কেমন হওয়া উচিত ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক? শিক্ষার এই আধুনিক যুগে আমরা উত্তর দিয়ে থাকি বা অনেকেই জানি ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক হবে বন্ধুর মতো। কিন্তু কি ধরনের বন্ধুর মতো? কতটা বন্ধুর মতো? বিষয়টি নিয়ে চিন্তা, পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে কারণ এই সম্পর্কের ওপরই নির্ভর করে প্রকৃত শিক্ষাদান, ক্লাসরুম ম্যানেজমেন্ট, শিক্ষার্থীদের বিষয় সম্পর্কে জানার আগ্রহ তৈরি করা, শিক্ষাজীবনের ওপর গভীর ইমপ্রেশন সৃষ্টি ইত্যাদি।
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক কি ধরনের হওয়া উচিত তা নতুন করে শিক্ষকতা শুরু করা একজন শিক্ষকের পক্ষে হঠাৎ করে জানা সম্ভব হয়না যদিও ছাত্রজীবনে কিছু কিছু শিক্ষার্থী এই সম্পর্কের গুরুত্ব কিছুটা আঁচ করেছে অবার কেউ কেউ বিষয়টি সেভাবে দেখেনি। এটি দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার মাধ্যমে একজন সিনিয়র শিক্ষকে অর্জন করতে হয় এবং তিনিই বলতে পারেন কোন পরিস্থিতিতে, কোন ধরনের শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকদের কিরুপ আচরণ করতে হবে। তিনি জানেন কোন ধরনের , কোন লেভেলের শিক্ষার্থীদের সাথে কিরুপ সম্পর্ক হওয়া উচিত। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা, শহর-গ্রাম, পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থী, অগ্রগামী শিক্ষার্থী, পুরুষ শিক্ষার্থী, নারী শিক্ষার্থী, শ্রেণিকক্ষে সকলের সম্মুখে, শ্রেণিকক্ষের বাইরে আলাদা অবস্থায় কি শিক্ষক-শিক্ষার্থী একই ধরণের আচরণ করবে? বিষয়গুলো একজন শিক্ষককে ধীর গবেষণা ও পর্যবেক্ষনের মাধ্যমে বের করে নিয়ে আসতে হয়।
দেশের পরিচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ যে সব স্থানে মেধাবী শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা করে সেখানকার অধিকাংশ শিক্ষার্থীরাই একটু দুষ্ট প্রকৃতির ও ডানপিটে স্বভাবের হয়ে থাকে। তারা নতুন কোন শিক্ষক ক্লাসে প্রবেশের সাথে তাকে বিভিন্নভাবে উত্যক্ত করে থাকে। যেমন তাকে নিকনেম বা তাদেরই দেওয়া ছদ্মনামে ডাকে, শীস দেয়, বিভিন্ন ধরনের অদ্ভুত শব্দ করে, অঙ্গভঙ্গি করে, ঘাড় সোজা করে রাখে, এমনকি চেয়ারের ওপর পা তুলে দিয়ে বসে থাকে। এ বিষয়গুলো কিভাবে মোকাবিলা করতে হবে তা একজন নতুন শিক্ষকের পক্ষে হঠাৎ করে জানা বা কোন পরিস্থিতিতে কিভাবে এসব বিষয় ট্যাকল করতে হয় তা জানা সম্ভব নয়। তাকে সিনিয়র শিক্ষকদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে হয়। সিনিয়র শিক্ষকদেরকেও তাদের বুঝিয়ে দিতে হয় কিভাবে মোকাবিলা করতে হয় এসব সিসুয়েশন। তা না হলে নতুন শিক্ষক শিক্ষকতা ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করবেন কিংবা সংকল্প করে বসবেন যে, এই পেশায় আর নয়। অন্য কোন ভাল বন্ধুকেও বলবেন এই পেশায় না আসার জন্য। মনে রাখতে হবে সমস্যা সব পেশাতেই আছে, আনন্দের জায়গাটি নিজেরই তৈরি করে নিতে হয়।
কি করতে হবে এসব পরিস্থিতিতে? বার বার ’শাউট’ করতে হবে? পরীক্ষার ভয় দেখাতে হবে শিক্ষার্থীদের? প্রশাসনের ভয় দেখাতে হবে? শারীরিক শাস্তি দিতে হবে?’ শাউট’ করলে হয়তো দু চারমিনিটের জন্য শিক্ষার্থীরা থেমে থাকবে কিন্তু তার পরপরই তারা আবার তাদের স্বভাবজাত অভ্যাসগুলো শুরু করে দিবে। এমনকি শিক্ষকের করা ’শাউট’ই তারা অনুকরণ করবে। তখন তো হবে হীতে বিপরীত। ছাত্র-রাজনীতি, শিক্ষক রাজনীতি ও সর্বোপরি শিক্ষায় রাজনীতি প্রবেশের ফলে স্কুল কলেজের প্রশাসনকে শিক্ষার্থীরা আর ভয় করেনা। কাজেই প্রশাসনের ভয় দেখিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষার্থীদের আচরণের পরিবর্তন করা যায়না।
পরীক্ষার ভয় তাদের অনেকেরই নেই কারণ তারা অনেক টিচারের কাছে প্রাইভেট পড়ে, অনেক নোট-গাইড পড়ে, এগুলোর কারণে পাশ করা তাদের জন্য কোন ব্যাপার নয় এমনকি বেশি বেশি নম্বর পাওয়াও কোন সমস্যা নয়।আর পাবলিক পরীক্ষায় তো খাতা অনেক সহানুভূতির সাথে পরীক্ষণ করা হয়। ফলে তাদের পরীক্ষা নিয়ে কোন সমস্যা নেই। আর ক্লাসে না আসা? সেটাতো তারা চায়ই। ক্লাসে তারা যত না এসে পারে ততই তারা ভাল মনে করে। কাজেই ক্লাস থেকে বের করে দেওয়াও কোন সমাধান নয়। সমাধান হচেছ চমৎকারভাবে, চমৎকার ভঙ্গিতে পড়ানো, আকর্ষণীয়ভাবে পড়ানো, শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব এবং শিক্ষার্থীদের সাথে চমৎকার সম্পর্ক সৃষ্টি।
শারীরিক শাস্তি প্রদান কোন সমাধান নয়। আর শারীরিক শাস্তি তো নৈতিক ও রাষ্টীয়ভাবে নিষিদ্ধ। শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি প্রদান করলে তারা বিদ্রেহী হয়ে ওঠে। তাদের মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এসব ক্ষেত্রে ব্যক্তিত্ব ও ধৈর্য্য নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়। একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতিদিন একটি দীর্ঘ সময় কাটান। শিক্ষার্থীদের জীবনের একটি বিরাট অংশ কাটান শিক্ষকের সাথে। অতএব উভয়ের মধ্যে পজিটিভ সম্পর্ক একটি অতীব গুরুত্বপূর্ন বিষয়। শিক্ষার্থীর জীবনের ভবিষ্যত কর্ম পরিকল্পনা, জীবন গঠন ইত্যাদি বিষয়ে শ্রেণিকক্ষে এবং শিক্ষকদের নিবিড় সাহচর্যে এসে একজন শিক্ষার্থী জানতে পারেন। শিক্ষার্থী তার ভেতরের শক্তিকে যেন একজন শিক্ষকের সামনে প্রকাশ করার সাহস পায় সেই নিশ্চয়তা ও পরিবেশ একজন শিক্ষককে সৃষ্টি করতে হয়। এই ধরনের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কই কাঙ্খিত। এটিই বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্কের ইঙ্গিত বহন করে।
আমার মনে আছে আমি যখন রাজউক কলেজে ছিলাম, আমাদের অধ্যক্ষ কর্ণেল নুরন-নবী স্যার যিনি মানুষ গড়ার কারিগর, ঝিনাইদহ ও ফৌজদাহাট ক্যাডেট কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে মুটিভেশন দিতেন, প্রতিটি অ্যাসেম্বিলিতে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বাস্তব উদাহরণ দিয়ে কথা বলতেন। ফূল বাগানের দিকে তাকিয়ে বলতেন এ বাগানের এক একটি গাঁদা ফুল বড় হয়েছে কারন ফুলগাছলোর প্রতি আলাদা যতœ নেয়া হয়েছে। এখানে থেকে তোমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। তার মতো একজন অধ্যক্ষ প্রায়ই স্টাফলাউঞ্জে আমাদের বলতেন, ” একজন শিক্ষার্থী একজনকে শিক্ষককে দেখলে ভয়ে থর থর করে কাঁপবে, তবেই না একজন শিক্ষক স্বার্থক। একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সামনে মিন মিন করে কথা বলবে না।যিনি আস্তে আস্তে কথা বলবেন তিনি কোন শিক্ষকই নন।’ সেই আদর্শে যারা বিশ্বাস করে শিক্ষার্থীদের সাথে সেরুপ আচরণ করতেন তারা বিভিন্নভাবে পুরুস্কৃতও হতেন। কিন্তু এটি কি শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক? তিনি তাঁর সামরিক বাহিনীর আদলে বা সেই স্পিরিট দিয়ে কথা বলতেন, সেভাবেই ছিল অ্যাডমিনিসট্রেশন। সেই অধ্যক্ষই কিছুদিনের জন্য ইউরোপের কয়েকটি দেশের কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘুরে এলেন। এসেই স্টাফ লাউঞ্জে বললেন, ” একজন শিক্ষকের সাথে ছাত্রদের সম্পর্ক হবে বন্ধুত্বের, শুধুই বন্ধুত্বের, সিম্পলি বন্ধুর মতো।” কোনটি আমাদের অনুসরন করা উচিত?
ক্যাডেট কলেজে কিছু কিছু ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সাথে অনেক গল্প করতাম, শেক্সপিয়ারে প্রেমের গল্প করতাম। এভাবে আস্তে আস্তে ওদের ভেতরে ঢুকে গেলাম।ওদের সাথে সম্পর্কই হয়ে গেল আলাদা।আবার কিছু কিছু ক্লাসে শিক্ষার্থীরা বিভিন্নভাবে টিজ করতো, আমি হঠাৎ তাদেরকে মুটিভেশনের মুড থেকে পানিশমেন্ট মোডে চলে যেতাম, যেহেতু নতুন ও ইয়ং টিচার। ওইসব শিক্ষার্থীদের সাথে সঠিকঅর্থে ভাল সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। এ ক্ষেত্রে আমি মনে করি প্রচুব প্রশিক্ষন, পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার প্রয়োজন। একই ঘটনা ঘটেছিল ঘাটাইল ক্যান্টনমেন্ট কলেজে যখন ছিলাম। সেখানেও শিক্ষার্থীদের সাথে দুভাবে আচরণ করে দু’ ধরনের ফল পেয়েছি।
তাই প্রশ্ন ওঠে শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক কতটা বন্ধুর মতো হবে? কি ধরনের বন্ধুর মতো? বন্ধুর কাঁধে হাত দেয়া যায়, বন্ধুর সাথে ধুমপান করা যায়, ব্যক্তিগত অনেক বিষয় শেয়ার করা যায়, নারীসংক্রান্ত অনেক গল্প করা যায়।শিক্ষক ও ছাত্র কি এসব বিষয়গুলো বন্ধুর মতো একে অপরের সাথে আলোচনা করতে পারে বা পারবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্র হয়তো কিছুটা এ ধরনের আলোচনা শালীনতা বজায় রেখে একটা পর্যায় পর্যন্ত করতে পারে কিন্তু উচচ মাধ্যমিক, মাধ্যমিক এব ং প্রাথমিক পর্যায়ে কি হবে? এগুলো নিতান্তই দীর্ঘ পর্যবেক্ষন ও গবেষণার বিষয়। অষ্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা ফ্রি সেক্সের দেশ। কিন্তু শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক সেখানেও পবিত্র রাখার চেষ্টা করা হয় অর্থাৎ এখানে যৌন সম্পর্ক একেবারেই নিষিদ্ধ। অষ্ট্রেলিয়ার এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক ছাত্রীর সাথে এক শিক্ষকের দীর্ঘদিন যৌন সম্পর্ক থাকার পর ছাত্রীটি যখন প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করে চলে যায় তখন বিষয়টি ধরা পরে এবং ঐ শিক্ষকের ১৪ বছর জেল হয়।বন্ধুত্বের সম্পর্ক বলতে এখানে নিরাপদ সম্পর্কই নির্দেশ করে। একজন শিক্ষার্থী যাতে একাডেমিক এবং নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত প্রশ্ন ও আলোচনা শিক্ষকের সাথে করতে পারে। শিক্ষককে দেখে যাতে শিক্ষার্থী ভীত না হয়, ইতস্তত না করে, সত্য গোপন করার চেষ্টা না করে সেই বিষয়গুলোর নিশ্চয়তা শিক্ষককে কাজে প্রমাণ করতে হয়। শুধু মুখে বা খাতায় লিখিত থাকলে হবেনা। শিক্ষককে গম্ভীর ও চিন্তাযুক্ত দেখালে শিক্ষার্থীরা তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে নিরাপদবোধ করবেনা। শিক্ষককে হাস্যজ্জোল , আনন্দিত, উৎসাহী ও আগ্রহী থাকতে হবে, ফলে শিক্ষার্থীদের সাথে চমৎকার সম্পর্ক বিরাজ করবে যা শিক্ষক-ছাত্র নিরাপদ সম্পর্কের নিশ্চয়তা দিবে।
লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ এবং গবেষক (প্রাক্তন ক্যাডেট কলেজ শিক্ষক,বর্তমানে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত)।