এমিলি রিচার্ডসন নামে আমেরিকান এক ভদ্রমহিলা বাংলাদেশের বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং কেজি স্কুলের ওপর পিএইচডি করছেন নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় অনেকের সাথে কথা বলেছেন, বিভিন্ন ফি পেইং স্কুল সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন ।
আমার সাথেও একটি মিটিং করেছেন। বিদ্যালয় সম্পর্কিত আমার লেখা তিনি বিভিন্ন সূত্র থেকে পড়েছেন বলে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। তার আলোচনার বিষয়বস্তকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত, বাংলাদশের কেজি স্কুল সরকারি প্রাথমিক স্কুল থেকে আলাদা কিভাবে।
দ্বিতীয়ত, কেজি স্কুলগুলোর শিক্ষার মান সম্পর্কে আমার মতামত কি এবং কেজি স্কুলে শিক্ষক অ্যাসেসিয়েশন থাকা উচিত কিনা। এমিলি আমেরিকা চলে গেছেন। তার যাওয়ার পরের সপ্তাহেই বাংলাদেশের কেজি স্কুল নিয়ে সরকারের বিরাট পরিকল্পনা এবং চিন্তার কথা প্রচার মাধ্যমে জানতে পারলাম। এই সময়ে তিনি বাংলাদেশে থাকলে তার গবেষণার কাজটি হয়তো আরও সহজ হতো এবং তার প্রশ্নের অনেক উত্তর তিনি পেয়ে যেতেন।
আমাদের দেশে প্রাইমারী শিক্ষা অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক। ৬৩০০০ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়াও রেজিষ্টার্ড প্রাইমারী এবং বেসরকারী সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে , সবমিলে প্রায় এক লক্ষ প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ।
এর বাইরেও রয়েছে প্রায় সত্তর হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুল যদিও সরকারের খাতায় কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর সঠিক কোন হিসেব নেই। কিন্ডারগার্টেন অষ্টাদশ শতকে জার্মানীতে যেসব বাবা-মায়েরা কাজে যেতেন তাদের বাচাচদের খেলাধুলা, নাচ ও গানে মাতিয়ে রাখার জন্য এক ধরনের ব্যবস্থা।
এই ব্যবস্থাই আজ পরিবর্তিত আকারে এখন কিন্ডারগার্টেন স্কুল নামে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে এখন ৩-৭ বছরের বাচচাদের জন্য গ্রাম গঞ্জ, শহর ও রাজধানীর অলিতে গলিতে দেখা যায় কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়।
কি পড়ানো হচেছ সেখানে, কারা পড়াচেছন, শিশুদের চাহিদা কতটা পুরন হচেছ এসব কথা ভাবার কারুরই সেরকম সময় বা চিন্তা ছিলনা কারন সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। এখনও প্রায় তিন থেকে সাত শতাংশ শিশুদের বিদ্যালয়ে নিয়ে আসা যায়নি।
যাদেরকে আনা হয়েছে তাদের সবাইকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করাতে পারিনা। ফ্রোয়বেল ১৮৩৭ সালে জার্মানীর ব্লাংকেনবার্গে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং নারীদেরকে সেটি সমর্থন করতে বলেন।তিনি শিশুদের বলেছিলেন গাছ এবং শিক্ষকদের বলেছিলেন বাগান। এভাবেই কিন্ডারগার্টেন কথাটি এসেছে।কিন্ডারগার্টেন একটি প্রাক-বিদ্যালয় প্রস্তুতিমুলক শিক্ষাদান পদ্ধতি।
শিশুরা এখানে খেলাধুলা, গান, নাচ, ছবি আঁকা, বাস্তব কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকবে এবং এগুলোর মাধ্যমে এক ধরনের সামাজিক আদানপ্রদান শিখবে। তাদেরকে প্রস্তুত করা হবে পরবর্তী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে।আমাদের কিন্ডারগার্টেনগুলো এসব চাহিদা কতটা পূরন করতে পারছে এবং পরবর্তীতে তারা কেমন করছে, কতটা সফলভাবে মানিয়ে নিচেছ পরবর্তী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে দেখার সময় অনেক আগেই হয়েছে কিন্তু দেখা হয়নি।
দেশে কয়েকটি জঙ্গি ঘটনার প্রেক্ষিতে সরকার নড়েচড়ে বসেছে যে, কিন্ডারগার্টেনগুলোতে কি পড়ানো হচেছ, কি তৈরি হচেছ সেখান থেকে, এই ধারণা থেকেই দেশের কিন্ডারগার্র্টেনগুলো নিয়ে সরকার কিছু চিন্তা ভাবনা শুরু করছে । এটি ভাল দিক ।
৪৮৭টি উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি টিম উপজেলার কিন্ডারগার্টেনগুলো দেখবে, মনিটর করবে এবং তারপর একটি রিপোর্ট পেশ করবে। ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিটি জেলা শহরের এবং উপজেলার বাইরের কিন্ডারগার্টেনগুলো দেখবেন এবং ৮টি ডিভিশনের ডিভিশনাল কমিশনারগন বিভাগীয় শহর এবং মেট্রোপলিটন সিটিগুলোর কিন্ডারগার্টেনস্কুলগুলো পরিদর্শন করে রিপোর্ট পেশ করবেন।
তাদের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে মন্ত্রণালয় পরবর্তী করণীয় ঠিক করবেন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব হুমায়ন খালেদ বলেন, ‘বেশির ভাগ কেজি স্কুল বৈধভাবে গড়ে ওঠেনি। এসব স্কুলের আদৌ প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা তাও আমরা জানিনা, তাই টাস্কফোর্স গঠন করা হচেছ।’ সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সরকারের কাছে তথ্য স্বচছতার সাথে থাকবে এবং প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে এটি আরও ভালভাবে থাকা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।
সরকার ২০১১ সালে একটি উদ্যোগ নিয়েছিল কিন্তু পেরে ওঠেনি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সাত বিভাগে সাতজন বিভাগীয় উপপরিচালক কেজি স্কুলগুলোর নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে দেখেছেন যে, ৩৮ বছর সময় লেগে যাবে যদি তারা প্রতিদিন একটি করে স্কুল পরিদর্শণ করেন।
তারা তাদের মতামতসহ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে পাঠাবেন ষাট দিনের মধ্যে।তাই ২০১১ সালের প্রচেষ্টা ভেস্তে যায়।তাই গত পাঁচ বছর চেষ্টা করেও সরকার কেজি স্কুলগুলোকে নিয়ন্ত্রেনে আনতে পারেনি। আবার প্রচেষ্ঠ গ্রহন করেছে। এটিকে আমরা সাধুবাদ জানাই।
টাস্কফোর্স কেজি স্কুলের পরিসংখ্যান তৈরি করবে, এসব স্কুলে কি কি পড়ানো হয়, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবই পড়ানো হয় নাকি শুধুই বাইরের বই পড়ানো হয়, শিক্ষকদের যোগ্যতা কেমন, কি প্রক্রিয়ায় শিক্ষক নিয়োগ করা হয়, তাদের বেতন কেমন, কোন কোন খাতে শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে বেতন নেওয়া হয়, স্কুল প্রতিষ্ঠা করার অর্থের উৎস কি, উপার্জিত অর্থ কোন খাতে ব্যয় করা হয়, ব্যয়ের ক্ষেত্রে সরকারি বিধিবিধান মানা হয় কিনা ইত্যাদি বিষয়গুলো টাস্কফোর্স দেখবে।
এ বিষয়গুলো সরকারের অনেক আগেই দেখা দরকার ছিল।দেশের ভবিষ্যত নাগরিকগন মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা এবং প্রাথমিক শিক্ষার পূর্বে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা রাষ্ট্র থেকেই পাওয়ার অধিকার রাখে। কিছু বেসরকারি সংস্থা বিশেষ করে ব্র্যাক এই প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ধারণাটির প্রচলন করে।
বর্তমানে সরকার বিষয়টিকে চালু করেছে এবং পর্যায়ক্রমে দেশের সর্বত্র প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সকল শিশুই প্রাথমিকে ঢোকার পূর্বে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা রাষ্ট্র থেকেই পাবে। কেজি স্কুল সম্পর্কে অনেক অভিযোগ, আবার এটিও সত্য যে, বাসার কাছে বাচাচাদের পাঠানোর কোন প্রতিষ্ঠান তো নেই। ধরুন, ঢাকা শহরের কথা। কোথায় আছে সরকারি প্রাথমিক স্কুল? খুঁজে পাবেন না।
পাওয়া গেল, বাসার আশে পাশে তো নেই। কিভাবে বাচচাদের স্কুলে নিয়ে যাবেন? আছে কোন শিশু বান্ধব যান-বাহন? হাজার ভীড় ঢেলে প্রতিদিন স্কুলে নেয়া যাবেনা। স্কুলে গেলেও দু’চারদিন পরেই শিশুরা সেখানে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে কারন সরকারী প্রাইমারী স্কুলে না আছে স্বাস্থ্য সম্মত প্রশাব-পায়খানার ব্যবস্থা, না শিক্ষকদের আধুনিক প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা, না আকর্ষণীয় বই পুস্তক পড়ানো হয় সেখানে আর খেলাধুলার ব্যবস্থাতো নেইই।
এনসিটিবর বইয়ে যা আছে তা কি বর্তমান যুগের চাহিদা মেটাতে পারে সি বিষয়টিও ভেবে দেখা দরকার। সরকারি নিয়ন্ত্রন কথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সরকারি নিয়ন্ত্রন মানেই তো হাজার ধরনের অনিয়ম, অসেবা, হয়রাণি আর সময় নষ্ট।
মানুষ বেসরকারি হাসাপাতালে যায় না কেন? সেখানে চিকিৎসা নেই, আছে হয়রানি। মানুষ বেসরকারি ব্যাংকে যায় কেন? কয়েক মিনিটের মধ্যে আপনি কয়েক লাখ টাকা তুলতে পারবেন, জমা দিতে পারবেন, ব্যাংকিং বিষয়ে যে কোন পরামর্শ তারা সুন্দরভাবে এবং ধৈয্যসহকারে আপনাকে দিবে। আর রাষ্ট্রায়াত্ব ব্যাংকে পাঁচশত টাকা তুলতে আপনাকে এক থেকে দুই ঘন্টা ব্যয় করতে হবে।
শিক্ষা ক্ষেত্রেও তো একই কথা। সরকারি স্কুল কলেজে পড়াশুনা খুব একটা হয়না, শিক্ষকগন প্রাইভেট নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যদিবস কম, কন্টাক্ট আওয়ার কম। ক্লাসে না আসলেও , শিক্ষার্থীরা ভাল না করলেও সমস্যা নেই কারন ওখানকার শিক্ষকগন সরকারি চাকরি করেন। তাই অভিভাবকগন চান স্মাট কোন বিদ্যালয়ে বাচাচাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষাটা গ্রহন করাতে।
সেখানে আধুনিক কিছু বই পড়ানো হয়, ব্যক্তিমালিকানায় বলে এক ধরনের প্রতিযোগিতা থাকে ফলে শিক্ষকদের তটস্থ থাকতে হয় মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের জন্য। মানসম্মত বিষয়টিতো ব্যাপক সেটি অন্যান্য স্কুলের ক্ষেত্রে যেমন সত্য তেমনি কিন্ডারগার্টেনর ক্ষেত্রেও সত্য।
সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলোর যখন বেহাল অবস্থা, সরকারি অফিসের, শিক্ষা বিভাগের যেখানে হাজার গলদ সেখানে সরকারের নিয়ন্ত্রনে নেওয়া কথাটা এলেই সংশ্লিষ্টদের মনে ভীতির সঞ্চার হয়। কিছুদিন আগে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে গিয়েছিলাম একটি কাজে। গিয়ে কিছু অভিজ্ঞাত হলো।
এই এত বড় বিল্ডিয়ে গ্রাম থেকে হাতে বা কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে যখন একজন শিক্ষক আসবেন তিনি তো এর কিছুই ঠিক পাবেন না কোথায় , কার কাছে কোন রুমে তাকে যেতে হবে। তিনি যখন ঘুরতে থাকবেন তখন দালাল শ্রেণির একদল লোক কিংবা ওই অফিসের কোন পিয়ন তাকে ধমক দিবে এই বলে কাকে খুঁজছেন, কেন এসছেন, কি কাজ ইত্যাদি।
আমাদের অফিস আদালতে কোথাও কোন ডিরেকশন নেই। কোন রুমে কি হয়, কার কাছে কি জন্য যেতে হবে তার কোন নির্দেশনা নেই। অধিদপ্তরে যাওয়ার আগে গিয়েছিলাম ঢাকার বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে। সেখানে এক কর্মকর্তার রুমে ঢুকলাম অনুমতি নিয়ে ।
পরিচয় দিলাম কিন্তু সৌজন্যবশতও বসতে বললেন না। খুব ব্যস্ততা দেখালেন। দেখলাম হাতে একটি পনের বিশ জনের লিস্ট, সেটি দেখে কি যেন দাগ দিচেছন। আমার সাথে কোন ধরনের কথা বলা, কিংবা কেন এসেছি ইত্যাদি কোন ধরনের আলাপই তিনি করলেন না।
এই তো সরকারি অফিসের অবস্থা। সেখানে আমরা শুধু সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিতে চাই কিন্তু নেয়ার পরে যে মানুষের হাজারো ভোগান্তিতে পড়তে হয় তার কোন কথা নেই, সুরুহা তো দুরের কথা। তবে অধিকাংশ কেজি স্কুল যেভাবে চলছে সেটি কারো কাম্য নয়। ইচেছমতো বেতন নেওয়া, উপযুক্ত শিক্ষক নেই, শিক্ষাদানের পরিবেশ নেই, শিক্ষকদের প্রশিক্ষনের কোন ব্যবস্থা নেই।
পারিবারিকাভাবে প্রতিষ্ঠিত কেজি স্কুলগুলোর অবস্থা আরও করুন।তবে সরকারের নিয়ন্ত্রনের নামে সুশিক্ষা থেকে যেন কোমলমতি শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত না হয়। অভিভাবকদের যেন কোন ফাঁদে ফেলা না হয় সেসব বিষয় দৃষ্টি দিতে হবে। কেজি স্কুলগুলো যেহেতু অলিতে গলিতে অবস্থিত, সেখানকার স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা যাতে হস্তক্ষেপ করতে না পারে সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে।
সরকার বিনামূল্যে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা যদি সবার জন্য নিশ্চিত করতে না পারে তাহলে কিন্ডারগার্টেনগুলো যাতে সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারে সরকারকে সে সব ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। ব্যবস্থা করতে হবে কেজি স্কুলের শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষনের।
কেজি স্কুলগুলো যে উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অর্থাৎ শিশুদের আনন্দের মাধ্যমে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান করা । সেই কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে যেন সরকার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করে সেটিই প্রত্যাশা।
লেখক: প্রাক্তন ক্যাডেট কলেজ শিক্ষক, বর্তমানে ব্রাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত।