বাংলা বাঁচলে বাঙালি বাঁচবে - দৈনিকশিক্ষা

বাংলা বাঁচলে বাঙালি বাঁচবে

রশীদ হায়দার |

সালটা সম্ভবত ১৯৬৩। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। হলে থাকি। সেই সময় ২১ ফেব্রুয়ারির দিন খুব সকাল বেলা আমার রুমমেট আমাকে ডাকতে শুরু করলেন এবং ডেকে বললেন, আপনি এখনও ঘুমুচ্ছেন। সবাই প্রভাতফেরিতে যাচ্ছে। বাঙালি হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরিতে যাওয়ার কী গুরুত্ব-মাহাত্ম্য সেই বিষয়ে তিনি আমাকে একটা দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে বোঝালেন এবং বললেন যে, আপনি বাংলার ছাত্র হয়েও কেন এখনও ঘুমুচ্ছেন?

এখন মজার ব্যাপারটি হচ্ছে যে, তার গোটা ভাষণটি তথা বক্তব্যই ছিল ইংরেজিতে। এ ঘটনাটি আমার এখনও মনে আছে- এ জন্য যে, আমরা যদি আমাদের মাতৃভাষার সম্মান না করি, মাতৃভাষার গুরুত্ব না দিই, তাহলে কেবল আনুষ্ঠানিকতা দেখিয়ে কী লাভ হবে? ইংরেজি ভাষার বিরুদ্ধে আমার কোনো বক্তব্য নেই। কারণ পৃথিবীর সব ভাষার প্রতি আমার সম্মান আছে। যত ভাষা জানা যায় তত ভালো।কিন্তু যেখানে আমার ভাষা নিয়ে কথা হচ্ছে, আমার ভাষার গুরুত্ব, আমার ভাষার মর্যাদা, মানসম্মান ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা হচ্ছে। তার সমস্তটাই বলছে সে ইংরেজিতে। অথচ সে নিজে একজন বাঙালি এবং যাকে বলা হচ্ছে তিনিও। এই যে ঘটনাটা এখানেই আমাদের স্ববিরোধিতা। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে এসে এই একুশ শতকেও আমরা কি সেই মানসিকতা, স্ববিরোধিতা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি? আমার তা মনে হয় না। এখনও বাংলা ভাষার ব্যবহার, প্রচলন নিয়ে স্ববিরোধিতা প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো রক্ষণশীলতা থাকা উচিত নয়। এটা মেনে নিয়েও বলব ভাষার ক্ষেত্রে সেরকম মর্যাদা দেয়ার ব্যাপারে আমরা এখনও সেই উদারতা দেখাতে পারছি না, তার কারণ দাসত্বমূলক মনোভাব। কেননা শুধু ইংরেজি নয়, একটা নয় পঞ্চাশটা ভাষা জানা থাকাও দোষের নয় বরং গৌরবের। কিন্তু আমার মাতৃভাষাকে আমি কতটা মর্যাদা দিচ্ছি, জীবনে তার ব্যবহারের ক্ষেত্রে সম্মান দিচ্ছি- এ বিষয়গুলো খুবই জরুরি। এক্ষেত্রে আমরা দিন দিন পিছিয়ে পড়ছি, নিজেদের পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছি এবং এ পিছিয়ে নিয়ে যাওয়াটাতে এক ধরনের আনন্দ পাচ্ছি- এটিই হল আমাদের দুর্ভাগ্যের বিষয়।

ভাষা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। বেঁচে থাকার জন্য যেমন আহার, নিদ্রা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় মৌলিক জিনিসগুলো লাগে, তেমনই বেঁচে থাকার জন্য ভাষার সঠিক চর্চা, ব্যবহারটাও খুবই জরুরি। ইতিহাসের দিকে তাকালেই সে সত্য প্রতিভাত হয়। ভাষা আন্দোলনের সূত্রেই তো আমাদের বাংলাদেশ অর্জন। অথচ স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৭ বছরেও আমরা সেই দাসত্বমূলক মনোভাব এবং স্ববিরোধিতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি। বরং তার প্রসার ঘটেছে। আমরা অবশ্যই ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান কিংবা যে কোনো বিদেশি ভাষা শিখব তাতে কোনো দ্বিধা নেই; কিন্তু তা আমার মাতৃভাষাকে বিসর্জন দিয়ে নয়। আর সত্যি কথা বলতে কি- যে নিজের মাতৃভাষাকে ভালোভাবে জানে না, সে অন্য কোনো ভাষাকেও সত্যিকারের অর্থে জানতে বা বুঝতে পারে না। যার মূল নেই সে ছিন্নমূল, মাতৃভাষার মূল শেকড় থেকে যে বিচ্ছিন্ন সে কী করে অন্য ভাষার সঙ্গে সংযুক্ত হবে? এই সত্যি যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের ‘তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ’ বুঝতে না পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত ২১ ফেব্রুয়ারিকেন্দ্রিক আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন হবে না।নিজ নিজ দেশে মাতৃভাষার অধিষ্ঠানের গুরুত্ব উপলব্ধি করে জাতিসংঘ একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনকে গুরুত্ব দিয়ে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা’ দিবসের স্বীকৃতি দিয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত জাতি জানে আমরা বাঙালিরা মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় লড়াই করেছি। আমরা আজ বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষার মর্যাদা দানের দাবি করছি কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রের ভাষা হিসেবেই আমরা বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। বাঙালি জাতির অফিস আদালত চলছে ইংরেজি ভাষায়। আমাদের এ চেতনার দাসত্ব, এ স্ববিরোধী অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মাতৃভাষা চর্চা যে শুধু মাতৃভাষা চর্চা নয়, যথাযথভাবে বিশ্ব ভাষারও চর্চা- সেটা সত্যিকারভাবে উপলব্ধি করে মাতৃভাষার প্রতি সমস্ত উপেক্ষা দূর করতে হবে। আমরা যদি সত্যিকার অর্থে বাঁচতে চাই, বাঁচাতে হবে বাংলা ভাষাকে।

সূত্র: যুগান্তর

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0037820339202881