বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার আহাদকে ‘শিবির’ সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়েছে। এই দুস্কর্মটি করেছে সরকারসমর্থক ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের ১৫-২০ জন নেতাকর্মী। তারাও সবাই বুয়েটের ছাত্র। বহিরাগত মাস্তান বা সন্ত্রাসীরা এই ঘটনাটি ঘটায়নি। বুয়েটে যারা পড়াশোনা করেন বা ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান তারা সবাই মেধাবী। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে যারা ভালো ফল করে, তারাই ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান বুয়েটে। তার মানে নিহত আবরার যেমন একজন কৃতী ছাত্র, তেমনি তার ঘাতকরাও ছাত্র হিসেবে সেরাই। আবরার হত্যাকাণ্ড নিয়ে এখন দেশ জুড়ে চলছে এক ধরনের মাতম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে এ নিয়ে তোলপাড়। আবরারের মা-বাবার কান্না সংক্রমিত হয়েছে লক্ষকোটি মা-বাবার মধ্যে। ঘাতকদের বিচারের দাবিতে অনেকেই সোচ্চার। বুয়েটসহ বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদে উত্তাল। সরকারও মনে হয় পায়ের আওয়াজ শুনেছে। অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের কোনো টালবাহানা ছাড়াই দ্রুত গ্রেফতার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও বলা হয়, কেন নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হলো আবরারকে? তার অপরাধ কী? আবরারকে তার রুম থেকে ডেকে নিয়ে হকিস্টিক দিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে পেটানো হয়েছে এবং এক পর্যায়ে তার মৃত্যু হয়েছে। পুরো ব্যাপারটি যে গোপনে সংঘটিত হয়েছে, তা-ও নয়। মারের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে তিনি চিত্কার করেছেন, আশপাশের রুম থেকে অন্য শিক্ষার্থীরা তার আর্তচিত্কার শুনেছেন। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেননি তাকে উদ্ধার করতে বা বাঁচাতে। কারণ শিক্ষার্থীরা জানেন, ছাত্রলীগ মানে এখন এক ভয়াবহ আতঙ্কের নাম! পুলিশও খবর পেয়েছিল, তারা হলের গেটে এসেছিল কিন্তু আবরারকে উদ্ধার না করেই ফিরে গেছে। কারণ ছাত্রলীগের একজন নেতা বাধা দিয়েছেন। বিনা অনুমতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে ঢুকলে শেষে যদি কোনো ঝামেলা হয়—এটা ভেবেই নাকি পুলিশ নিষ্ক্রিয় থেকেছে। কেউ বিপদে পড়লে, কারো জীবন বিপন্ন হলে তাকে রক্ষা করাই পুলিশের দায়িত্ব। ছাত্রলীগের ভয়ে পুলিশ দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছে। পরিণতিতে একটি সম্ভাবনাময় জীবনের অকাল অবসান ঘটল।
আবরার ছাত্রশিবির করে বলে ছাত্রলীগ সন্দেহ করেছিল। শিবির সন্দেহেই তাকে পেটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ছাত্রলীগের কয়েকজন দুর্বৃত্ত। তাকে ডেকে নিয়ে তার মোবাইল চেক করে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস পাওয়া যায়। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় ভারতের সঙ্গে আদান-প্রদানের বিষয়ে মৃদু সমালোচনা আছে। তাতেই আবরারের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ নেতাদের ক্ষোভ তুঙ্গে ওঠে এবং তাকে উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে তা সঙ্গে সঙ্গে অতি নির্মমতার সঙ্গে কার্যকর করা হয়।
কেউ শিবির করলে কিংবা ফেসবুকে কেউ কোনো অপছন্দের স্ট্যাটাস দিলে তাকে পিটিয়ে হত্যা করতে হবে—এমন স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঔদ্ধত্য ছাত্রলীগের এসব কর্মীর হয় কী করে? তাদের কেউ কি শিবির নির্মূল বা ভিন্নমত দমনের দায়িত্ব দিয়েছে? সারা দেশে আবরার ছাড়া আর কেউ শিবির করে না? আসলে ছাত্রলীগের বড় একটি অংশ এখন দানবে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই সংগঠনটি ভালো কাজ করে খবরের শিরোনাম হয়নি। বরং তাদের অপকর্মের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণের দাবি অনেকদিন থেকেই আওয়ামী লীগ তথা বর্তমান সরকারের সুহূদদের পক্ষ থেকে তোলা হয়েছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একাধিকবার ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে ছাত্রলীগকে নিবৃত্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ছাত্রলীগ আর এখন আওয়ামী লাগের জন্য কোনো ‘অ্যাসেট’ নয়, এটা এখন বড়ো ‘লায়াবিলিটি’। ছাত্রলীগ আর এখন কোনো সুনাম সংগ্রহ করতে পারছে না। ছাত্রলীগ নামধারীদের বেপরোয়া আচরণ সরকারকে বিব্রত করার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্যও বড়ো সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার সব অর্জন ম্লান করার জন্যই যেন ছাত্রলীগ মাঠে নেমেছে।
কোনো সুবচনে ছাত্রলীগ আর ভালো হবে বা ঐতিহ্যের ধারায় ফিরে যাবে বলে মনে হয় না। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি থেকে খুনোখুনি সবকিছুতেই আছে ছাত্রলীগ! জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণকাজে বড়ো ধরনের চাঁদাবাজিতে জড়ানোর অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েও যে কোনো লাভ হয়নি সেটা বোঝা গেল বুয়েটে আবরার হত্যার ঘটনায়। এখন আরো শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে প্রচলিত ধারার ছাত্ররাজনীতি এবং রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তির বৃত্তির জন্য আদৌ কোনো ছাত্রসংগঠন রাখার প্রয়োজন আছে কি না সে বিষয়ে। ছাত্ররাজনীতি সাময়িক সময়ের জন্য হলেও, নিষিদ্ধের বিষয়টি সামনে এলে অনেকেই রে রে করে ওঠেন। বলেন, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ভবিষ্যত্ নেতৃত্ব পাব কোত্থেকে? তাছাড়া বাংলাদেশটাই তো গৌরবোজ্জ্বল ছাত্র-আন্দোলন ও ছাত্ররাজনীতির ফসল। হ্যাঁ, আমাদের ছাত্র-আন্দোলনের অতীত ঐতিহ্য নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। কিন্তু সময় বদলেছে। বাস্তবতাও বদলেছে। এখন ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ বলে বিলাপ করে কোনো লাভ নেই। আমাদের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা এটা বলে না যে, রাজনৈতিক দলের লেজুড় ছাত্রসংগঠন দিয়ে ইতিবাচক কোনো কিছু অর্জন করা সম্ভব। ছাত্ররাজনীতি তার গৌরবোজ্জ্বল দিক হারিয়েছে। আগে সংকট ঘনীভূত হলে ছাত্ররা পথে নামত। এখন টেন্ডার বাণিজ্য, লুটপাট, চাঁদাবাজিই ছাত্ররাজনীতির পরিচয় বহন করে। তাহলে যে সংগঠন গঠনমূলক কাজের পরিবর্তে ক্ষতিকর কাজে লিপ্ত, সে সংগঠন জিইয়ে রাখলে আদতেই ক্ষতি বই লাভ নেই।
আমাদের সমাজে নানা দ্বন্দ্ব ও স্ববিরোধ প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। ভালো-মন্দের বিবেচনাও এখন নতুন মাত্রা লাভ করছে। আমরা ভালো কথা বলে পৃষ্ঠপোষকতা নিই খারাপের। ভালো মানুষকে এখন বুদ্ধিহীন মনে করা হয়। যে কোনো উপায় সম্পদ অর্জনকারীরা এখন সামাজিকভাবে নিন্দিত না হয়ে গ্রহণীয় হচ্ছেন, ফলে যে কোনো উপায়ে অর্থবিত্তের অধিকারী হওয়ার উত্কট প্রতিযোগিতা চলছে সর্বত্র। এগিয়ে যাওয়ার নগ্ন প্রতিযোগিতার কারণে সমাজে নিষ্ঠুরতা, হিংস্রতা বাড়ছে। তুচ্ছ কারণে একজন আরেকজনকে হত্যা করতে দ্বিধা বোধ করছে না। আবরারকে যারা পিটিয়ে মারল তারা কারা? কোন পরিবারে, কোন পরিবেশে, কোন শিক্ষায় তারা বেড়ে উঠেছে? দেশের সেরা বিদ্যাপীঠের মেধাবী শিক্ষার্থী কীভাবে ‘খুনি’ হয়ে উঠছে, এর দায় কার বা কাদের? আমরা কেউ কি দায়মুক্ত?
অবশ্যই দায় সবার। যেমন পরিবারের দায়, তেমনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল সবার। কেউই যার যার কাজটি ঠিকমতো করিনি। আমরা আমাদের সন্তানদের নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা দিতে পারিনি। আমরা ভালো ছাত্র নামক লাগামহীন পাগলা ঘোড়ার পেছনে ছুটেছি কিন্তু ভালো ছাত্র হলেই যে ভালো মানুষ হতে পারে না, সেই বিষয়টি বিবেচনায় নিইনি। তাই তো বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ভালো ছাত্র হলেও ভালো মানুষ হতে পারেনি, যদিও সবার ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য নয়।
ছাত্ররাজনীতিকে কলুষমুক্ত করার জন্য একটি কঠিন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ছাত্ররাজনীতির পক্ষে ওকালতি করে, ছাত্র-আন্দোলনের অতীত ঐতিহ্যের ধুয়া তুলে বর্তমানকে জাস্টিফাই করা অর্থহীন। যে ছাত্ররাজনীতি বিবেকবান নেতৃত্ব তৈরি করার পরিবর্তে খুনি, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, ঠ্যাঙারে তৈরি করে সেই ছাত্ররাজনীতির কোনো প্রয়োজন নেই। যেহেতু ছাত্রসংগঠনের ছাতার আশ্রয় নিয়েই তৈরি হচ্ছে দুর্বৃত্ত দল, সেহেতু এই ছাতাটাই প্রথম কেড়ে নিতে হবে। কোনো ছাত্রসংগঠনের পরিচয় যেন কোনো ছাত্র দিতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। না, মাথাব্যথার ওষুধ মাথা কেটে ফেলা অবশ্যই নয়। আবার হাত বুলিয়েও প্রচণ্ড মাথাব্যথা দূর করা যায় না। ক্রীড়া ও সংস্কৃতিচর্চার পরিধি বাড়িয়ে ছাত্রসংগঠনের অন্যসব তত্পরতা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। সেইসঙ্গে উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিষিদ্ধ করতে হবে শিক্ষকদের সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতিও। শিক্ষকদের রাজনৈতিক মত ও বিশ্বাস থাকতেই পারে, একজন সচেতন রাজনীতি সমর্থন দোষের কিছু নয়, কিন্তু প্রকাশ্যে দলবাজি করা শিক্ষকতা পেশার নৈতিকতার পরিপন্থি। তাই নানা পথ নানা মতে বিভাজিত শিক্ষক-রাজনীতিও নিষিদ্ধ করার বিষয়টিও ভাবতে হবে গুরুত্ব দিয়েই। ছাত্ররাজনীতি, শিক্ষক-রাজনীতির পক্ষে সাফাই গেয়ে আমরা কী সুফল পেয়েছি এত বছরে? আরেকটি বিষয়ও ভাবার সময় এসেছে। প্রতিবাদী হওয়ার জন্য সংগঠন করা কিংবা সরাসরি রাজনৈতিক দলের প্রভাবে থাকা কখনোই অপরিহার্য শর্ত হতে পারে না। সাম্প্রতিক সময়ে দেশ-কাঁপানো দুটি আন্দোলন—কোটাবিরোধী আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন কোনো ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠেনি, গড়ে উঠেছিল প্রয়োজনের তাগিদে স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
আমাদের দেশের মূলধারার রাজনীতিতে যেমন গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে, বিরোধিতার রাজনীতি, প্রতিহিংসার রাজনীতির বিকল্প হিসেবে ইতিবাচক, গঠনমূলক রাজনীতির ধারায় ফিরতে হবে, তেমনি ছাত্ররাজনীতিতেও আনতে হবে পরিবর্তন। রাজনৈতিক দলের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত ছাত্র-আন্দোলনের পথ তৈরির জন্যই এখনই বন্ধ করা দরকার প্রচলিত ধারার ক্ষতিকর রাজনীতি।
বিভুরঞ্জন সরকার : সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।