বিদেশমুখিতা ও মালেক ড্রাইভার! - দৈনিকশিক্ষা

বিদেশমুখিতা ও মালেক ড্রাইভার!

আহসান কবির |

ঘুষ আমার ধর্ম,ঘুষ আমার কর্ম, ঘুষ নিতে কী সংশয়? 

প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া এইদেশে অপরাধ ঘুষ খাওয়া কখনোই নয়!
                                                                         ..............গায়ক নচিকেতার জনপ্রিয় গান

ইংল্যান্ডের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে চারদেশের চারজন পিএইচডি করতে এসেছেন। তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। চারজনের একজন অ্যামেরিকান, একজন রাশিয়ান, একজন জাপানী আর অন্যজন বাংলাদেশি।তারা নিছক হাসি ঠাট্টা আর কৌতুক করছেন। যেমন-

অ্যামেরিকানঃ গতকাল আমার বউকে এমন আদর দিয়েছি যে আজ সকালের নাস্তায় আমাকে হেভি ট্রিট দিয়েছে। এমন নাস্তা একজনমে খাইনি!

রাশিয়ানঃ মিললো কী করে? আমার বউকে গতকাল এমন আদর দিয়েছি যে সকালে আমাকে ইটালিয়ান পিজা বানিয়ে খাইয়েছে।

জাপানীঃ হায় হায় আদরের ঠেলায় আমার বউতো আজ আমার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসতে চেয়েছিল। ভাগ্যিস আনি নি। তাহলে এখানেও সে ঐ আদর চাইতো। 

তিনজনের কথা শুনে বাংলাদেশী চুপ করে ছিল।তার কাছে অ্যামেরিকান আর জাপানী জানতে চাইলো তোমার কী খবর? বাংলাদেশী দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিলেন:-

“তোরা তো নিজ খরচায় বউদের নিয়ে এখানে এসেছিস। দেশে গিয়ে আমি সরকারি চাকরিতে ফেরত যাবার পর ‘বিয়ে পরবর্তী আদর সোহাগ’ নিয়ে একটি প্রকল্পের খসড়া তৈরি করবো। তারপর এই বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য সরকারি টাকায় কর্মকর্তা ও তাদের বউদের বিদেশ ভ্রমণের ব্যবস্থা করবো। আমার মতো সরকারি কোনো কর্মচারি যেন আর বউয়ের আদর সোহাগবিহীন এমন ‘নাস্তাহীনতায়’ না ভোগে! 

সরকারি কর্মচারিরা মাটির মানুষ। তাদেকে এমন বউয়ের আদর সোহাগবিহীন ‘নাস্তাহীনতায়’রাখা ঠিক না। সে কারণে তারা নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে হাজির হন। যদিও সঙ্গীত শিল্পী নচিকেতা সরকারি কর্মচারিদের নিয়ে কেমন যেন একটা গান বেধেছেন। গানের কথা এমন-
‘ঘুষ আমার ধর্ম,ঘুষ আমার কর্ম ঘুষ নিতে কী সংশয়? 

প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া এইদেশে অপরাধ ঘুষ খাওয়া কখনোই নয়। 

তাই কারো ফাইল পাস করে নিলর্জ্জের মতো 
হাতখানা বাড়িয়ে দিতে পারি! 
আমি সরকারি কর্মচারি!’

নচিকেতা যতোই উল্টাপাল্টা গান করেন না কেন তিনি কিন্তু সরকারি কর্মচারিদের নিত্যনতুন  প্রকল্পের আইডিয়া ও সরকারি টাকায় বিদেশ ভ্রমনের কথা বলেননি। হয়তো তিনি বাংলাদেশে থাকেন না বলে এদেশের সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারিদের কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিদেশ ভ্রমনের ব্যাপারটা জানেন  না। কোন কোন প্রকল্পের নামে কেমন কেমন করে বিদেশে যাওয়া যায়, সরকারের কোটি টাকার শ্রাদ্ধ করা যায় তার একটা নমুনা তুলে ধরা যেতে পারে।

উল্লেখ্য, এসব নেয়া হয়েছে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা ও টেলিভিশনের খবর থেকে-

এক. দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের তিনদিন খিচুড়ি ও তিনদিন বিস্কুট (মিড ডে মিল) দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার যা বাস্তবায়িত হবার কথা ২০২১ এর জানুয়ারিতে! প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এজন্য ৫০০ কর্মকর্তাকে বিদেশে পাঠানোর প্রস্তাব করেছে। ১৯ হাজার ২৮২ কোটি টাকার এই প্রকল্পে ১৫ কোটি টাকা খরচ হবে খিচুড়ি রান্না শিখতে যাওয়া ৫০০ কর্মকর্তার জন্য। যদিও  বিতর্ক সৃষ্টি হওয়া  এই প্রকল্পের কতোটা শেষমেষ বাস্তবায়িত হয় তা এখনই বলা যাচ্ছে না!

দুই. মিরপুরে সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসনের জন্য  বেশ কয়েকটি ভবন নির্মানের কাজ যখন প্রায় শেষ তখন গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পাঁচ কর্মকর্তা যান থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে নির্মাণ কাজ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা নিতে! যদিও গণপূর্তের অনেক ভবন নির্মাণের অভিজ্ঞতা আছে। এই কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা গণপূর্তের কী কাজে লেগেছে জানা যায় নি! এই ঘটনা ২০১৯ এর।

তিন. বিদ্যুৎ ,জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠক শেষে জানা যায় মন্ত্রণালয়ের টাকায় ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ এ প্রায় তিন হাজার কর্মকর্তা বিদেশ ভ্রমন করেন এবং এই খাতে খরচ হয় ৫০ কোটি টাকা! গড়ে তিনজন কর্মকর্তা সব সময় বিদেশ থাকেন বলে জানা যায়!

চার.লিফট কেনা ও মেরামতের জন্যও কর্মকর্তাদের বিদেশ যাবার রেকর্ড আছে। পুকুর খনন, আলু কেনা এমনকি সূচারুরূপে হাত ধোয়া শিখতে দুই কোটি টাকা খরচ করে বিদেশ যাবার ঘটনা খবর হয়ে এসেছে। মধুচাষ শিখতেও বিদেশ গেছেন কর্মকর্তারা! একটা বিমান বুঝে আনতে ৪৫জন কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করে রেকর্ড তৈরি করেছেন!

বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিরা যত বেশি অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন তত বেশি তারা এই অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করতে পারবেন জনগনের ওপর। জনগনের মঙ্গলের জন্য এবং বিদেশে আরও উন্নততর প্রশিক্ষণের জন্য আর কী কী পরিকল্পনা নিতে পারেন সরকারি কর্মকর্তারা?

এক.

সরকারি কর্মকর্তারা কোভিদ-১৯ বা করোনা দেখা ও প্রতিকারের অভিজ্ঞতা নিতে চীন বা রাশিয়া,ইতালি বা ব্রাজিলে যেতে পারেন। শোনা যায় এমন একটা পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল কিন্তু সরকারি কোন কর্মকর্তা যেতে রাজি হননি।

দুই.

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালকের ড্রাইভার (অনুপ্রেরণার আরেক নাম মালেক ড্রাইভার) কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন,তার একাধিক বহুতল ভবন ও বিলাসবহুল গাড়ি থাকার খবর পাওয়া গেছে। ড্রাইভারদের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন,সম্পদ আহরন,জ্যামের ভেতর মাথা ঠান্ডা রেখে গাড়ি চালানো এসব শিখতে কর্মকর্তারা বিদেশ যেতে পারেন। 

তিন.

বাল্যবিবাহ বন্ধ করার খবর আসে পত্রিকা ও টেলিভিশনে। বাল্যবিবাহ দেখতে এবং শিখতেও আফ্রিকার কয়েকটি দেশে যেতে পারেন সরকারি কর্মকর্তারা।

চার.

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে এমন একটা পরিকল্পনা এমন-মৃত্যু পরবর্তী জীবনযাপন ও উন্নয়ন কার্যক্রমের প্রশিক্ষণ নিতে সরকারি কর্মকর্তাদের কোথায় পাঠানো যায়?

পরিকল্পনা বা আইডিয়াই আসল। এযুগে নাকি আইডিয়া বিক্রি করে কোটি টাকা কামানো যায়। সুতরাং গরু পালন ও প্রজনন,মৌমাছির প্রজনন,পুকুর খণন ও মাছ চাষ,গোবরের রূপান্তর (গোবর খেয়ে নাকি প্রায়শ্চিত্ত করা যায়। গোবর দিয়ে সার হয়। গোবর জ্বালানীর কাজে লাগে। এমন কী গোবর, মগজের পরিবর্তে মাথায় থাকলেও সেটা নাকি বেশ কাজে দেয়!) এসব শিখতে প্রকল্পের টাকায় সরকারি কর্মকর্তারা বিদেশে গিয়ে ‘বিলাসী ভ্রমণ ও প্রয়োজনীয় জ্ঞান আহরণ’ করে আসতে পারেন। লেখাটা শুরু হয়েছিল গল্প দিয়ে। শেষও করা যায় গল্প দিয়ে। এই দেশে গল্পের শেষ নেই!

এক.

এদেশের মানুষ কেন যেন অনেক আগে থেকেই বিদেশমুখী! তাই শেক্সপীয়রের লেখা পড়ে। বিদেশি ছবি (আগে সিনেমা হলে এক টিকেটে দুই ইংরেজী ছবি দেখা যেত। এখন যায় কিনা জানি না!) দেখে। বিদেশী কাপড় কিংবা পারফিউম কেনে। এমন কী সফল ও ধনবান মানুষের ক্ষেত্রেও বিদেশমুখীতা আছে। যেমন আলিবাবা খ্যাত জ্যাক মা কিংবা কেএফসির কর্নেল স্যান্ডার্স এর জীবনী খোঁজে এদেশের মানুষ। কিন্তু দেশের সফল ও ধনবান.দানশীল ও ধার্মিক মানুষ মালেক ড্রাইভারকে চেনেনি! কতোটা পরিশ্রমী হলে ড্রাইভার হয়েও ১০ তলার একটি, ৭ তলার তিনটি ও বিভিন্ন জায়গায় ২৪ টি ফ্ল্যাটের মালিক হতে পারেন? সাফল্য, অনুপ্রেরণার আরেক নাম মালেক ড্রাইভার!

দুই.

পড়া ও লেখার ক্ষেত্রেও বিদেশমুখীতা আছে। এদেশের ধনবান মানুষদের ছেলে-মেয়েরা পড়তে যায় অ্যামেরিকা, ইংল্যান্ড, অষ্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া বা ভারত। লেখার ক্ষেত্রেও বিদেশমুখীতা আছে। যেমন-অনুবাদ সাহিত্য এবং কৌতুক।

এমন একটি অনুবাদ কৌতুক-   এক ভদ্রমহিলা গেছেন পীর সাহেবের কাছে। একঘন্টা ধরে তিনি কাঁদলেন পীর সাহেবের সামনে আর বকবক করে বললেন তার স্বামী তার ওপর অত্যাচার করে। ভদ্রমহিলা আর সইতে পারছেন না! পীর সাহেব তার জন্য তাবিজ এনে বললেন-এই তাবিজ হাতে বাধা যাবে না, গলায়ও পরা যাবে না। দাত দিয়ে চেপে ধরে রাখতে হবে। 

দশদিন পরে মিষ্টি ও ফুল নিয়ে পীর সাহেবের কাছে এলেন ভদ্রমহিলা। বললেন-পীর সাহেব আপনার তাবিজের কেরামতিতে আমার স্বামী ভালো হয়ে গেছে। সে এই দশদিন আমার গায়ে একবারও হাত তোলে নি, জোর গলায় কথা বলে নি। পীর সাহেব উত্তর দিলেন-এটা আমার তাবিজের কেরামতি না। আপনার মুখ বন্ধ রাখার ফল! আপনাকে বুঝতে হবে সুখের আরেক নাম প্রয়োজনে মুখবন্ধ করে নীরব থাকা।

নীরবতা সবসময় কাম্য নয়! আবার প্রয়োজনের সময় মুখবন্ধ রাখাও নাকি ঠিক না!

আহসান কবির: লেখক, সাংবাদিক ও অভিনেতা। 

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0073769092559814