দেশের শিক্ষাখাতে অনিয়ম, দুর্নীতি আর ঘুষ বাণিজ্য চরম আকার ধারণ করেছে। সরকারি ও প্রকল্পের টাকা লুটপাটের ক্ষেত্রে এ সেক্টর সব দফতরকে ছাড়িয়ে গেছে। থানা শিক্ষা অফিস থেকে শুরু করে আঞ্চলিক শিক্ষা অফিস, শিক্ষা ভবন এমনকি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিভাগে রয়েছে ঘুষের প্রভাব। স্কুলে ছাত্র ভর্তি, শিক্ষক নিয়োগ, বদলি, পদায়ন, শিক্ষকের এমপিওভুক্তি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদন, জাতীয়করণসহ অবসরে যাওয়া শিক্ষকদের পেনশনের টাকা তুলতে ঘুষ দিতে হয়।
রোববার (১০ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে এসব তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন সাঈদুর রহমান রিমন ।
এ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ, মেরামত, আসবাবপত্র ও শিক্ষা সরঞ্জাম কেনাকাটা ও সরবরাহের প্রতিটি ধাপেই চলে সীমাহীন চাঁদাবাজি। শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগে চলে সরকারি অর্থের যথেচ্ছ অপচয় আর লুটপাট। চলতি অর্থবছরের বাজেটে (২০১৮-১৯) শিক্ষা খাতে ৫২ হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ এ বরাদ্দের অর্ধেকের বেশি ব্যয় হচ্ছে অবকাঠামো উন্নয়নে। ফলে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরে অনিয়ম-দুর্নীতিও বেড়েছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরে ঘুষ ছাড়া কিছুই হয় না। নানা নামে ঘুষ নেন কর্মকর্তারা। এমপিওভুক্তি, পদোন্নতি, টাইম স্কেল- সব এখান থেকেই হয় বলে পদে পদে হয়রানির শিকার হন প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষকরা। রাজধানীসহ বড় শহরগুলোয় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল কিংবা কিন্ডার গার্টেনের অনুমতি নিতে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিতে হয়। হাইস্কুল ও কলেজের ক্ষেত্রে এই ঘুষের পরিমাণ সর্বনিম্ন দুই লাখ টাকা।
কোনো কারণে প্রতিষ্ঠান বা নির্দিষ্ট শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে অনুদান বা বেতন বন্ধ হয়ে গেলে তা পুনরায় চালু করতে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। পেনশনের কাগজপত্র প্রক্রিয়ায় ঘুষ লাগে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণের উদ্যোগ নিতে চাইলে কমবেশি ২০ ধাপে ঘুষ দিতে হয়। প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ‘ইতিবাচক পরিদর্শন রিপোর্ট’ করিয়ে নিতে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দেওয়া এখন অলিখিত বিধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমপিওভুক্তির কাজে একজন শিক্ষক বা কর্মচারীকে ন্যূনতম ২০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়।
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে এমপিওভুক্তির কাজ মাঠ প্রশাসনে ছেড়ে দেওয়ার পর এই ঘুষ বাণিজ্য আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ফলে শিক্ষকদের হয়রানির মাত্রাও বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। এ ছাড়া নাম, বয়সসহ নানা বিষয় সংশোধন, টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পেতে উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে ফাইল পাঠাতে ঘুষ দিতে হয় ৮-১০ হাজার টাকা। জেলা শিক্ষা অফিসে দিতে হয় ৫-৭ হাজার টাকা। শিক্ষাখাতের এসব দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্টদের ৩৯ দফা সুপারিশসহ সতর্ক বার্তা দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এসব সুপারিশে প্রশ্নপত্র ফাঁস, নোট বা গাইড বই বন্ধ, কোচিং বাণিজ্য রোধ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণ, এমপিওভুক্তি, নিয়োগ ও বদলিসহ বিভিন্ন দুর্নীতির উৎস এবং তা বন্ধের জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি প্রতিরোধে গঠিত ‘শিক্ষা সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক টিম’-এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এ সুপারিশমালা সংযুক্ত করা হয়েছে।
২০ সিন্ডিকেটে দাপুটে ২০০ জন: শিক্ষা খাতের শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর, পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর এবং এসব সংস্থাভুক্ত ১৩টি প্রতিষ্ঠানের সর্বত্র ঘুষ বাণিজ্য নিশ্চিত করতে শিক্ষা ভবন থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত গড়ে উঠেছে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। প্রভাবশালী কর্মকর্তা বা কর্মচারী নেতার নেতৃত্বে গড়ে তোলা ২০টি লুটেরা সিন্ডিকেটের আওতায় দুই শতাধিক দাপুটে ব্যক্তি দেশজুড়ে দাপিয়ে বেড়ায়।