প্রাথমিক শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় নজর ও গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে, এটি শুভ লক্ষণ। দেশের ৬৫ হাজার ৫৯৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ বছরই ১৩ হাজার নতুন শিক্ষক নিয়োগ করা হবে। ১৩ হাজার পদের বিপরীতে ২৪ লাখেরও বেশি দরখাস্ত জমা পড়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদের জন্য। এটি একদিকে ভালো লক্ষণ যে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় প্রচুর শিক্ষিত মানুষের আগ্রহ রয়েছে।
আবার বিপরীত দিক থেকে দেখলে মনে হবে, একটি সরকারি চাকরিপ্রাপ্তির জন্য মানুষের আগ্রহ, ঠিক শিক্ষকতার জন্য নয়। তিনটি পার্বত্য জেলা বাদে বাকি ৬১টি জেলায় এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। ১৫ মার্চ পরীক্ষা নেয়ার কথা থাকলেও তা পিছিয়ে যায়।
০৯ এপ্রিল প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে কয়েকটি পরিবর্তন নিয়ে আসার পরিপত্র জারি করা হয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে। আমাদের স্মরণ থাকার কথা যে, সর্বশেষ ২০১৩ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা অনুযায়ী পুরুষ প্রার্থীদের যোগ্যতা স্নাতক হলেও নারীদের ক্ষেত্রে এই যোগ্যতা ছিল উচ্চমাধ্যমিক। কিন্তু এখন থেকে স্নাতক ছাড়া নারীরাও প্রাথমিক শিক্ষক হতে পারবেন না।
এ ছাড়া বিজ্ঞানে স্নাতকদের জন্য রাখা হয়েছে ২০ শতাংশ কোটা। দুটিই অত্যন্ত সময়োচিত সিদ্ধান্ত। আমরা শিক্ষার মান নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের যোগ্যতায় পরিবর্তন নিয়ে আসাটা খুবই জরুরি।
তবে, শুধু গ্র্যাজুয়েট শিক্ষক নিয়োগ দিলেই হবে না। শিক্ষাদান পদ্ধতি, শিক্ষাবিজ্ঞান ও শিশুবিজ্ঞান নিয়ে এ সব শিক্ষকের প্রচুর প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং শিক্ষকদের নিজেদেরও পড়াশোনা করতে হবে।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ইদানীং বিজ্ঞান ও গণিত শিক্ষকের সংকট চলছে, কোথাও কোথাও এই সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। ফলে জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে লাখ লাখ শিক্ষার্থী এই বিষয় দুটোতে বেসিক ধারণা নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করতে পারছে না। তাই বিজ্ঞানে
স্নাতকদের জন্য ২০ শতাংশ কোটা রাখা হয়েছে। বয়সসীমায়ও এসেছে পরিবর্তন। এতদিন প্রধান শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বয়সসীমা ছিল ২৫ থেকে ৩৫ বছর। পদটি দ্বিতীয় শ্রেণীর হওয়ায় পিএসসি’র নিয়োগ বিধিমালা সার্কুলারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তা ২১ থেকে ৩০ বছর করা হয়েছে। তবে পূর্বের মতো প্রধান শিক্ষক নিয়োগের শিক্ষাগত যোগত্যা স্নাতকই রাখা হয়েছে।
সহকারী শিক্ষকদের বয়সসীমা ১৮ থেকে ৩০ বছর ছিল, এখন সেটিও ২১ থেকে ৩০ করা হয়েছে। আগের মতো সহকারী শিক্ষকদের মধ্য থেকে ৬৫ শতাংশ পদোন্নতির মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক হবেন, বাকি ৩৫ শতাংশ সরাসরি নিয়োগ পাবেন। সহকারী শিক্ষক হিসেবে সাত বছর চাকরি করার পর একজন সহকারী শিক্ষক প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতির যোগ্য হবেন।
তবে, এই পদে নিয়োগ ও পদোন্নতির পুরো দায়িত্বই থাকবে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ওপর। এ ছাড়া নতুন নীতিমালায় শিক্ষক নিয়োগে চূড়ান্ত অনুমোদনের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে রাখা হয়েছে। কিছু শিক্ষক নেতা অবশ্য বাইরে থেকে নতুন ৩৫ শতাংশ প্রার্থীর প্রধান শিক্ষক হিসেবে সরাসরি নিয়োগের বিষয়টিতে আপত্তি তুলেছেন। তাদের যুক্তি হচ্ছে- প্রাথমিক সব শিক্ষককেই পদোন্নতি দিয়ে প্রধান শিক্ষক বানাতে হবে। এটিও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
তবে, বাইর থেকে মেধাবী ও মানবিকসহ অন্যান্য গুণাবলিসম্পন্ন কিছু নতুন প্রার্থীকেও প্রাথমিক শিক্ষায় ঢুকতে দেয়া উচিত। আর ইনসার্ভিস শিক্ষকরা তাদের বিভাগীয় পরীক্ষার মাধ্যমে ক্রমে ক্রমে পদোন্নতি পেয়ে পরিচালক ও মহাপরিচালক পর্যন্ত যাতে যেতে পারেন, সে বিষয়টিতেও খেয়াল রাখতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষা একটি বিশাল বহর, অথচ এই বহরে নিজস্ব ক্যাডার সার্ভিসের কোনো লোক নেই। এই বিষয়টিতেও সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে।
বিধিমালায় বলা হয়েছে, ৬০ শতাংশ পদে নারী প্রার্থী, ২০ শতাংশ পদে পোষ্য কোটা এবং ২০ শতাংশ পুরুষ প্রার্থীদের জন্য রাখা হবে। তবে, বিজ্ঞানে স্নাতকদের জন্য মোটের ওপর ২০ শতাংশ রাখা হয়েছে। বিজ্ঞানে স্নাতক না পাওয়া গেলে মেধার ভিত্তিতে তা পূরণ করা হবে। নিয়োগ পরীক্ষা পদ্ধতিতেও আসছে আমূল পরিবর্তন। প্রথমবারের মতো লিখিত পরীক্ষা কয়েকটি ধাপে আয়োজন করা হবে।
যেসব জেলায় লিখিত পরীক্ষা আগে শেষ হবে, সেখানে আগেই মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হবে। নিয়োগ পরীক্ষা ডিজিটালাইজড পদ্ধতিতে হবে। নির্ধারিত জেলায় পরীক্ষা আয়োজনের আগের রাতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে জেলা প্রশাসকের কাছে প্রশ্নপত্রের সব সেট পাঠানো হবে। পরীক্ষার দিন সকাল ৮টায় প্রশ্নপত্র ছাপিয়ে তা কেন্দ্রে পৌঁছানো হবে।
এবার ২৪ লাখেরও বেশি আবেদন জমা পড়েছে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৪ লাখ ৫২ হাজার ৭৬০, চট্টগ্রামে ৩ লাখ ৮২ হাজার ৩৩৫, রাজশাহীতে ৩ লাখ ৬২ হাজার ৯২৫, খুলনায় ২ লাখ ৪৮ হাজার ৭৩০, বরিশালে ২ লাখ ৫৫ হাজার ৮২৭, সিলেটে ১ লাখ ২০ হাজার ৬২৩, রংপুরে ২ লাখ ৯৪ হাজার ৩৬৮ এবং ময়মনসিংহে ২ লাখ ৮২ হাজার ৪৩৭টি আবেদন জমা পড়েছে।
পাশাপাশি বসা প্রার্থীদের কেউ যাতে একই সেটের প্রশ্নপত্র না পায় সে জন্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রার্থীদের প্রশ্নের সেট নির্ধারণ করা হচ্ছে। পরীক্ষার্থীর রোল নম্বরের ওপর প্রশ্ন সেট নির্ধারণ করা হচ্ছে। পরিদর্শক নিয়োগের ক্ষমতা কেন্দ্র সুপারের কাছে থাকছে না। এক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষককে অন্য প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব দেয়া হবে। কেন্দ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিদর্শকদের শুধু দায়িত্ব বুঝে দেবেন কেন্দ্র সুপার।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর থেকে ছুটির তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। সেখানে প্রধান শিক্ষকের সংরক্ষিত তিন দিনসহ মোট ৭৫ দিনের ছুটি নির্ধারণ করা হয়েছে। একাডেমিক ক্যালেন্ডারে বলা হয়েছে শিক্ষাবর্ষ ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর।
প্রথম কর্মদিবস ১ জানুয়ারি পাঠ্যপুস্তক দিবস হিসেবে উদযাপিত হবে। ২৩ থেকে ৩০ এপ্রিল (৮ দিন) প্রথম সাময়িক পরীক্ষা এবং ১ থেকে ৮ আগস্ট দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা, ২০ থেকে ৩০ নভেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা এবং ১০ থেকে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
একাডেমিক ক্যালেন্ডারে বলা হয়েছে, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে পরীক্ষার সময়সূচি মোতাবেক বার্ষিক পরীক্ষা গ্রহণ নিশ্চিত করবে। বার্ষিক পরীক্ষার উত্তরপত্র অন্তত এক বছর সংরক্ষণ করতে হবে। আরও বলা হয়েছে, নিজ নিজ বিদ্যালয় পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিজেরাই প্রণয়ন করবে। কোনো অবস্থাতেই বাইরে থেকে প্রশ্নপত্র কিনে পরীক্ষা নেয়া যাবে না।
পরীক্ষার নির্ধারিত তারিখ পরিবর্তন করা যাবে না। এগুলো সবই শিক্ষার মানের সঙ্গে সংযুক্ত। শিক্ষার মান বাড়াতে হলে শিক্ষকদের নিজেদের পড়াশোনার মান বাড়াতে হবে। বর্তমানে অনেক শিক্ষক প্রশ্ন তৈরি করতে ভুলে গেছেন কারণ প্রশ্ন বাইর থেকে আমদানি করা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই।
সারা দেশে উপবৃত্তি, দুপুরের খাবার, অবৈতনিক শিক্ষাসহ উচ্চশিক্ষিত, ট্রেনিংপ্রাপ্ত শিক্ষকের সমাহার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ এক বছরের সিইন এড প্রশিক্ষণ কোর্সের পরিবর্তে দেড় বছরের ডিপিইনএড কোর্স চালুর মাধ্যমে উন্নত পাঠদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তারপরও এ সব বিদ্যালয়ে ভর্তি কমছে শিক্ষার্থীর। ৬৫০টি বিদ্যালয় শিক্ষার্থী কমতির কারণে অস্তিত্বের হুমকির মুখে। পূর্ববর্তী সরকারের আমলে কিছু বিদ্যালয় বিলুপ্ত বা একীভূত করা হয়েছে, তার পরও শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়েনি। ৬৫০টি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৫০-এর নিচে।
দিনের বেশিরভাগ সময় শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে অবস্থান করতে হয়, ফলে তারা খেলাধুলা বা বিনোদনের সুযোগ পায় না। এই কারণে অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠাতে আগ্রহী হচ্ছেন না। তারা যাচ্ছে কিন্ডারগার্টেনে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের কিছু প্রকাশনা থেকে জানা যায়, ২০০৫ সালে দেশে কিন্তারগার্টেন নামধারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ২৮১টি, যা ২০১২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৪৮৬-তে এবং ২০১৩ সালে ১৪ হাজার ১শ’টিতে।
২০০৫ থেকে ২০১৩ এই আট বছরে যেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৩৩ শতাংশ, সেখানে কিন্ডারগার্টেন বেড়েছে এর ৬ গুণেরও বেশি। আট বছরে সারা দেশে যেখানে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী বেড়েছে ২০ দশমিক ৭ শতাংশ, সেখানে কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষার্থী বেড়েছে এর সাত গুণেরও বেশি। আমরা বলছি না যে, দেশ থেকে কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয় উঠিয়ে দিতে হবে।
তবে একটি শিশুর জন্মগত ও সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে রাষ্ট্র থেকে মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করার। পুরোপুরি সরকারের একার পক্ষে সম্ভব না হলে বেসরকারি পর্যায়ে মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষার আয়োজন করতে হবে। এটি যত্রতত্র এবং যার যার ইচ্ছে মতো অ-শিশুবান্ধব পরিবেশে প্রাথমিক শিক্ষাদান চলবে আর সরকার তা দেখেও না দেখার ভান করবে, তা হতে পারে না।
লেখক : শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক; ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত, সাবেক ক্যাডেট কলেজ শিক্ষক
সৌজন্যে: যুগান্তর