। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল সার্স (SARS = Severe Acute Respiratory Syndrome) নামে এক সংক্রামক ভাইরাস। যাতে আক্রান্ত হয়েছিল ৮ হাজারেরও বেশি লোক এবং ১৭টি দেশে মৃত্যু হয়েছিল ৭৭৪ জনের। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে বাদুর ও উট-বাহিত মার্স করোনা (MERS=Middle East Respiratory Syndrome) প্রথম ধরা পড়ে মধ্যপ্রাচ্যে। মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন  দেশে ১৪১ জন আক্রান্তের মধ্যে ৫৭ জন মৃত্যুবরণ করে। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে করোনা ভাইরাসের একটি প্রজাতির সংক্রমণ দেখা দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভাইরাসটিকে নোবেল করোনা নামকরণ করেন। Corona Virus এ সৃষ্ট রোগের নাম COVID-19। আমরা অতীতে যেমন অনেক শক্তিশালী ভয়ঙ্কর দুর্ধষ ব্যাকটেরিয়া ভাইরাসসহ অন্যান্য জীবাণুযোদ্ধাদের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেছি ঠিক তেমনি সচেতনতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার হাতিয়ার দিয়ে এখনও এদেরকে পরাজিত করতে সক্ষম হবো।

প্লেগ, ম্যালেরিয়া, কলেরা, যক্ষা, ডায়রিয়াসহ আরও অনেক রোগ-বালাই, মহামারিতে বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর কথা আজ ইতিহাস। প্রচীনযুগ, মধ্যযুগ, আধুনিকযুগ এবং সম-সাময়িককালে কোটি কোটি মানুষ ভয়াবহ মহামারির থাবায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। এ যুগ বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের যুগ। আগামী কিছুদিনের মধ্যে পৃথিবী অনেকাংশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) দিয়ে চালিত হবে। মানুষের বুদ্ধিমত্তার সাথে সুপার কম্পিউটার কিংবা রোবট আজকের এই মহামারি সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসবে। মানবসমাজে ভাইরাসজনিত যত রোগ আছে এবং যত রকমের জেনেটিক রোগ আছে তা থেকে মানবজাতি মুক্তি পাবে। যেখানে হিউম্যান জিনোমকোড বা জেনেটিক কোড আবিষ্কার হয়ে গেছে, সেখানে ব্যাক্টেরিয়া ভাইরাসের জিনোমকোড এবং মানুষের দেহকোষের অভন্তরে তার প্রতিলিপন বন্ধ করা বিজ্ঞানীদের জন্যে কোন কঠিন কাজ নয়। নিউক্লিক এসিড RNA দিয়ে ভাইরাস গঠিত। করোনা ভাইরাসের RNA মানব দেহকোষের অভ্যন্তরে ট্রান্সক্রিপশন কিংবা ট্রান্সলেশন করতে পারবে না। HIV কিংবা CORONA যে কোনো ভাইরাসই হোক তার প্রতিলিপন (Transcription) বন্ধ করতে পারলেই মনবদেহ নিরাপদ হয়ে যাবে। বিজ্ঞানীরা সে চেষ্টা করে যাচ্ছেন, সেই দিনটির জন্য আমরা অপেক্ষা করছি। আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরা যেমন করে খুব সুলভে  COVID-19 রোগ পরীক্ষার কীট আবিষ্কার করে ফেলেছেন ঠিক তেমনি নোবেল করোনাকে ধ্বংস করার প্রতিষেধক কিংবা করোনা-বিধ্বংসী জিন টেকনোলজিও আবিষ্কার করবেন।

আপাতত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বাংলাদেশ সরকার ও স্বাস্থ্য বিভাগের  নির্দেশনা/পরামর্শ অনুসরণ করুন। স্বীকৃত সংস্থা, প্রতিষ্ঠান কিংবা নির্ধারিত ব্যক্তির ব্রিফিং ছাড়া অন্য কারোর পরামর্শ গ্রহণ করবেন না। ভয় নেই, ভয়কে জয় করেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।

লেখক : অধ্যক্ষ শরীফ আহমদ সাদী,  সদস্য-সচিব বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড। 

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0081198215484619