সময় বহতা নদীর মতো। এক বছর দু' বছর করে একেকটা জীবন গত হয়ে যায়। এ পৃথিবীর বয়স কত বছর হবে; সে হিসেব কেউ সঠিক করে বলতে পারে না। পৃথিবীও জানে না ঠিক তার বয়স কত? সময়ের গতিবেগ কত হতে পারে- সেও কেউ বলতে পারে না।
দেখতে দেখতে একটা বছর প্রায় শেষ। আরেক জুন দোরগোড়ায়। এখন এপ্রিল। তারপর মে। এরপর জুন। এ মাসকে ঘিরে অন্য এক ভাবনা থাকে সবার। থাকে প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার হিসেব-নিকেশ। নাগরিকদের চাওয়া-পাওয়া মিলিয়ে রচিত হয় বাজেট। বিভিন্ন পেশার মানুষ জনের আশা-আকাঙ্ক্ষা ফুটে ওঠে রাষ্ট্রীয় বাজেটে। তাই বাজেট নিয়ে এত আলোচনা ও সমালোচনা।
এক দু' মাস আগে থেকে প্রাক-বাজেট কথন শুরু হয়ে যায়। পাশ হবার পরও কিছুদিন এ নিয়ে বিতর্ক চলে। তারপর আস্তে আস্তে সকলে নিশ্চুপ। বাজেট এগিয়ে চলে নিজের পথ ধরে। কারো প্রত্যাশা পূরণ হয় বটে। অনেকের আশা অঙ্কুরে থেকে যায়। তবু জীবন থেমে থাকে না। স্বপ্নের বিরাম নেই। প্রত্যাশার শেষ নেই। নতুন করে স্বপ্ন দেখা শুরু হয়। প্রত্যাশা নতুন করে ডালপালা মেলতে শুরু করে। এই তো জীবন। জীবনের গতিধারা। এভাবেই বাঁক ঘুরে ঘুরে জীবন নদী মোহনার দিকে ছুটে চলে। এ ছুটোছুটির কোনো বিরাম নেই। এগিয়ে চলে অবিরাম। এভাবেই হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীর বুকে মানুষের বিচরণ।
ছোটবেলা বাজেটের বিষয়ে তেমন কিছু বুঝতাম না। শুধু এটুকু মনে আছে, বাজেট দেবার আগে দৈনন্দিন জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বেড়ে যেত। বাজারে এক রকম আগুন লেগে যেত। এখন দিন বদলেছে। অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। তলাহীন ঝুড়ির দেশ এখন অপার সম্ভাবনার বাংলাদেশ। দেশ এখন সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশকে পেরিয়া যাবার দৃপ্ত প্রত্যয়ে এগিয়ে চলেছে উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে। আশপাশের অনেককে পিছে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে।
ভারতীয় অর্থনীতিবিদ কৌসিক বসু বলেছেন, বাংলাদেশ এখন এশিয়ার সবচেয়ে চমকপ্রদ ও অপ্রত্যাশিত সাফল্যের কাহিনীগুলোর একটি। 'Why Bangladesh is booming' নামে তার লেখাটি 'প্রজেক্ট সিন্ডিকেট' নামে একটি ওয়েবসাইট প্রকাশ করেছে। সে লেখায় তিনি বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির কারণ খুঁজে দেখার প্রয়াস পেয়েছেন। তিনি খুঁজে দেখেছেন কীভাবে এক সময়ের দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ পীড়িত দেশটি শুধু পাকিস্তানকে নয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ ভারতকেও ছাড়িয়ে যেতে চলেছে।
বিশ্ব ব্যাংকের প্রাক্তন প্রধান অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক কৌসিক বসু বিবিসিতে প্রকাশিত এ লেখায় আরও বলেছেন, ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের পরের প্রতিটি বছর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পাকিস্তানের চেয়ে আড়াই শতাংশ বেশি। তিনি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা অনেক উজ্জ্বল বলে মন্তব্য করেন।
অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলেছে, আগামী বছরগুলোতে পুরো পৃথিবীতে যে তিনটি দেশ খুব দ্রুত গতিতে প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখবে তার একটির নাম বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ। খুব শীঘ্র মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে চলেছে। ২০৪১ খ্রিষ্টাব্দের আগে আমাদের উন্নত দেশের কাতারে সামিল হবার কথা। তাই সঙ্গত কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাজেটকে ঘিরে সকলের প্রত্যাশার মাত্রা অনেক বেশি।
নিজেদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত বলে বাজেটকে কেন্দ্র করে বেসরকারি শিক্ষক সমাজের আশা-আকাঙ্ক্ষা বরাবর বেশি থাকে। শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত অনেকে এ সময় শিক্ষার উন্নয়নে বাজেটের প্রাক কথনে অংশ নিয়ে নানা মতামত তুলে ধরেন। একেবারে তৃণমূলের শিক্ষকদের এসব প্রাক বাজেট কথনে অংশগ্রহণের সুযোগ অবারিত করে দিলে শিক্ষার সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে কত কিছু জানা যেত।
সেই কবে থেকে বাজেটে শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়া হয় বলে শুনে আসছি। কথাটি কতখানি সত্য সে নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। তাই যদি হতো, তাহলে এতদিনে আমাদের শিক্ষা বিশ্বমানে উন্নীত হয়ে যাবার কথা। আমাদের শিক্ষার মান নিয়ে বিদেশে তো বটে দেশেও অনেকে হাসাহাসি করে থাকে।
তবে হ্যাঁ, একথা সত্য যে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন একেবারে কম হয়নি। কাঁচা ঘরের জায়গায় পাকা দালান হয়েছে। দৃষ্টিনন্দন ক্যাম্পাস ও শ্রেণিকক্ষগুলো যে কারো মন কেড়ে নেবার মতো। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় তো বটে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর সুন্দর সুন্দর ভবন ও সুদৃশ্য শ্রেণিকক্ষ সত্যি শিক্ষার্থীদের টেনে ধরে রাখার মতো। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর প্রাক প্রাথমিকের শ্রেণিকক্ষসমূহ শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য আকর্ষণীয় করে সাজানো।
অনেক প্রাইমারি স্কুলে দৃষ্টিনন্দন গেট আর বাউন্ডারি দেয়াল হয়েছে। অবকাঠামোগত অবস্থা গত কয়েক বছরে উন্নত হয়েছে। এবার কারিকুলাম ও সিলেবাসের দিকে একটু মনযোগ দিতে চাই। কারিকুলাম ও সিলেবাসে বেশ কিছু ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। সে ঘাটতিগুলো দূর করার উদ্যোগ গ্রহণ করা অপরিহার্য। শিক্ষার্থীদের বয়স, মেধা, রুচি ও পারিপার্শিকতার দিকে দৃষ্টি রেখে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা উচিত। এ জন্য বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ রাখা চাই।
রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শেষ ধাপের ১২০০ থেকে ১৩০০ স্কুল জাতীয়করণ করা বাকি। অবিলম্বে এদের জাতীয়করণ ত্বরান্বিত করা দরকার। আসন্ন বাজেটে এর কোনো সুরাহা না হলে এসব স্কুলের শিক্ষকদের কষ্টের সীমা থাকে না। পরীক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন। তা না হলে গোটা পরীক্ষা পদ্ধতিই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে।
উচ্চ শিক্ষায় গবেষণা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা দরকার। আমাদের দেশে উচ্চ শিক্ষায় গবেষণার দিকে তেমন মনযোগ নেই। উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশে শিক্ষা গবেষণায় কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়। আমাদের প্রতিটি বৃহত্তর জেলায় কম করে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল নিয়োগে বিশেষ করে ভাইস চ্যান্সেলর পদটিতে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ বন্ধ হওয়া উচিত।
আইসিটি ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আরো বেশি প্রতিষ্ঠা করা দরকার। প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের অনেক উন্নতি হয়েছে। আজকাল এক-দু'জন শিক্ষকের কোনো স্কুল নেই। সব জায়গায় কম করে পাঁচ-ছয় জনের স্টাফ। বেতন বৈষম্য নিয়ে তাদের অসন্তোষ আছে। তা দূর হওয়া চাই। সহকারী প্রধান শিক্ষক ও অফিস সহায়ক পদ অনতিবিলম্বে সৃজন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুততর করা আবশ্যক। আসন্ন বাজেটে এসব বিষয়ে সুযোগ অবারিত রাখলে পুরো দেশ ও জাতি উপকৃত হবে।
মাধ্যমিক স্তরের প্রতি অধিকতর মনযোগ দেয়া প্রয়োজন। এ স্তরটিতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা বৃদ্ধি না করলে দেশ এগিয়ে যাবার চলমান ধারাটি মন্থর হয়ে যেতে পারে। দক্ষ জনগোষ্ঠীই পারে একটি দেশ ও জাতিকে উন্নয়নের সোপানে পৌঁছে দিতে। মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর হচ্ছে দক্ষ মানব সম্পদ তৈরির কারখানা। এ স্তরের শিক্ষায় দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।কারিকুলাম ও সিলেবাসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দেশপ্রেমের প্রতিফলন ঘটাতে হবে। সাধারণ শিক্ষার চেয়ে আইসিটি ও কারিগরি শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করা না হলে দেশে কেবল শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। সব শিক্ষায় নৈতিকতা ও মূল্যবোধের প্রসার ঘটাতে হবে। অন্যথায় নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় হতে হতে আমরা একদিন নিঃশেষ হয়ে যাবো। মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর থেকে সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য দূর করতে হবে। এ বৈষম্য মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে সর্বনাশের মূল কারণ।
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অবিলম্বে কার্যকর করা দরকার। মাধ্যমিক শিক্ষায় জনবল কাঠামো-২০১৮ যত তাড়াতাড়ি প্রতিফলিত করা যায় তত মঙ্গল হয়। জাতীয়করণ এখন একটি কমন ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব স্কুল-কলেজ একত্রে জাতীয়করণের জন্য আসন্ন বাজেটেই সংস্থান রাখা জরুরি। সরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের ন্যায় বেসরকারিদের পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট ও বৈশাখি ভাতা দেবার কারণে উভয়ের মধ্যে বৈষম্য অনেকটা কমে এসেছে। সরকারিদের মতো বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা আর উৎসব বোনাস দিয়ে দিলে তেমন কিছু বাকি থাকে না। তাই এবারের বাজেটে এসব বিষয়ে অর্থের সংস্থান রাখা একান্ত অপরিহার্য মনে করি।
দেশে অনেকগুলো ননএমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীগণ খেয়ে না খেয়ে বছরের পর বছর শিক্ষার হাল ধরে আছেন। তাদের কষ্ট আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। তারা বার বার অনশন করেছেন। সেদিন এক শিশুকে দেখলাম নন এমপিও শিক্ষকদের সমাবেশে ঢাকার রাজপথে মায়ের পাশে প্ল্যাকার্ড বুকে দাঁড়িয়ে আছে। প্ল্যাকার্ড লেখা, ‘দয়া করে আমার মাকে বেতন দিন’। জানি না, শিশুটির আর্তি কারো হৃদয়ে নাড়া দিতে পেরেছে কিনা ?
ননএমপিওদের এমপিও দেবার জন্য সরকারের সদাশয় দৃষ্টি কামনা করি। এজন্য আসন্ন বাজেটে নির্দিষ্ট বরাদ্দ দিতে হবে। এক হাজার কিংবা দু'হাজার নয়, এক সাথে স্বীকৃতি পাওয়া সকল প্রতিষ্ঠানকে এমপিওর আওতায় নিয়ে আসার জোর দাবি জানাই। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের গত নির্বাচনের অঙ্গীকার ছিল-গ্রাম হবে শহর আর বাংলাদেশ হবে সিঙ্গাপুর। এটি মূলত পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি। মানুষ পরিবর্তনের এ অঙ্গীকারে বিশ্বাস করেছে। পরিবর্তনের জন্য হাতিয়ার লাগে। শিক্ষা সবচে' বড় হাতিয়ার।
দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী কিংবদন্তি নেলসন ম্যান্ডেলার ভাষায়- Education is the most powerful weapon which you can use change the world. আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে পরিবর্তনের যে হাওয়া বইতে শুরু করেছে তা এগিয়ে নিতে অবিলম্বে মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর জাতীয়করণ করার উদ্যোগ নিতে হবে। উদ্যোগটি গ্রহণ করার এখনই উপযুক্ত সময়। সামনের বাজেট ঘিরে যাত্রা শুরু হউক। পাহাড় সমান মাথা উঁচু করে আগামীর প্রজন্মকে দাঁড়াবার পথ প্রশস্ত করে দেবার দায়টুকু আমাদের সকলের। সে দায় এড়িয়ে যাবার কোনো অবকাশ নেই।
লেখক: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।