চেয়ারে বসার ‘অপরাধে’ রাজধানীর সরকারি গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের দুই কর্মচারীকে লাঞ্ছিত করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের দুই বিতর্কিত সহকারী পরিচালক। লাঞ্ছিত কর্মচারীরা হলেন-রবি কুমার ও আমিনুল ইসলাম। কান্নাভেজা কন্ঠে দৈনিকশিক্ষাকে তারা লাঞ্ছণার খবর জানান। বুধবার (২০ জুলাই) বিকেলে শিক্ষা ভবনে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার বিচার চেয়ে অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন কর্মচারী সমিতির নেতৃবৃন্দ। বিচার না পেলে সারাদেশের সরকারি স্কুল-কলেজ ও আঞ্চলিক অফিসে কর্মসূচি পালন করবেন তারা।
ঘটনাটি শিক্ষা ভবনসহ সারাদেশের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মুখে মুখে ফিরছে। ছি:ছি: করছেন বিবেকবানরা।
অভিযোগে জানা গেছে, বুধবার মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (মূলত সরকারি কলেজের শিক্ষক) ড. আনোয়ার হোসেন ওই দুই কর্মচারীকে বিশেষ প্রয়োজনে দেখা করার জন্য শিক্ষা ভবনে ডেকে পাঠান। বিকেলে তারা শিক্ষা ভবনে ড. আনোয়ারের অফিস রুমে গিয়ে দেখেন তিনি নেই। এসময় তারা আনোয়ার হোসেনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর আনোয়ার এসে দুই কর্মচারীকে চেয়ারে বসা দেখে জানতে চান তারা কারা? জবাবে তারা বলেন, গার্হস্থ অর্থনীতি কলেজ থেকে এসেছেন। এরপর আনোয়ার জানতে চান আপনারা শিক্ষক না কর্মচারী? জবাবে তারা বলেন যে তারা কর্মচারী।। এরপর আনোয়ার রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে জানতে চান কর্মচারি হয়ে কোন সাহসে শিক্ষা ভবনের কর্মকর্তার সামনে চেয়ারে বসলি? তোদের গা থেকে কর্মচারির গন্ধ আসে। আরো অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন ড. আনোয়ার। এক পর্যায়ে আনোয়ার টেলিফোনে আরেক সহকারী পরিচালক এটিএম আল ফাত্তাহকে ডেকে এনে দু্ই কর্মচারীকে বেধড়ক পিটুনি ও অপদস্ত করে। ড. আনোয়ারের পা ধরে ক্ষমা না চাইলে ভুরুঙ্গামারী বদলি করে দেয়ার হুমকি দেয়া হয় ওই দুই কর্মচারীকে। শেষে তারা ক্ষমা চেয়ে ওই কক্ষ থেকে পালিয়ে বাঁচেন।
জানতে চাইলে আনোয়ার ও ফাত্তাহ মতামত দিতে রাজী হননি।
এদিকে, এ ঘটনা জানাজানি হলে কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। তাঁরা অধিদপ্তরের দুই কর্মকর্তার বিচার দাবি করে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক শেখ মো: ওয়াহিদুজ্জামানের কাছে অভিযোগ করেন। সারাদেশের স্কুল-কলেজে কর্মবিরতি করবেন তারা।
বিতর্কিত এই দুই সহকারি পরিচালকই মূলত বি সি এস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত সরকারি কলেজ শিক্ষক ও ছাত্রজীবনে শিবিরপন্থী ছিলেন বলেন তাদের সহকর্মীরা জানান। সাড়ে তিন বছর আগে তদবির আর ঘুষ দিয়ে শিক্ষা ভবনের সহকারি পরিচালক পদে বদলি ভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। অদক্ষতার দায়ে এ শাখা থেকে ও শাখায় বদলি হয়েছেন আনোয়ার। সরকারি কলেজের অধ্যক্ষদেরকেই তিনি ‘প্রিন্সিপাল সাহেব’ সম্বোধন করায় তার বিরুদ্ধে ঢাকা কলেজ ও তিতুমীর কলেজের অধ্যক্ষসহ কয়েকজন অভিযোগ দিয়েছেন গত বছর।
নাম প্রকাশে অনিচছুক একজন পরিচালক জানান, এন্তার দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ফাত্তাহকে শাস্তিমূলক বদলির সিদ্ধান্ত আগেই ছিল। এতদিন সাবেক ডিজি তাকে আগলে রাখতেন কিন্তু নতুন ডিজি আসায় দৌড়ের ওপর আছেন ফাত্তাহ। আজ-কাল বদলি হতে পারে এমন খবর পেয়ে ফাত্তাহর পক্ষে বাড়ৈ ও বি সি এস শিক্ষা সমিতির মহাসচিব শাহেদুল খবির তদবির করেছেন। ফাত্তাহর বদলি ঠেকাতে ড. মোল্লার কাছে শাহেদুল খবির কাতর মিনতি করেছেন বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কলেজ শাখার কর্মচারীরা বলাবলি করছেন।অধিদপ্তর থেকে এমপিও দুর্নীতির দায়ে বিতারিত কাজী নুরে আলম সিদ্দিকীকে ঢাকা বোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও বোর্ডে দীর্ঘদিন চাকরি করা তপন কুমারকে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বানানোর তদবির করেছেন শাহেদ, এমন অভিযোগ সবার মুখে মুখে।
মন্ত্রণালয়ের কর্মচারিরা বলছেন, সমিতির সাবেক নেতা মাসুমে রাব্বানীকে দেখা যেত ক্লাস ফাঁকি দিয়ে মন্ত্রণালয়ে কারো বদলি ঠেকাতে বা কাউকে বদলি করার তদবিরে ব্যস্ত। শাহেদও একই ব্যবসায় নেমেছেন যা শিক্ষা ক্যাডারের সাধারণ সদস্যদের জন্য দূর্ভাগ্যজনক হলেও মহাসচিবের ভবিষ্যত ও ম্যানিব্যাগ ভরপুর করবে বটে!
এদিকে বি সি এস শিক্ষা সমিতির একাধিক নেতা দৈনিকশিক্ষাকে বলেন, শাহেদুল খবিরের একমাত্র যোগ্যতা গোটা চাকরিজীবনে বাড়ৈ নামক একজনের সঙ্গে পরিচয় হওয়া! বাড়ৈ তাকে নোয়াখালী-কুমিল্লার অজঁপাড়ার কলেজ থেকে থেকে এতদূর পস ঢাকায় টেনে এনেছেন। মা্উশির বদলি আর কেনাকাটা করে ফাত্তাহর প্রতিদিনকার আয় লাখের ওপর। ওই টাকার ভাগা পায় বাড়ৈ। তাই খবিরকে দিয়ে ফাত্তাহর পক্ষে মন্ত্রণালয়ে তদবির করিয়েছেন বাড়ৈ।
রফিকুল ইসলাম নামের একজন সহযোগী অধ্যাপক বলেন, গণহারে বেসরকারি কলেজগুলো সরকারি হয়ে যাচ্ছে কোনো নীতিমালা ছাড়াই। আত্মীকৃত হচ্ছেন দেদার। এতে স্মরণকালের বেশি ক্ষতির সম্মূখীন হতে যাচ্ছেন তীব্র প্রতিযোগীতামূলক চাকরির পরীক্ষায় পাস করা ক্যাডারভুক্ত শিক্ষকরা। তাদের বুক ধুরু ধুরু করে, ঘুম আসেনা, হতাশ আর হাপিত্যেস করে সময় কাটান। সেই বিষয়ে কোনো টু-টা শব্দ না করে ফাত্তাহ-তাবিজ-বশির গংদের বদলি ঠেকানোর তদবিরে লিপ্ত নতুন মহাসচিব! তিনিও কী মাসুমের পথে হাঁটা শুরু করে অনেকদূর গেলেন? রব্বানী ২০ বছর আগে যেসব দাবী নিয়ে সমিতি করা শুরু করেছিলেন তার প্রায় সব দাবীই আজও অপূরণীয়। কিন্তু সমিতিকে ব্যবসা হিসেবে নিয়ে মাসুমের ঢাকায় বাড়ী, স্ত্রীর ঢাকায় পোস্টিং, শত শত সহকর্মীকে ল্যাং মেরে, গোঁজামিল দিয়ে, রিজার্ভ পদ কেটে অধ্যাপক বাগানো এবং দু’দুবার সমিতির মহাসচিব বনে যাওয়া হয়েছে। ক্যাডারের সমস্যা রয়েই গেছে।
ক্ষুব্ধ রফিক অনুরোধ করেন শাহেদের কর্মকান্ড ও গতিবিধি নিয়ে দৈনিকশিক্ষায় ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে। রফিক বলেছেন, সাংবাদিকদের যাবতীয় তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে প্রস্তুত ক্যাডারের শত শত ভুক্তভোগী। তিনি বলেন, পদোন্নতি ঠেকিয়ে রাখা হচ্ছে অভিষেকের কারণে এমন খবর পাওয়া যাচ্ছে। অভিষেক হবে জাঁকজমক, মফস্বলের কলেজ থেকে আসা সরকারি শিক্ষকরা দাবী তুলবেন পদোন্নতির। তারপর নেতারা কথা দিবেন দুই মাসের মধ্যে পদোন্নতি! তারপর দুইমাস হতে তিনদিন বাকী থাকতেই পদোন্নতি হবে! এরপর বড়ৈ-মসুদা বাহিনী ফেসবুকে লিখবেন সাবাস মহাসচিব! আপনি কথা দিয়ে কথা রেখেছেন ডেটলাইনের আগেই! আপনিই সমিতির পরবর্তী সভাপতি! ‘সব শেয়ালের এক রা,’ বিড় বিড় করে বলেন রফিক।
এদিকে শাহেদকে বিগত দিনের মহাসচিবদের (মাসুম-আজতগীর) মতো বদলি আর পদোন্নতি বাণিজ্য নিয়ে নিমজ্জিত না হওয়ার আহ্বান জানিছেন পদোন্নতিবঞ্চিত শত শত সিনিয়র শিক্ষক। তারা শাহেদকে ‘মাস্তি-মসুদা-মন্নমথ’ ছাড়ার উপদেশ দিয়েছেন। নইলে দুইবছর পর ভোটের বাক্সে দেখা যাবে মাসুমদের কাতারে!
বদলিতে ঘুষের টাকা কম হওয়ায় ফাত্তাহ গত বছর আবদুর রহমান নামের একজন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারকে কানে ধরে ওঠবস করতে বাধ্য করেছিলেন। মহাপরিচালকের বরাবর নিজ হস্তে লিথিত জবানবন্দীতে আবদুর রহমান তার দুখগাঁথা লিখেছেন যা পড়লে বিবেকবান মানুষমাত্রই চোখের জল ফেলবেন। এলিয়াছকে দিয়ে করা তদন্তে দোষী প্রমাণ হওয়ায় ফাত্তাহর পক্ষে সাবেক মহাপরিচালক ওই শিক্ষা অফিসারের কাছে ‘সরি’ বলতে বাধ্য হয়েছিলেন।
আরো পড়ুন :
শিক্ষা অফিসারকে কানে ধরানো : ফাত্তাহর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি