বাংলাদেশের মাটিতে অবৈধভাবে পরিচালিত হওয়া বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস অনুমোদন পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। বছরের পর বছর শিক্ষার্থী ভতি করিয়ে কোটি কোটি টাকা রোজগার করছে প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু ভিআইপি শিক্ষার্থীদের সনদ দিতে না পারায় সমূহ ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন তারা। এরপরই অনুমোদন আদায় করতে মরিয়া হয়েছেন তারা। আর এসব কথিত বিদেশী প্রতিষ্ঠানের দেশী ডিলার বা কমিশন এজেন্টদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা।
শাখা ক্যাম্পাস নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি থাকা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নিজেদের পকেটের কোটি কোটি টাকা খরচ করে কমিশনের কতিপয় কর্মকর্তাকে বিদেশ সফর করিয়ে আনা, বিদেশে থাকা তাদের মূল ক্যাম্পাস পরিদর্শনশেষে প্রতিবেদন তৈরি করে দেয়াসহ নানা কাজ করানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিদেশের মাটিতে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এ ধরণের কাজে অগ্রনী ভূমিকা পালন করছে ধানমন্ডির বিএসি নামের একটি প্রতিষ্ঠানসহ চারটি শাখার দেশীয় ডিলার বা এজেন্টরা। এ চারটি প্রতিষ্ঠান অনুমোদন দেয়ার জন্য ৭ মাসের বেশি সময় ধরে ইউজিসির কতিপয় কর্মকর্তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে তাগিদ দিয়ে আসছেন।
সর্বশেষ ১৫ নভেম্বর এক চিঠিতে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অনুমোদন না দিলে মন্ত্রণালয়কে আদালত অবমাননার দায়ে মামলার মুখে পড়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। এ ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত ইউজিসির সঙ্গে মন্ত্রণালয়েরই টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। এ ধরনের চিঠি দেয়ায় মন্ত্রণালয় ইউজিসির সংশ্লিষ্ট উপপরিচালককে শোকজ করতে যাচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সাংবাদিকদের বলেন, বিশ্বের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যানারে এদেশে একাধিক শাখা ক্যাম্পাস খোলার আবেদন পাওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রে মূল কর্তৃপক্ষের কাউকে পাওয়া যায়নি। বিপরীত দিকে দেশী অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। আগে সেসব ভালো করুক। এরপর প্রয়োজন হলে অন্যদের (বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা) অনুমোদনের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। এটাই সরকারি চিন্তাভাবনা।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস খোলার জন্য ইউজিসির কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার অতি উৎসাহী হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে লাখ লাখ টাকার ঘুষবাণিজ্য ও বিদেশ সফর। যে কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কয়েকদফা ‘আপাতত বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা অনুমোদন না দেয়া’র সরকারি সিদ্ধান্ত জানায় ইউজিসিকে। এরপরও সংস্থাটি বারবার তাগিদ পাঠাচ্ছে মন্ত্রণালয়ে। ইউজিসির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস খোলায় সায় না দেয়ায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হেলালউদ্দিনেরও স্মরণাপন্ন হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হেলালউদ্দিন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেছেন, ইউজিসিকে যেহেতু একাধিকবার জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, আপাতত বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের অনুমোদন সরকার দেবে না। তাই ফের মামলার রেফারেন্স দেয়ার মাধ্যমে তাদের (ইউজিসি) চিঠি দেয়ার বিষয়টির সরকারের পলিসির বাইরে চলে গেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে তারা এমন কাজ করতে পারে না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসি সূত্র জানিয়েছে, সর্বশেষ ১৫ নভেম্বর ইউজিসির একজন উপ-পরিচালক স্বাক্ষরিত একটি পত্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তাতে বলা হয়, মোনাস কলেজ প্রাইভেট লিমিটেড অস্ট্রেলিয়ার স্টাডি সেন্টার স্থাপনের আবেদন যাচাই-বাছাই করে একটি প্রতিবেদন (১১ ফেব্রুয়ারি) ইউজিসি থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। উক্ত পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে (২৭ মার্চ) শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইউজিসিকে জানিয়েছে, বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার খোলার বিষয়টি স্থগিত রাখা সমীচীন হবে। ইউজিসির এ পত্রে একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের দেয়া নির্দেশনার রেফারেন্স দিয়ে বলা হয়, কোর্টের নির্দেশে ২০১৪ সালে দেশে শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার স্থাপন বা পরিচালনা বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়। এ বিধিমালা অনুযায়ীই শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার স্থাপনের জন্য ফি জমা নিয়ে ১৫টি আবেদন কমিশন গ্রহণ করেছে। আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কমিশনকে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বারবার তাগিদ দিচ্ছে। এমতাবস্থায় যেসব আবেদন কমিশনে পাওয়া গেছে তাদের সবার ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উক্ত সিদ্ধান্ত প্রযোজ্য হবে কিনা, সে বিষয়ে নির্দেশনা প্রয়োজন। যেহেতু উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত বিধি জারি হয়েছে, সেহেতু সবার ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উক্ত নির্দেশনা প্রয়োগ করা হলে আদালত অবমাননা হবে কিনা সে বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অবহিত করার জন্য অনুরোধ করা হল। জানা গেছে, এর আগেও ইউজিসির এ কর্মকর্তা একই প্রসঙ্গে একাধিক চিঠি দেন মন্ত্রণালয়ে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, উদ্যোক্তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতবছরের ২৮ সেপ্টেম্বর ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নানের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি টিম অস্ট্রেলিয়া শিক্ষাসফর করে। ওই সময় তারা অস্ট্রেলিয়ার মোনাস ইউনিভার্সিটি ও মোনাস কলেজ প্রাইভেট লিমিটেড পরিদর্শন করেন। শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টারের অনুমোদনের ব্যাপারে মন্ত্রণালয় থেকে বারবার ‘না’ বলার পরও ইউজিসি থেকে তাগিদ দেয়া হচ্ছে। ১৫ নভেম্বর ইউজিসির পাঠানো চিঠির জবাব সোমবার মন্ত্রণালয় দিয়েছে। তাতে পুনরায় বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা বা স্টাডি সেন্টারের অনুমোদন না দেয়ার ব্যাপারে সরকারি কৌশলের কথা পুনরায় ইউজিসিকে জানিয়ে দেয়া হয়।
ইউজিসির অপর এক সূত্র জানায়, কমিশনের চারজন কর্মকর্তার নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে লিপ্ত। একজন সাবেক চেয়ারম্যান আজাদ চৌধুরী জমানায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঘুষ নিয়ে ধরা পড়েন। তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। তাকে সরিয়ে দেয়া হয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শাখায়। ২০০১ খ্রিস্টাব্দে ইউজিসিতে চাকরি নেয়ার আগে শেয়ার বাজারের প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। তিনি এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শাখায়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা থেকে বিতারিত হওয়ার দু:খ ভুলতে না পারায় তিনি অন্যদের দোষ খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
অপরদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার দুইজন অফিসার নিজেদের পদ টিকিয়ে রাখতে মরিয়া। সম্ভাব্য প্রতিযোগীদের বিরুদ্ধে বিযোদগার করেন তারা। যোগাযোগ রাখেন জামাতপন্থী গণমাধ্যমের সঙ্গে।
জানা যায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখায় বদলি হতে চান ইউজিসির প্রায় সব কর্মকর্তা।
অনুমোদন পাওয়ার আগেই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে কীভাবে শিক্ষার্থী ভতি করাচ্ছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ধানমন্ডির বিএসি’র একজন কর্মকর্তা বলেন, অনুমোদন পেয়ে যাবেন শিগগিরই। তাছাড়া মন্ত্রণালয় যে বিধিমালা তৈরি করেছেন তার আলোকেই প্রতিষ্ঠান চালানো যায় বলে দাবী করেন তিনি।