পাঁচ বছর আগে জারি করা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি আদেশকে নজির হিসেবে দেখিয়ে হাজী নাছির উদ্দীন কলেজের কয়েকজন শিক্ষকের স্থগিত এমপিও ছাড় করানোর উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের একটি চক্র। ভুল ব্যাখ্যা ও গোঁজামিল দিয়ে ২০১২ খ্রিস্টাব্দের ২০ নভেম্বর জারি করা ওই আদেশকে নজির হিসেবে দেখানোর উদ্যোগের পেছনে মোটা অংকের টাকা লেনদেনের অভিযোগ দৈনিক শিক্ষার হাতে এসেছে।
জানা যায়, সাতক্ষীরার কলারোয়ার ছলিমপুরের হাজী নাছির উদ্দীন কলেজের ১২ জন শিক্ষক-কর্মচারীর বিরুদ্ধে জাল সনদ, নিয়োগের সময় কাম্য যোগত্য না থাকাসহ বিভিন্ন অভিযোগে এমপিও স্থগিত করা হয়। ২০১৩ ও ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের পৃথক তদন্তে অভিযোগসমূহ প্রমাণিত হয়। অভিযুক্ত শিক্ষকদের নিয়োগ ও এমপিওভুক্তি ২০০৩ ও ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে। দুর্নীত দমন কমিশনের অনুসন্ধানও অদ্যাবধি অব্যাহত রয়েছে। অভিযুক্তরা আদালতের স্মরণাপন্ন হলেও রায় তাদের পক্ষে যায়নি বলে জানা যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, আজ রোববার (১৮ মার্চ) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নানা কারণে স্থগিত/বন্ধ থাকা এমপিও ছাড়করণ সংক্রান্ত একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এই সভায় উপস্থাপনের জন্য হাজী নাছির কলেজের অভিযুক্ত শিক্ষকদের পক্ষে সুপারিশ লেখানো হয়েছে।কঠোর গোপনীয়তায় গত সপ্তাহে শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে মন্ত্রণালয়ে। এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন নারী যুগ্ম-সচিব (শিক্ষা ক্যাডার), কারিগরি শাখার একজন উপ-সচিব ও শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন করে পরিচালক ও সহকারি পরিচালক। এছাড়াও রয়েছে এমপিও দালাল ও কয়েকজন পিওন এবং অডিট শাখার অফিস সহকারি।
যে আদেশের ভুল নজির দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে: হাইকোর্টের একটি মামলার রায় বাস্তবায়ন ও আদালত অবমাননার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১২ খ্রিস্টাব্দের ২০ নভেম্বর একটি আদেশ জারি করে। আদেশে ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যে সব শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্তির জন্য বিবেচিত হননি এমন তাদের মধ্যে ৮৮৯ জনের এমপিও দেয়ার কথা বলা হয়েছে। ৮৮৯ জনের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। ওই তালিকার বাইরে কাউকে ওই সুবিধা দেয়া যাবে না। নতুন কোনো নামও ঢোকানো যাবে না। মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপ-সচিব রুহী রহমান স্বাক্ষরিত ১১ দফা সম্বলিত ওই আদেশের শেষ ও ১১ নম্বর দফায় বলা হয়েছে ‘এ আদেশ ভবিষ্যতে উদাহরণ হিসেবে গণ্য করা যাবে না।’ ৯ নম্বর দফায় বলা হয়েছে, ‘অডিট আপত্তি ও মামলা থাকলে তা নিষ্পত্তি সাপেক্ষে এ আদেশ কার্যকর হবে।’ কিন্তু টাকা খেয়ে এই দুই দফাকে চেপে রেখে আদেশের চার নম্বর দফার বরাত দিয়ে ফাইল উপস্থাপন ও সুপারিশ লিখিয়ে এমপিও ছাড়ের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানা যায়। [ছবিতে টিক চিহ্নিত দেখুন]
কয়েকমাস আগের কলেজটির সভাপতির কাছ থেকে মতামত চেয়েছে শিক্ষা অধিদপ্তর।কিন্তু স্বাক্ষর জাল করে নিজেদের মতো করে মতামত ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই মতামত প্রসঙ্গে কলেজটির সভাপতিকে প্রশ্ন করা হলে তিনি চমকে ওঠেন। তিনি বলেন, এমন একটি ফাইলের কথাই তিনি জানতেন না। সম্প্রতি ওই সভাপতি [জেলা প্রশাসক] অন্যত্র বদলি হয়েছেন। অভিযুক্ত শিক্ষকদের মতামতও চাওয়া হয়েছে।
শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে অভিযুক্ত ছয়জন শিক্ষকের মতামত সম্বলিত একটি ফাইল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর জন্য গত সপ্তাহে প্রস্তুত করা হয়েছে বলে জানা যায়।
যে পাঁচ শিক্ষকের নামে নাশকতার মামলা : যশোর বিমান বন্দরে হামলার ঘটনা উল্লেখ করে কোতয়ালী থানায় ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে দায়ের করা হয় নাশকতার মামলা। মামলায় হাজী নাছির উদ্দীন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষসহ পাঁচ শিক্ষকের নাম অর্ন্তভূক্ত করার হয়েছে।মামলায় কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোঃ আব্দুল আলীম, সহকারি অধ্যাপক মোঃ আবুল বাসার, প্রভাষক মোঃ মুহাসিন রেজা, প্রভাষক মোঃ আল মামুন, সহকারি অধ্যাপক মোঃ হারুন অর রশিদকে আসামী শ্রেণীভূক্ত করা হয়েছে। যদিও শিক্ষকরা ওই মামলাকে ষড়যন্ত্রমূলক অভিহিত করেছেন। অভিযুক্ত শিক্ষকদের সঙ্গে স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে পরিচিত পত্রিকার সাংবাদিকদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বলেও জানা যায়।
জানতে চাইলে শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন উপ-পরিচালক বলেন, মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম-সচিব ও একজন উপ-সচিব খুবই উদগ্রীব হাজী নাছির কলেজের অভিযুক্তদের এমপিও ফিরিয়ে দিতে। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের পৃথক তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরই তাদের এমপিও স্থগিত করা হয়। এখন যদি এমপিও ছাড় করা হয় তাহলে অবৈধভাবে ও আদেশের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ছাড়তে হবে।
একজন সহকারি পরিচালক বলেন, রুহী রহমান স্বাক্ষরিত ওই আদেশকে নজির হিসেবে দেখিয়ে সুপারিশ ও মতামত চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আমরা তাদের নির্দেশ মানতে বাধ্য।