কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতি সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপ - দৈনিকশিক্ষা

কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতি সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপ

মাছুম বিল্লাহ |

বর্তমান সরকারের আমলে শিক্ষাক্ষেত্রে বেশ কিছু সাহসী ও বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যেমন ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয় করা, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের নতুন বেতন স্কেলের আওতায় আনা, প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ ইত্যাদি; যদিও বই বিতরণ ও পরীক্ষার ক্ষেত্রে কিছু সমালোচনা আছে। কাজ করলে সমালোচনা থাকবে। অতি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসকে সাধারণ শিক্ষার স্নাতকোত্তর স্তরের সমমর্যাদা দেওয়ার ঘোষণা দিলেন। এর ফলে বাংলাদেশের একটি সাধারণ ধারার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি সাহিত্যে মাস্টার ডিগ্রির সমমান হবে কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের ডিগ্রি। এটি নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী ও সাহসী পদক্ষেপ। এ নিয়ে দেশের শিক্ষাবিদরা বিভিন্নভাবে তাঁদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। তাঁরা বলছেন যে শিক্ষার কারিকুলামে সরকারের হাত নেই, নেই যথাযথ অবকাঠামো, সেই শিক্ষার মানই বা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে সরকার? আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এটি সরকারের একটি সাহসী ও প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। এর কারণ অনেক।

ব্যানবেইসের ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, দেশে কওমি মাদরাসার সংখ্যা ছিল ১৩ হাজার ৯০২। এ হিসাবের বাইরে আরো কয়েক হাজার মাদরাসা রয়েছে। এই বিশালসংখ্যক কওমি মাদরাসায় প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে। তারা কী পড়ে, কিভাবে তাদের পড়ানো হয় ইত্যাদি বিষয় সরকার দেখেও না দেখার ভান করতে পারে না। শিক্ষাবিদরা বলছেন, কওমি মাদরাসায় কী পড়ানো হয় তা সরকার জানে না, তাই স্বীকৃতি দেওয়া ঠিক হবে না। কথাটি কেমন মনে হয়! সরকার না জানলে জানতে হবে। কারণ সরকার সবার অভিভাবক। সরকার যেমন কট্টর বামপন্থীদের অভিভাবক, তেমনি ধর্ম নিয়ে যারা পড়াশোনা করে তাদেরও অভিভাবক। প্রায় ৮০ শতাংশ কওমি মাদরাসা বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের (বেফাক) নিয়ন্ত্রণে। আরো পাঁচটি আঞ্চলিক বোর্ড বাকি মাদরাসাগুলো নিয়ন্ত্রণ করে।

কওমি সনদের ব্যাপারে অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘সরকার কওমি মাদরাসার দাবি মানলেও এর ফলাফল শুভ হবে না। মাদরাসা থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা সহজেই চাকরির বাজারে ঢুকতে পারবে না। আর বহুজাতিক কম্পানিগুলো কোনোভাবেই কওমির শিক্ষার্থীদের চাকরিতে প্রাধান্য দেবে না। এখন কেউ যদি একটি সংস্থা করে সনদ দিতে থাকে, তাহলে সেটাকেও বৈধতা দিতে হবে। ’ শিক্ষাবিদ ও গবেষক ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ বলেন, ‘একজন শিক্ষার্থী যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই পড়ুক না কেন, অনার্স-মাস্টার্সের কারিকুলামে একটা ভার থাকে। কিন্তু কওমি মাদরাসার কারিকুলামে এর কিছুই নেই। তাই তাদের সনদের স্বীকৃতির পূর্বশর্ত হিসেবে কারিকুলামে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। এরপর সেই কারিকুলাম পড়ানোর জন্য একাডেমিক যোগ্যতা থাকা শিক্ষক প্রয়োজন। এ ছাড়া কওমি মাদরাসায় শিক্ষা উপকরণ বা লজিস্টিক সাপোর্ট নেই বললেই চলে। সেগুলোও পূরণ করতে হবে। এগুলো না হলে কওমির সনদের কোনো মান থাকবে না। ’

আমাদের শিক্ষাবিদদের অনেকেরই মত যে কওমি মাদরাসা শিক্ষার কোনো মান নেই। আমাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদান করে থাকে। ব্যতিক্রম ছাড়া এসব শিক্ষার্থীর টেকনিক্যাল কোনো জ্ঞান নেই। ভাষাজ্ঞানের দিক থেকেও প্রায় সবাই দুর্বল। তাদের অনেকেরই বাংলাও ভালো নয়, ইংরেজি তো নয়ই। অথচ আমরা বলছি যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের কোনো বাস্তব জ্ঞান নেই। কথাটি পুরোপুরি ঠিক নয়। তারা আরবি জানে, উর্দু জানে। বাংলা ও গণিতও শিখছে। যারা শিখছে না তাদের এখন শেখানো হবে। কাজেই সরকারের স্বীকৃতির ব্যাপারটি এ ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা পালন করবে।

দেশের সাধারণ শিক্ষার দায়িত্বে থাকা শিক্ষা বোর্ডগুলো সর্বোচ্চ এইচএসসি পর্যায়ের ডিগ্রি দিয়ে থাকে। যাদের কারিকুলাম, শিক্ষকসহ অন্যান্য সুবিধার সঙ্গে সরাসরি জড়িত সরকার। শিক্ষাবিদরা বলছেন, বোর্ড কোনোভাবেই স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ডিগ্রি দিতে পারে না। এই সনদ দেওয়ার এখতিয়ার রয়েছে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের। এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে এবং একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যেতে পারে। তা ছাড়া আলিয়া মাদরাসার সব একাডেমিক কর্মকাণ্ড ও সার্টিফিকেট, এমনকি ফাজিল (ডিগ্রি লেভেল) ও কামিলের (মাস্টার্স লেভেল) সার্টিফিকেট কিন্তু মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডই দিত। তবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত হওয়া প্রয়োজন কওমি মাদরাসাগুলোর, তাহলে সার্টিফিকেটের একটি আলাদা মূল্য থাকবে। এ বিষয়ে আরেকটি জটিলতা থেকে গেল। আর সেটি হচ্ছে দাওরায়ে হাদিসকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির মর্যাদা দেওয়া হলো; কিন্তু বাকি স্তরগুলো অর্থাৎ উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক পর্যায়ের কী হবে? মাধ্যমিকের সার্টিফিকেট ছাড়া উচ্চ মাধ্যমিকে, উচ্চ মাধ্যমিকের সার্টিফিকেট ছাড়া স্নাতকে এবং স্নাতকের সার্টিফিকেট ছাড়া স্নাতকোত্তরে ভর্তি হওয়ার বিষয়টি কী হবে সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। তবে জটিলতা সৃষ্টি হলে তার সমাধানও আছে।

একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষণীয়। এসব প্রতিষ্ঠানে যারা পড়ে ব্যতিক্রম ছাড়া তাদের অনেকেরই ধন-সম্পদের প্রতি খুব বেশি আগ্রহ থাকে না। ফলে তারা দুর্নীতি করে না। আমরা দেখছি, আমাদের চারদিকে অনেক উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি উচ্চপদে বসে কিভাবে অসৎ সম্পদের পাহাড় গড়ে সাধারণ মানুষকে ঠকায় ও দেশের সঙ্গে প্রতারণা করে। কওমি মাদরাসা থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অসৎ মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাহলে আমরা তাদের অবহেলা করব কেন? তারা তো এ দেশেরই মানুষ। তাদের বরং বছরের পর বছর অবহেলা করতে থাকলে তাদের কারো কারো মধ্যে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা, এক ধরনের জঙ্গি চিন্তা বাসা বাঁধতে পারে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিলে দেখা যায় সরকারের সিদ্ধান্তটি সময়োচিত ও প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।

মাছুম বিল্লাহ: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক, ব্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত সাবেক ক্যাডেট কলেজ শিক্ষক।

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0052249431610107