বেসরকারি শিক্ষকের হালখাতা মহরত - দৈনিকশিক্ষা

বেসরকারি শিক্ষকের হালখাতা মহরত

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

আজ রোববার। পহেলা বৈশাখ। বাংলা  ১৪২৬ বঙ্গাব্দ। দিনটি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের চিরন্তন ভালবাসার দিন। আনন্দে আত্মহারা হবার দিন। বাঙালি জাতির চিরায়ত সার্বজনীন উৎসবের দিন। জাতি,ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছে দিনটির ভিন্ন  আমেজ। জাতিসত্তা ও জাতীয়তাবাদের চেতনায় নতুন করে উজ্জীবিত হবার দিন। বাঙালিয়ানার মৌল আনন্দে ভেসে যাবার মাহেন্দ্রক্ষণ। পহেলা বৈশাখে রবীন্দ্রনাথের প্রিয় গানটি সব বাঙালির হৃদয়ের গান হয়ে ওঠে-'এসো, এসো,এসো হে বৈশাখ'। আপন স্বকীয়তায় নিজেদের আলাদা করে দেখার দিন এটি। শেঁকড়ের সন্ধানে এদিন বাঙালি অনুসন্ধিৎসু হয়। ফিরে যায় নিজের ঠিকানায়। ছুটে চলে অস্তিত্বের কাছাকাছি। আনন্দে নেচে ওঠে পুরো দেশ।

আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির জোয়ারে হেরে যায় সব অপসংস্কৃতি আর ভিন দেশী কালচার। বাঙালি ওয়ে ওঠে ষোলআনা খাঁটি বাঙালি। প্রতিটি আঙিনায় নেচে যায় বাঙালি মানসের আলপনা। অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠানে মেতে ওঠে দেশ। সাজ সজ্জায় ফুটে ওঠে বাংলা ও বাঙালির চিরায়ত রুপ। যে রুপে পাগল শত শত কবি সাহিত্যিক। রাখালের বাঁশি আর কৃষকের গানে প্রতিফলিত হয়  উৎসবের আমেজ। পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের আলাদা মাহাত্ম্য। স্বাধীনতা অর্জনে জাতীয়তাবাদের চেতনা দৃঢ় করতে এর অনুদান ও অবদান খাটো করে দেখার নয়।

জাতীয়তাবাদের চেতনা জাগ্রত করে জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হবার দীক্ষা এ দিনের কাছে পাই। হিন্দু,মুসলিম,বৌদ্ধ, খ্রিস্টান-সব ধর্ম বর্ণের মানুষকে এক অদৃশ্য সুতায় বেঁধে রেখেছে নববর্ষের সংস্কৃতি।   আজ বাঙালির ঐতিহ্যের খাবার পান্তা ভাতের সাথে ইলিশ এখন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ইলিশের দুর্মুল্যের কারণে পহেলা বৈশাখের ঐতিহ্যে চিড় ধরেছে। সেই সাথে নিজের অস্তিত্বকে দিনে দিনে হারাতে বসেছি আমরা। বাংলা সনের দিন,মাস ও বছরের হিসেব ক'জনে রাখে ? বাংলা তারিখ অনেকেই বলতে পারেনা। এক রত্তি শিশু থেকে শুরু করে সবাই ইংরেজি তারিখ বলে দিতে পারে।

বাংলা সনের কোন মাসটি কখন আসছে আর যাচ্ছে সে হিসেব অনেকেই রাখেনা। এরা যতই পহেলা বৈশাখ উদযাপন করুক তাতে কী ? আমাদের স্বভাবটা হয়েছে এমন- কোন কিছু সামনে এলে বন্ধনায় মেতে উঠি। চলে গেলে খবর নেই। এই যেমন-পহেলা বৈশাখে কত মাতামাতি। কত আনন্দ। কত ফুর্তি । এরপর আর খবর থাকেনা। সপ্তাহ দিন গত হলে বৈশাখ মাসের কত তারিখ যাচ্ছে সেও ভুলে যাই। ঠিক মনে নেই, এরশাদ সাহেবের না কার আমলে যেন ইংরেজি তারিখের সাথে বাংলা তারিখ লেখার একটা আইন করে দেয়া হয়েছিল। সে কারণে সরকারি চিঠিগুলোতে ইংরেজি তারিখের নীচে বাংলা তারিখ লিখিত দেখা যায়। আমার মনে হয় এই আইনটি করে দিলে ভাল হত যে, সব কিছুতে আগে বাংলা তারিখ এবং এর নীচে বা পাশে ইংরেজি তারিখ লিখতে হবে। তাতে করে বাংলা ভাষা ও সনের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানো যেত। এছাড়া পহেলা বৈশাখ নিয়ে যা যতই করিনা কেন, এক সময় বাংলা সনকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়বে। অন্ততঃ এমন একটি আশংকা থেকেই যায়।         

পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষটি কী করে আমাদের হলো ? কখন থেকে এর সুত্রপাত ? কে এর সুচনা করেছিল ? যতটুকু জানা যায়,মোঘল সম্রাট আকবর কৃষি কাজের সুবিধার্থে ১৫৮৪ খৃস্টাব্দে বাংলা সন চালু করেন। তার সিংহাসনে আরোহনের তারিখ ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৫ নভেম্বর থেকে তা কার্যকর করা হয়। হিজরী চান্দ্রসন ও বাংলা সৌর সনকে ভিত্তি করে বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। এটি প্রথমে 'ফসলি সন' নামে পরিচিতি পায়। পরে তা 'বঙ্গাব্দ' নামে খ্যাতি লাভ করে।         

নববর্ষের নানা আনুষ্ঠানিকতা বাঙালি সংস্কৃতির অংশ। হালখাতা  পহেলা বৈশাখের অনুষঙ্গ। বঙ্গাব্দ বা বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকান পাটের হিসেব নিকেশ আনুষ্ঠানিক ভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়ার নাম হালখাতা। এদিনে ব্যবসায়ীরা দেনা পাওনার হিসাব সমন্বয় করে নতুন খাতা খোলেন। তারা নানান রঙের কাগজে দোকান ঘর সাজিয়ে তোলেন। সারা দিন ধরে যারা দোকানে আসে তাদের মাঝে মিঠাই মিষ্টি বিতরণ করেন। দিনটিকে ছোটবেলা থেকে 'সাল তামামির দিন' বলে শুনে আসছি। 

ছর শেষে দেনা পাওনার হিসেব নিকেশ মিলিয়ে নেবার দিন। বাকীতে যারা সওদা কিনে খায় সাল তামামিতে তাদের বকেয়া পরিশোধ করে দিতে হয়। ধার দেনা করেও এদিনে দোকানদারের পাওনা মিটিয়ে দেয়া লাগে। নিজেকে দায়মুক্ত ও ভারমুক্ত করতে হয় । পহেলা বৈশাখের আগে নববর্ষের চিঠি যায় দেনাদারের কাছে। সালতামামির চিঠি। চিঠির উল্টো পিঠে মোট বকেয়া টাকার হিসেবের একটি ঈঙ্গিত থাকে। এ থেকে দেনা টাকা সংগ্রহ করে  দোকানীর হাতে দিয়ে আসে। দোকানী মিঠাই-মিষ্টি খেতে দেয়। সারা দোকান জুড়ে মিষ্টির ঘ্রাণ। দোকানীর হৃদয় জুড়ে সেদিন অন্য এক আনন্দ বিরাজ করে। সে আনন্দটি অনুভবে ধারণ করা যায় কিন্তু পাল্লা-পাথরে ওজন করে পরিমাপ করা যায়না। রং বেরংয়ের কাগজ আর ফুলে সাজানো হয় দোকান। তবে নিজেদের স্বার্থে সব দোকানদার একই দিনে সালতামামি করেনা। একেকজন একেক দিন হালখাতা মহরত করে থাকে। প্রায় সারা বৈশাখ মাস আবার কোথাও কোথাও বৈশাখের সপ্তাহ দশদিন আগে থেকে ব্যবসায়ীদের হালখাতা মহরত শুরু হয়ে যায়।

যেদিন হালখাতা মহরত হয় সেদিন দোকানীর গদিতে কেবলি আনন্দ আছড়ে পড়ে। পাওনাদার পাওয়ার আর দেনাদার দিতে পারার  আনন্দে মেতে ওঠে। শুধু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নয়। সারা দেশ জুড়ে বৈশাখের নানা আয়োজন চলে। কোথাও কোথাও বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়। পুরো বৈশাখ মাস জুড়ে মেলা থাকে। মেলায় উৎসবের আমেজ। এ আমেজে অবগাহন করে নারী পুরুষ নির্বিশেষে জোয়ান বুড়ো সবাই। উৎসবের আবরণে ছেয়ে যায় সারা দেশ।                                           

ঠিক সেরকম এবারের নববর্ষটি বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীর জন্য জনমের সেরা নববর্ষ হতে পারতো। তারপরও এবারের বৈশাখে তাদের অন্য এক আনন্দ আছে। এবার তারা বৈশাখি ভাতার দাবিদার হয়েছেন। এখন তারা বৈশাখি ভাতার মালিক। ভাতাটি পহেলা বৈশাখের আগে তাদের হাত পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারলে তারা পুরো আনন্দটি পেতে পারতেন। সেটি করার জন্য মনে হয় কেউ উদ্যোগ নেয়নি। উল্টো তারা যাতে এটি সময়মত না পায় সে জন্য হয়ত কেউ তৎপর ছিল।  সেটি খতিয়ে দেখা দরকার।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনার বদৌলতে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীগণ যে বৈশাখি ভাতাটি প্রাপ্য হলেন সেটি ঠিক সময়ে হাতে না পৌঁছানোর দায়টি কার ? এতে পহেলা বৈশাখ তথা নববর্ষের আনন্দটি মাটি হয়েছে।  দৈনিক শিক্ষা আমাদের একটি তথ্য দিয়েছে। দৈনিকশিক্ষার প্রতিবেদন প্রকাশিত কর্মকর্তারা যদি দায়ী হন তবে নিন্দা জানাই। প্রথম যখন বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীগণ ঈদ বোনাস প্রাপ্য হয়েছিলেন সেটিও ঈদের পরে তাদের হাতে আসত। বৈশাখি ভাতার বেলায় সে পুরনো কারবারটি আবার শুরু হয়ে গেছে। জানিনে, আরো ক'টি বৈশাখে পহেলা বৈশাখের পরে বৈশাখি ভাতার টাকা বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের হস্তগত হবে ? কবে থেকে সেটি তারা পহেলা বৈশাখের আগে হাতে পাবেন ? বৈশাখি ভাতাটি সকল এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী এবারও পাবেন বটে।

কিন্তু সময় মত হাতে না পাবার বেদনাটি সত্যি বড় কষ্টের। যারা তাদের বিভিন্ন সময়ে এরুপ কষ্ট দিয়ে আসছে তারা শিক্ষা ও শিক্ষক বান্ধব নয়। এদের দিয়ে শিক্ষকদের কোন উপকার হয়না। এরা শিক্ষকের মর্যাদা দিতে জানেনা। শিক্ষকদের বঞ্চিত করে রাখায় তাদের যত আনন্দ। এরা গুণীজনের কদর করা জানেনা। এখন থেকে বেসরকারি শিক্ষকদের পাওয়া-না পাওয়ার হিসেবের মহরত শুরু হোক। এবারের বৈশাখটি  বেসরকারি শিক্ষকদের হালখাতা মহরতের বৈশাখ হোক। প্রাপ্তির হিসেবে যোগ হোক পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট ও বৈশাখি ভাতা।

বাকির খাতায় লেখা থাক পুর্ণাঙ্গ বোনাস আর বাড়ি ভাড়ার কথা। চিকিৎসা ভাতার বেলায়ও বৈষম্যটি মেনে নেয়া যায়না। রোগবালাই কখনো সরকারি-বেসরকারি মানেনা। এখন কেবল জাতীয়করণ সব সমস্যার সমাধান এনে দিতে পারে। আরেক বৈশাখের আগে সব দেনা চুকিয়ে দিতে হবে। শুভ হালখাতা মহরত। শুভ বাংলা নববর্ষ। সবার জন্যে শুভ কামনা। পুরো বছরটি সবার জন্যে আনন্দের নতুন বার্তা বয়ে নিয়ে আসুক। বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের ইনক্রিমেন্ট ও বৈশাখি ভাতা প্রাপ্তির আনন্দ একাকার হউক জাতীয়করণের অনাবিল আনন্দে। আনন্দের বন্যায় ডুবে যাক আরেক বৈশাখ। আরেক বৈশাখের আগে বাড়ি ভাড়া, উৎসব ভাতা চিকিৎসা ভাতা তথা জাতীয়করণের সব লেনাদেনা চুকিয়ে দিতে হবে। জয়তু বাংলা নববর্ষ। জয়তু পহেলা বৈশাখ।                                      

লেখক  :  অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.012665033340454