শিক্ষার মানের অধোগামিতা - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষার মানের অধোগামিতা

গোলাম কবির |

সম্প্রতি বাংলাদেশের দুটি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় বিদেশি পর্যবেক্ষকদের নেতিবাচক মূল্যায়ন পড়ে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা হতগর্ব। অথচ এই দেশ দীর্ঘ সময় উপনিবেশ থেকেও শিক্ষায় গৌরব অক্ষুণ্ন রাখতে সমর্থ হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুয়েটের বয়স শতবর্ষ পর্যন্ত পৌঁছেনি। এতেই অবক্ষয়ের লক্ষণ বোধ হয় কারো ভালো লাগার কথা নয়। অনেকে ভাবছেন, এটা কি ঈর্ষাপরায়ণদের জুগুপ্সা! নাকি প্রতিষ্ঠান দুটির ধারাপতন!

পাতিলের একটি ভাত টিপলেই বোঝা যায় যথাযথ সিদ্ধ হয়েছে কি না। তাই পর্যবেক্ষকরা বাংলাদেশের প্রথম সারির দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বেছে নিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাথা মনে করে। ইদানীং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়কে সে ধারার অন্তর্ভুক্ত ভাবা হচ্ছে। সে যা-ই হোক, আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মাথাকে বেছে নেওয়া হয়েছে এই বিবেচনায় যে মাছের মতো আমাদেরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাথা থেকে পচনের লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করেছে।

কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনা হঠাৎ করে আকাশ থেকে নাজিল হয় না। কিছু কিছু বিষয় আছে, যা নিজেদের কৃতকর্মের ফল। লেখা বাহুল্য, দৈশিক অধোগামিতা সে দেশের স্বার্থপর কিছু মানুষের অবিমৃশ্যকারিতার ফসল। বঙ্গবন্ধু জাতির মুক্তির জন্য গভীর চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতেন। আর যেসব সিদ্ধান্ত তাঁকে অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মতো নিতে হয়েছে, তার কিছু কিছু পরিণতি তাঁর শুভ ইচ্ছার অনুকূলে যায়নি। যেমন—তিয়াত্তরের বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর দেখেশুনে জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের কর্ণধার করা হতো। শিক্ষকরাও ছিলেন শিক্ষায় ও মনুষ্যত্বে প্রায় সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। ব্রিটিশ উপনিবেশের কালে এ ধারার ব্যত্যয় কম ছিল। পাকিস্তানি উপনিবেশে এ ব্যবস্থার ব্যতিক্রম ঘটতে থাকে। আইয়ুবশাহি যুগে তাঁর ফরমান-বরদার মোনেম খাঁ কিছু বরকন্দাজ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ঠাণ্ডা রাখতে চেয়েছিলেন। এ সময়ে কিছু আজ্ঞাবাহীর সেখানে স্থান হলেও তাঁদের জ্ঞানের পরিধি নিয়ে বিতর্ক হয়নি। তখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিদেশিদের নজর কাড়ত। শিক্ষকরা শুধু সুশিক্ষাই দেননি, শিক্ষার্থীদের চেতনায় ব্যক্তিত্ব ও জাতীয়তাবোধ জাগৃতিতে সহায়ক হয়েছিলেন। এ জন্য অনেক শিক্ষককে শারীরিকভাবে হেনস্তা হতে হয়েছে। তাঁরা পদ-পদবির লোভে ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দেননি। তাঁরা ছিলেন স্মরণীয় শিক্ষাব্রতী।

স্বাধীন বাংলাদেশের অর্ধযুগ অতিক্রান্ত না হতেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বশংবদ, দলীয় অনুগত শিক্ষকদের সন্তানাদির শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের পথ খোলা হলো। এরা শিক্ষা পরিবেশনের চেয়ে তোষামোদী আর দলাদলিতে কদর্য ভূমিকার আশ্রয় নিল। ফলে শিক্ষা আপনাআপনি আত্মগোপনে বাধ্য হলো।

ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানিকে সুবিধা দিয়ে সিরাজ বাংলার স্বাধীনতা হারিয়েছিলেন। তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবাধ স্বাধীনতা দিলে তাঁরা ক্ষমতার জন্যই ব্যস্ত থাকবেন। জ্ঞান সাধনা লাটে উঠবে। তিয়াত্তরের অ্যাক্টে স্বাক্ষর করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী চেতনায় এই দুর্ভাবনা ক্রিয়াশীল ছিল। আমরা পরিতাপের সঙ্গে লক্ষ করছি, অনেক শিক্ষক দলাদলি করে নেতা সাজেন, তারপর শীর্ষ পদে বসে আত্মজদের সুলভ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন বিশ্ববিদ্যালয়েই। আবেদন করার যোগ্যতা না থাকলে শর্ত শিথিল করে নিজের প্রার্থীর অনুকূলে নিয়ে আসেন। তারা নিয়োগ পায়। লেখাপড়া কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা সহজেই অনুমেয়। সুতরাং এই নিয়ন্ত্রিত স্বেচ্ছাচারিতায় শিক্ষার মান অধোমুখী হওয়াই স্বাভাবিক। তা ছাড়া এঁদের অনেকেই প্রাইভেট শিক্ষা কারখানায় আবার কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য শিক্ষা ব্যবসায় লিপ্ত হয়ে নিজ দায়িত্বকে জলাঞ্জলি দিচ্ছেন। এতে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের কোমর ভেঙে যাচ্ছে।

শিক্ষকরা নিষ্ঠ আদর্শবাদী হলে রাজনৈতিক ক্ষমতা বদলের সঙ্গে নিজেদের রং বদলাতেন না। এই রং বদল এমন পর্যায়ে গেছে যে কে ‘ময়ূরপুচ্ছ পরিধান’ করেছে তা পরখ করা দুরূহ। প্রসঙ্গত, আরো কিছু সত্য উচ্চারণ করতে হয়। প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষক নিয়োগ যথাযথ হয় কি না তা ভেবে দেখা দরকার। প্রাথমিকে পোষ্য কোটা, অনগ্রসর নৃগোষ্ঠী কোটা আরো হরেক কিসিমের কোটা সম্পর্কে পুনর্বিবেচনা করা দরকার। সরকার এদের সহায়তা করতে আগ্রহী হলে রাষ্ট্রীয় অনেক বিভাগ আছে, সেখানে তাদের সুবিধা দিতে পারে—শিক্ষার মতো অতিগুরুত্বপূর্ণ বিভাগে নয়। কারণ সুশিক্ষাই মনুষ্যত্ব গঠন ও সুনাগরিক সৃষ্টির প্রধান নিয়ামক। এখানেই শেষ নয়, গত শতকের আশির দশক থেকে বাছবিচার না করে ওই যে ঢালাওভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারীকরণের প্রবাহ চলছে, তাতে অনেক অশিক্ষক শিক্ষকের তকমা পরে শিক্ষার অধঃপতনকে ত্বরান্বিত করছেন। এটা যেমন এক দিনে হয়নি, তেমনি হঠাৎ বন্ধ করা সহজ হবে না। নীতিনির্ধারকদের এ ব্যাপারে সুচিন্তিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সবখানে শিক্ষক নিয়োগের বাছাই কাজে নির্মোহ থাকতে হবে সংশ্লিষ্টদের।

 

লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ

 

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038089752197266