টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন একজন স্বল্প আয়ের অভিভাবকও তার সন্তানদের ব্যয়বহুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ায়, পড়াতে চায়। কারণ একটিই, সে শিক্ষার পেছনে বিনিয়োগ করছে। ভালো বিনিয়োগ করছে ভালো রিটার্ন পাওয়ার আশায়। একইভাবে শিক্ষা খাতে রাষ্ট্রেরও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যাতে দেশ উন্নতমানের ও কাঙ্ক্ষিত রিটার্ন পায়। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে শিক্ষা বাজেট জিডিপির ৬ শতাংশ এবং মোট জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যয় ২.৩ কিংবা ২.৪ শতাংশ এবং মোট বাজেটের ১৫ শতাংশের নিচে অবস্থান করছে, যা আফ্রিকার অনেক দেশ থেকেও কম। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, শুধু শিক্ষা বাজেট বাড়ালেই কি শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত মানে আমরা পৌঁছে যাব? শিক্ষা বাজেট বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এর সঠিক ও উপযুক্ত ব্যবহার প্রয়োজন।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতে, শিক্ষার মান বিচারে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। ১৩০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৭তম। ভারত ২৭তম, শ্রীলঙ্কা ৩৮তম, পাকিস্তান ৬৬তম ও নেপাল ৭০তম। ব্যানবেইস থেকে প্রাপ্ত কিছু তথ্য, যেমন—মাধ্যমিক পর্যায়ে ৩০ শতাংশ শিক্ষকের কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ নেই এবং দেশের ৩০ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কোনো বিজ্ঞানাগার নেই। এই দুটি বিষয়ই কিন্তু শিক্ষার মানের সঙ্গে সরাসারি সম্পৃক্ত। প্রথম বিষয়টি নিয়ে অনেক কথা হয়, অর্থাৎ শিক্ষকদের মান বৃদ্ধি করার কথা বলা হয়, অর্থও খরচ করা হয়, কিন্তু এর কতটা কাজে লাগানো হয়, সেটি নিয়ে কোনো ধরনের ‘ফলোআপ’ কার্যক্রম নেই। একইভাবে বিজ্ঞান শিক্ষায় আমাদের শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ভীষণভাবে পিছিয়ে আছে। তাদের কিভাবে বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহী করে তোলা যায় তার সঠিক উল্লেখ থাকা প্রয়োজন শিক্ষা বাজেটে।
প্রাথমিক পর্যায়ে ইংরেজি ও গণিতে দুর্বলতা নিয়ে বের হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। জাতীয় এক জরিপে দেখা যায়, পঞ্চম শ্রেণির ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীই গণিতে দুর্বলতা নিয়ে বের হচ্ছে। মাধ্যমিকেও একই দুরবস্থা। অষ্টম শ্রেণির অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থীর বাংলা, ইংরেজি ও গণিতে কাঙ্ক্ষিত মানের দক্ষতা নেই। উচ্চ মাধ্যমিকের একই অবস্থা। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়, তখন এই দুর্বলতা চোখে পড়ে। পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে এগুলো প্রকাশিত হয় না। সৃজনশীল প্রশ্নে দেশব্যাপী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, অথচ প্রায় অর্ধেক শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্ন এখনো ভালোভাবে বুঝেন না এবং প্রশ্নও করতে পারেন না। বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ স্কিলস ফর টুমরোস জবস’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুরু থেকেই অক্ষরজ্ঞান ও গাণিতিক হিসাবের সক্ষমতার অভাবে পরবর্তী সময়ে আর দক্ষতা অর্জন করে উঠতে পারছে না। মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার নিম্নমুখী মানের কারণে তাত্ত্বিক বিষয়ে শিক্ষার্থীদের দক্ষতার ভিত্তি দুর্বল হচ্ছে। এর ফলে পরবর্তী সময়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কার্যকরভাবে দক্ষতা উন্নয়নের প্রচেষ্টাও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। দক্ষতার ঘাটতির কারণে চাকরিপ্রার্থীরা চাকরিদাতাদের সন্তুষ্ট করতে পারছে না। ফলে ব্যক্তি ও সামাজিক অর্থনীতি এবং শিক্ষার আগ্রহেও ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। এগুলো কিভাবে মিনিমাইজ করা হবে তার নির্দেশনা শিক্ষা বাজেটে থাকা একান্ত প্রয়োজন। আর তাই অনেক শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, কলামিস্ট মতামত প্রদান করছেন যাতে শিক্ষার জন্য একটি আলাদা বাজেট তৈরি করা হয়। এটি যুক্তিসংগত মতামত।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারি বাজেট বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি বাজেট অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের ফিও বাড়ানো প্রয়োজন। এর কয়েকটি কারণ আছে। একটি হচ্ছে যখন শুধু সরকারি টাকায় শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করে তখন শিক্ষকরাও সেভাবে গুরুত্ব দেন না (ব্যতিক্রম ছাড়া)। তাঁরা রাষ্ট্র পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কনসালট্যান্সি বেশি করেন। তাঁদের নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস খুব একটা না করালেও জবাবদিহি তেমন একটা থাকে না। দ্বিতীয় আরেকটি কারণ হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা হলে সিট পায় না। সরকারি দলের শিক্ষার্থী-অশিক্ষার্থীরা হল দখল করে রাখে। তাদের একটি অলিখিত যুক্তি হচ্ছে, আমরা ক্ষমতায় আছি। রাষ্ট্রসহ সব কিছু আমাদের কথায় চলবে। এখানে রাষ্ট্রের টাকায়, রাষ্ট্রের দয়ায় সবাই পড়াশোনা করছে। অতএব আমরা যা বলব, যেভাবে চালাব—সেভাবে চলবে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কন্ট্রিবিউশন যখন বেশি হবে, তখন এই সমস্যার অনেকটাই সমাধান হবে। কারণ শিক্ষার্থী তার মেধাবলে এখানে চান্স পেয়েছে। রাষ্ট্রের কাছে তার পাওনা ও অধিকার হচ্ছে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদেয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা। সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রকেও সে সহায়তা করছে। তবে গরিব, মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় বা রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করার জন্য অর্থনৈতিক সুবিধা থাকতেই হবে। বাকিদের অভিভাবকদের আয়ের ওপর ভিত্তি করে ফি নির্ধারণ করতে হবে। আরেকটি কারণ হচ্ছে, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করার সুযোগ নেই। তারা সরকারি হাসপাতালের মতো খাবার খেয়ে কিভাবে গভীর পড়াশোনা চালাবে, কিভাবে গবেষণা করবে। তাই শিক্ষার্থীর বেতন কিছুটা বাড়ালে তাদের খাবারদাবারের মান উন্নতমানের করা যাবে এবং করতে হবে। এর মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বিশাল ব্যবধান সেটিও কিছুটা মিনিমাইজ করা যাবে। বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চেয়ে ১৯ গুণ বেশি অর্থ খরচ করে। এই ব্যবধান কমিয়ে আনতে হবে। একই ভূখণ্ডে এই দ্বৈত নীতি বিশাল বৈষম্যের সৃষ্টি করে, যা চলতে দেওয়া ঠিক নয়।
দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রয়োজনের তুলনায় বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তবে নির্দিষ্ট কোনো এলাকার জনসংখ্যা অনুপাতে তা নেই। কোথাও বেশি আছে, কোথাও কম আছে। যেমন—দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র তিনজন শিক্ষার্থীও আছে, আবার তিন হাজারও আছে। তাতে বোঝা যাচ্ছে, ইউনিফরমি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত এবং জাতীয়করণ করা হয়নি। প্রাথমিকে শিক্ষার্থী ভর্তির হার প্রায় শতভাগ। ঝরে পড়ার হার কমেছে। বেড়েছে মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ। প্রান্তিক পর্যায়ে কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বেড়েছে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে অংশগ্রহণের হারও। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছড়াছড়ি। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, শিক্ষক প্রশিক্ষণ বলতে সরকারি পর্যায়ে যা শুনছি তা হচ্ছে তারা একমাত্র ‘ব্যাচেলর ইন এডুকেশন’কেই বোঝাচ্ছে। যুক্তিটি একদিকে ঠিক আছে। কিন্তু বিএড প্রশিক্ষণে বিভিন্ন শিক্ষাবিদের কিছু থিওরি পড়ানো বা কিছু কোটেশন মুখস্থ করাটাকেই আমরা সফল প্রশিক্ষণ বলব কি না প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। আর সবার জন্য এই এক বছর মেয়াদি প্রশিক্ষণ নেওয়াটাও কঠিন কাজ। শিক্ষকতায় প্রবেশের আগে যদি এই ডিগ্রি নেওয়া যায় তাহলে ভালো; কিন্তু শিক্ষকতায় প্রবেশ করে দীর্ঘদিন বিদ্যালয় থেকে অনুপস্থিত থাকা মানে বিদ্যালয়ে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে প্রভাব ফেলা। আধুনিক যুগে শিক্ষকদের জানতে হবে দুরন্ত শিক্ষার্থীদের কিভাবে ম্যানেজ করতে হয়, সঠিক বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, আই কন্টাক্ট, পরিবেশ সচেতনতা, ট্রাফিক সচেতনতা, ফিডব্যাকি কেন নিতে হবে, কেন দিতে হবে, কিভাবে নিতে হবে, কিভাবে দিতে হবে, চাইল্ড সাইকোলজি, শিশু শিক্ষার্থী ও টিন এজারদের জানা ও শেখার পদ্ধতি, শারীরিক শাস্তির অপকারিতা, শারীরিক শাস্তি না দিয়ে কিভাবে একটি শ্রেণিকক্ষকে ম্যানেজ করতে হয়, শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন টেকনিকের মাধ্যমে কিভাবে শ্রেণি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করাতে হয় ইত্যাদি প্রশিক্ষণ সব শিক্ষকের থাকতে হবে। এটি মাঝেমধ্যে প্রশিক্ষণকেন্দ্রে গিয়ে স্বল্পকালীন হবে, বাকিটা নিজ নিজ বিদ্যালয়ে পরিচালনা করতে হবে। তাহলেই সহজেই অপ্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনা যাবে এবং বিদ্যালয়ের নিয়মিত ক্লাসও বাধাগ্রস্ত হবে না।
শিক্ষায় বাজেট বাড়িয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত বা জাতীয়করণ করা হলো। শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি সরকারি হলো। তাঁদের অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা চলে এলো, তাঁদের পরিবারে সচ্ছলতা চলে এলো। শিক্ষার মান বাড়াতে এগুলো প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন। তবে শুধু এই ধরনের পদক্ষেপ শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না যদি দক্ষ শিক্ষা প্রশাসন না থাকে, যদি শিক্ষকদের পড়াশোনার মধ্যে না রাখা যায়। দ্বিতীয়ত, বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বিদ্যালয়ে থাকে। তাদের বয়স অনুযায়ী বারবার খাবার খেতে হয়, পুষ্টিকর খাবার খেতে হয়। সেটি তো সরকারি বাজেটের দ্বারা আমাদের অর্থনীতিতে এখনো সম্ভব নয়। তাই প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কিছু উপার্জনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। যেমন নিজস্ব জমিতে কিছু উৎপাদন, শহরাঞ্চলে দোকান বা অন্য কিছু ভাড়ার বিনিময়ে কিছু অর্থ উপার্জন, শিক্ষার্থী ফি বৃদ্ধি ইত্যাদি দ্বারা শিক্ষার্থীদের দুবারের খাবার, চা-নাশতার আয়োজন করা যেতে পারে। তাহলে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারবে। শুধু রাষ্ট্রের বাজেটের দিকে তাকিয়ে থাকলে শিক্ষার্থীদের না খেয়ে ক্লাস করতে হবে, যা সুস্থ পরিবেশে শিক্ষাদানের কথা বলে না। তাই রাষ্ট্রীয় বাজেটের সঙ্গে সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ইনকামও বাড়াতে হবে শিক্ষার সার্বিক কল্যাণের জন্য।
লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক, বর্তমানে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত।