অনির্বাণ লাইব্রেরি বদলে দিল গ্রাম - দৈনিকশিক্ষা

অনির্বাণ লাইব্রেরি বদলে দিল গ্রাম

দৈনিক শিক্ষা ডেস্ক |

ab6b677ff5a2e2abfc6ca4d14bce79f1-29

খুলনা থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম মামুদকািট। জেলার উপকূলবর্তী পাইকগাছা উপজেলা সদর থেকেও গ্রামটির দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। হরিঢালী ইউনিয়নের হিন্দুপ্রধান এ গ্রামটিতে এবং আশপাশের দু-তিনটি গ্রামে একসময় শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। বাল্যবিবাহ ও নানা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল এখানকার মানুষ। সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও আলো ছিল না।

১৯৯০ সালের পর এক পরশপাথরের ছোঁয়ায় এলাকাটি এখন বদলে গেছে। বর্তমানে এখানে আর বাল্যবিবাহ হয় না। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই খোঁজ মেলে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে কর্মরত মানুষের। আর এসব সম্ভব হয়েছে একটি পাঠাগারের কল্যাণে। পাঠাগারটির নাম অনির্বাণ লাইব্রেরি।

এই লাইব্রেরি আর দশটা লাইব্রেরি থেকে আলাদা। এ পাঠাগারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ছোট পরিসরের এক সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন। শুরু থেকেই প্রতি সপ্তাহে এলাকার ছেলেমেয়েদের নিয়ে লাইব্রেরি প্রাঙ্গণে বসে পাঠচক্র। এলাকার স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীদের নিয়ে সাপ্তাহিক বৈঠক হয়। উচ্চশিক্ষিত হওয়ার স্বপ্ন দেখানো হয় তরুণদের। শুধু তা-ই নয়, লাইব্রেরির আয়োজনে এলাকায় তিন মাস পরপর করা হয় ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প। এসব মেডিকেল ক্যাম্পে থাকেন বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা ওই এলাকার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা।

লাইব্রেরি ঘিরে ওই এলাকায় সাংস্কৃতিক অঙ্গনও এখন বেশ এগিয়ে গেছে। সপ্তাহের একটি দিনে চলে সংগীতচর্চা ও নাটক-যাত্রার প্রশিক্ষণ। যেকোনো জাতীয় ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এলাকার মানুষকে নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে লাইব্রেরি কমিটি।

শুরুর কথা: ১৯৯০ সাল। দেশে তখন প্রবল গণ-আন্দোলন। এমনই একটি সময়ে ওই গ্রামের কয়েকজন যুবক ভাবছিলেন গ্রামের মানুষের জন্য কিছু করার কথা। একদিন সন্ধ্যায় আড্ডা দিতে দিতে স্থানীয় সোনাতনকাটী গ্রামের জয়দেব ভদ্র (বর্তমানে হবিগঞ্জের এসপি) ও মানিক ভদ্র, মামুদকাটী গ্রামের বিশ্বকর্মা মণ্ডল ও হরিঢালী গ্রামের মৃণাল ঘোষ সিদ্ধান্ত নিলেন, গ্রামে একটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করবেন।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজও শুরু হলো। এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করা হয় স্থানীয় স্কুল-কলেজের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের। ওই বছরের ১০ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় লাইব্রেরি। লাইব্রেরির প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু হয় ওই গ্রামের কেন্দ্রস্থলে থাকা হরিসভার একটি ঘরে। প্রথমে প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের বাড়িতে যেসব বই ছিল, সেগুলো দিয়ে শুরু হয় লাইব্রেরির কার্যক্রম। এরপর বাড়ি বাড়ি গিয়ে অর্থ সংগ্রহ করা হয়।

লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য জয়দেব ভদ্র প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৯৯০ সালের দিকে আমি ছিলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সে সময় রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রায়ই বন্ধ থাকত। ফলে বাড়িতেই থাকতে হতো বেশির ভাগ সময়। তখন এলাকার ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু করার তাড়না অনুভব করি। সেই তাড়না থেকেই এলাকার কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করি। পরে সবার সম্মিলিত চেষ্টায় প্রতিষ্ঠা করা হয় লাইব্রেরিটি।’

বদলে দেওয়ার গল্প: লাইব্রেরির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রামকৃষ্ণ দেবনাথ (বর্তমানে কৃষি ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ শাখার সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার) বলেন, ১৯৯০ সালের আগে ওই গ্রাম থেকে একমাত্র তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। কিন্তু বর্তমানে গ্রামটি থেকে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই আছেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। তা ছাড়া দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরও অনেক। বর্তমানে এখানেই আছেন ছয়জন এমবিবিএস চিকিৎসক। তা ছাড়া প্রকৌশলী থেকে শুরু করে এই এলাকার নানা বিষয়ে উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়েরা এখন সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। সবার সম্মিলিত চেষ্টায় গ্রাম থেকে উচ্চশিক্ষায় ঝরে পড়ার হার একেবারেই কমে গেছে। লাইব্রেরিকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ড তাঁদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

অনির্বাণ লাইব্রেরি বদলে দিয়েছে মামুদকাটী গ্রামের মৎস্যজীবীপাড়ার ফারুক হোসেন মহলদারকেও। এ পাড়ায় কয়েক বছর আগেও মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েছেন, এমন লোক ছিলেন না। আর এখন ওই পাড়াতেই আছেন কয়েকজন উচ্চশিক্ষিত নারী-পুরুষ। ফারুক গত বছর খুলনা আযম খান কমার্স কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন। সদ্য নিয়োগ পেয়েছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের সহকারী স্টেশনমাস্টার হিসেবে। তিনি বলেন, ‘ছোট থেকেই লাইব্রেরির বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। সময় পেলেই এখানে এসে বই পড়তাম। লাইব্রেরির কার্যক্রম আমার চোখ খুলে দিয়েছে। আমার মতো আমাদের মৎস্যজীবীপাড়ার অনেককেই আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে।’

অনির্বাণ লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি অধ্যাপক কালিদাশ চন্দ্র চন্দ বলেন, লাইব্রেরিটি প্রতিষ্ঠার পর ঘরে ঘরে গিয়ে এলাকার ছেলেমেয়েদের ডেকে এনে সপ্তাহের একটি দিন পাঠচক্র করা হতো। এ পাঠচক্রের বিষয় থাকত সমসাময়িক বা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। গ্রামের স্কুল ও কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের নিয়মিত খোঁজ নেওয়া হতো লাইব্রেরির পক্ষ থেকে। কারও পড়াশোনায় কোনো ব্যাঘাত ঘটছে কি না, কারও আর্থিক সাহায্য প্রয়োজন কি না, এগুলো জেনে তাদের সেভাবে সহযোগিতা করা হতো। কোথাও বাল্যবিবাহ হচ্ছে, শুনলেই সেটা বন্ধ করা হতো। মেধাবী গরিব শিক্ষার্থীদের দেওয়া হতো বৃত্তি।

ওই লাইব্রেরির সঙ্গে প্রথম থেকেই সম্পৃক্ত ছিলেন একটি জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিক নিখিল চন্দ্র ভদ্র। যখন লাইব্রেরিটি প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তিনি ছিলেন দশম শ্রেণির ছাত্র। তিনি বলেন, ‘গ্রামের শিক্ষার্থীদের সাধারণত লক্ষ্য থাকে উচ্চমাধ্যমিক বা ডিগ্রি পাস করে ছোটখাটো চাকরির চেষ্টা করা। কিন্তু ওই লাইব্রেরির বিভিন্ন কার্যক্রম আমাদের মনের দরজা খুলে দিয়েছে। উচ্চশিক্ষা বা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার আকাঙ্ক্ষা আমাদের মধ্যে জাগিয়ে তুলেছে।’

যশোর এমএম কলেজের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন মামুদকাটী গ্রামের বিধান ভদ্র। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন। লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার সময় তিনি সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। জীবনে এত দূর আসার পেছনে লাইব্রেরি ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ছোট থাকলেও শুরু থেকেই লাইব্রেরির বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ করি। এর ফলে নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে যায়। তা ছাড়া ছোট থেকে পাঠচক্র এবং বিভিন্ন বইয়ের সঙ্গে পরিচয় ঘটে, সেটা অনেক কাজে লেগেছে।’

বর্তমানে লাইব্রেরিতে রয়েছে দেড় হাজারের বেশি মূল্যবান বই। বইগুলো সবই অনুদানের। আর লাইব্রেরির খরচ জোগানো হয় এলাকার মানুষের অনুদানের টাকায়। ২০১৩ সালে ওই গ্রামেই লাইব্রেরির জন্য কেনা হয় ১১ শতক জমি। স্থানীয় লোকজনের মধ্যে যাঁরা নানা জায়গায় ভালো চাকরি করেন, তাঁরা অনুদান দিয়েছেন। গত বছর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে এক লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

লাইব্রেরির জন্য একটি চারতলা ভবন নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলেছে। ওই ভবনে থাকবে লাইব্রেরি, মিলনায়তন, ডিজিটাল কক্ষসহ আধুনিক প্রযুক্তির সমাহার। নতুন ভবনে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি কেন্দ্র চালু এবং এলাকার শিক্ষার্থীদের আইটি প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা নিয়েছে লাইব্রেরি কমিটি। তা ছাড়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গে টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে গ্রামের মানুষের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। লাইব্রেরির সভাপতি সমীরণ দে বলেন, ‘ভবনটি নির্মাণে আনুমানিক ৬০ লাখ টাকা খরচ হবে। যদিও লাইব্রেরির বড় কোনো তহবিল নেই, তারপরও আমরা সাহস নিয়ে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করেছি। আশা করি, সবার সম্মিলিত চেষ্টায় ভবন নির্মাণের কাজ শেষ করতে পারব।’

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036418437957764