এমপিও শিক্ষকদের দেয়ালে পিঠ, পিছু হঠবার অবকাশ নেই - Dainikshiksha

এমপিও শিক্ষকদের দেয়ালে পিঠ, পিছু হঠবার অবকাশ নেই

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

সারা দেশের আপামর এমপিওভুক্ত শিক্ষক- কর্মচারীরা ক্ষোভ ও অসন্তোষে ফুঁসে উঠেছেন । তাঁদের আশার বাণী শুনিয়ে শুনিয়ে অবশেষে নৈরাশ করে ফিরিয়ে দেবার পাঁয়তারা আজ সুস্পষ্ট । আশায় গুঁড়ে বালি হওয়ায় তাঁরা চরম এক অপমান অনুভব করছেন । পে-কমিশন গঠনের পর থেকেই এমপিওভুক্ত শিক্ষকগণের সাথে শুরু হয় নানা টালবাহানা আর ছলচাতুরী । আজো চলছে এর ধারাবাহিকতা । সরকার তথা সংশ্লিষ্টরা এমপিওভুক্ত শিক্ষক- কর্মচারীদের কী মনে করেন আমরা জানিনে ? যদি তারা শিক্ষক- কর্মচারীদের খুব দূর্বল মনে করে থাকেন, তবে তাদের সে ভাবনাটা মোটে ও সঠিক নয় ।

এমপিওভুক্ত শিক্ষক- কর্মচারীদের একটা দূর্বলতা আছে বটে । আর তা হচ্ছে-তাদের সংগঠন অনেক, সমিতি বহু। নেতার ও মাসাল্লাহ অভাব নেই। ‘বেশী পুতে বাপ নির্বংশ ‘ – এর মতো অবস্থা । ‘অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট’ র ন্যায় হালচাল ।

তবে, এবার বোধ হয় সবার গায়ে লেগেছে। সকলেই সমান অপমান বোধ করছেন। সর্বশেষ সংবাদে সকলেই মর্মাহত, পীড়িত, সংক্ষুব্ধ এবং প্রতিবাদ মূখর । বিশেষ করে তৃণমূলের শিক্ষক- কর্মচারীরা ক্ষেপে উঠেছেন আজ । নিজেদের অস্তিত্ব ও মর্যাদার প্রশ্নে তাঁরা এক কাতারে দাঁড়িয়ে যাবার মানসিক প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করে নিয়েছেন । শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে তাঁরা এতোদিন আন্দোলন- সংগ্রামের পথে হাঁটতে চাননি । কিন্তু , এখন তাঁদের তা-ই করতে বাধ্য করা হয়েছে । এ ছাড়া তাঁদের আর কোন পথ খোলা নেই । অবস্থা এমন – যেন পিঠ দেয়ালে টেকে গেছে তাঁদের । পিছু হটবার আর কোন সুযোগ নেই।

কারো ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন -সংগ্রাম করা কোন অন্যায় কাজ নহে । আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের জন্মইতো আন্দোলন সংগ্রামের পথ ধরে । এ দেশ তো আজ নানা ন্যায্য আন্দোলন ও সংগ্রামের পীঠস্থান। ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনের পাঠ জাতিকে শিখিয়ে দিয়ে গেছেন আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । বৃটিশ শাসন থেকে পাকিস্তানী শাসন আর পাকিস্তানী শাসন থেকে আজকের বাংলাদেশ – সে তো কেবল আন্দোলন -সংগ্রামের পথে দীর্ঘ এক পরিক্রমা । পৃথিবীর কোন দেশে এতো আন্দোলনের সাফল্য নিহিত ? আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম , ভাষা আন্দোলন , স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন – সবই তো খুব একটা দূর অতীতের অর্জন নহে। এ সব আন্দোলন- সংগ্রাম এ দেশের অধিকার বঞ্চিত যেকোন মানুষকে সংগ্রাম করে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অনুপ্রাণিত করে । ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রাম সহ সকল আন্দোলন- সংগ্রামে এ দেশের শিক্ষকদের ও তো গৌরবজনক অবদান রয়েছে ।

আমাদের এ দেশে শিক্ষক- আন্দোলনের সাফল্য ও কম নহে । বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষক- কর্মচারীগণ আজ অবধি যেটুকু সুযোগ- সুবিধা অর্জন করেছেন , তা আন্দোলন- সংগ্রামের মধ্য দিয়েই অর্জন করেছেন । এমপিওভুক্ত শিক্ষক- কর্মচারীগণ আজ যে শতভাগ স্কেল পাচ্ছেন, তা ও কিন্তু আন্দোলনের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে । স্কেলের ৪০% থেকে আজ ১০০% । সে আজ আন্দোলনের মাধ্যমেই অর্জিত । বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা সবই আন্দোলন- সংগ্রামের ফসল। সর্বশেষ বাড়ি ভাড়া পাঁচগুণ (!) আর চিকিৎসা ভাতা তিনগুণ (!) – সে ও শিক্ষক- কর্মচারীগণের সংগ্রামের মধ্য দিয়েই এসেছে । উৎসব ভাতা যেটুকুই দেয়া হচ্ছে, তা ও এমনিতেই আসেনি । অবসর সুবিধা , কল্যাণ ট্রাস্ট- সবই আন্দোলন করে পাওয়া।

প্রত্যেক মানুষেরই ধৈর্য্যের একটা সীমা আছে। ধৈর্য্যের সীমা পেরিয়ে গেলে যা হবার তা- ই হয়ে যায়। এমপিওভুক্ত শিক্ষক- কর্মচারীগণ ধৈর্য্যর পরীক্ষায় অবতীর্ণ। এর সীমা পেরিয়ে গেছে। ধৈর্য্য ধারণ করা মানে দূর্বলতা নয় । ভদ্রতার অর্থ এই নয়- সবকিছু চোখ মুদে মেনে নেয়া।

আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কায়- কারবার যেন দুই সতীনের এক ঘরে সংসার করার মতো । তাদের সমন্বয়হীনতার কারণে পাঠার বলির শিকার হচ্ছেন আমাদের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীগণ। আমাদের অর্থমন্ত্রি মহোদয় বেসরকারি শিক্ষকগণকে সরকারের এলার্জি মনে করেন কী- না, কে জানে? মাননীয় শিক্ষামন্ত্রি ও অর্থমন্ত্রি মহোদয়ের মধ্যে যদি কোন মনোমালিন্য থেকে থাকে, তবে এর খেসারত বেসরকারি শিক্ষকগণ দিতে যাবেন কেন ?

এ দেশে এ যাবত কত অর্থ কেলেংকারি যে সংগঠিত হয়েছে, তার কত হিসাব কে রেখেছে ? শেয়ার বাজার, হলমার্ক, ডেসটিনি, সোনালী ব্যাংক ইত্যাদি কেলেংকারীর পর সর্বশেষ বিশ্ব ব্যাংকে আমাদের রিজার্ভ ফান্ডের টাকা নিয়ে যে পুকুর চুরি সংগঠিত হলো-তাতে আমাদের কাউকে লজ্বাটুকু পর্যন্ত পেতে দেখিনি । একজন ড. আতিউর রহমানের চক্ষু লজ্জা ছিল বলে তিনি দায় এড়িয়ে যাননি । নির্দোষ মানুষটি পদত্যাগ করে জাতির লজ্জা কিছুটা কমিয়েছেন । আরেকজন শেখ হাসিনা, আমাদের জাতির জনকের কন্যা বেঁচে না থাকলে এতোদিনে কোন দিন জানি এ দেশটিই চুরি হয়ে যেতো । আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে তুচ্ছ কিছু একটা ঘটলেই সংশ্লিষ্ট উর্ধতন ব্যক্তি পদত্যাগ করেন। আমাদের সে ট্র্যাডিশন আজো গড়ে ওঠেনি ।

এ দেশে টাকার অভাব কেবল এমপিও শিক্ষকদের বেলায়। অর্থ মন্ত্রণালয় টাকা ছাড় দেয় না। যারা সর্বশেষ বিশ্বব্যাংকে আমাদের রিজার্ভের টাকা পর্যন্ত চুরি করলো , তাদের টাকা কে ছাড় দিলো? এ দূর্বৃত্ত চক্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন- সংগ্রাম শুরু করার এখনই কী উপযুক্ত সময় নয় ?

সর্বাগ্রে শিক্ষক বাঁচানোর সংগ্রাম শুরু করতে হবে । নিজেদের জীবন-যৌবন বিসর্জন দিয়ে দেশের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থায় ৯৫% যে সকল শিক্ষক প্রাণ সঞ্চার করেন , তাঁদের আজ বড় দূর্দিন । তাঁদের বাঁচাতে না পারলে আমাদের শিক্ষা বাঁচবে না । আর শিক্ষাকে বাঁচাতে না পারলে আমাদের জাতিকে বাঁচানো যাবে না ।

দেশ , জাতি ও শিক্ষার বৃহত্তর স্বার্থে দেশের প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ শিক্ষক- কর্মচারী আন্দোলন শুরু করার চূড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত । এইচএসসি পরীক্ষা অত্যাসন্ন । স্থানীয় সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রস্তুতি পুরোদমে এগিয়ে চলেছে । এ দু’টি বিশাল কর্মকান্ডে সিংহভাগ কাজ সম্পন্ন করেন এমপিওভুক্ত শিক্ষকগণ । এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীগণ যদি আন্দোলন শুরু করে দেন , তবে কাজ দু’টি মাঠে মারা পড়বে ।

প্রসঙ্গত , সম্ভবতঃ ১৯৮৬ সনে সরকারের অনুরুপ হঠকারিতার কারণে বেসরকারি শিক্ষক- কর্মচারীগণ এসএসসি পরীক্ষায় দায়িত্ব পালনে বিরত থাকলে তৎকালীন সরকার যাকে খুশী তাকে দিয়ে পরীক্ষা চালিয়ে নেয় । সে বছরই আমাদের পরীক্ষায় ‘ নকল ‘ নামক দূরারোগ্য ব্যাধিটির অনুপ্রবেশ ঘটে এবং এক সময় তা মহামারির আকার ধারণ করে । আমাদের শিক্ষায় এ ক্ষতটি আজো শুকোয়নি ।

শিক্ষকদের আন্দোলন প্রায় অনিবার্য হয়ে উঠেছে । নাক- কান- চোখ খোলা রেখে আন্দোলনের মাধ্যমে এমপিও শিক্ষকদের দাবী আদায় আজ কেবলি সময়ের ব্যাপার। সরকার ইচ্ছা করলে শিক্ষক-কর্মচারীদের দাবী অনতিবিলম্বে পূরণ করে আন্দোলনের ঝুঁকি এড়িয়ে যেতে পারে। সরকারের শুভ বুদ্ধি হলে , তা শীঘ্রই হওয়া উচিত।

লেখক: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ।

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.016578912734985