তড়িঘড়ি করে অর্থ ব্যয়ের প্রতিযোগিতায় শিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্প - Dainikshiksha

তড়িঘড়ি করে অর্থ ব্যয়ের প্রতিযোগিতায় শিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্প

রাকিব উদ্দিন |

অর্থবছরের শেষ প্রান্তে পৌঁছে তড়িঘড়ি করে শিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্পসমূহের অর্থ ব্যয়ের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। সব প্রকল্পের কর্মকর্তাকেই দ্রুত টাকা খরচের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নানা অনিয়মের ঘটনাও ঘটছে। নজর নেই উন্নয়ন কাজের মানের দিকে। ক্রয় প্রক্রিয়া উপেক্ষা করে দরপত্র আহ্বান ছাড়াই শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও প্রচারণার কাজ দেয়া হচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।

গত বছরের তুলনায় এবার প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতিও কম। এছাড়া বর্তমানে জাতীয়ভাবে প্রকল্পের অগ্রগতির হার ৫১ শতাংশ। আর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের অগ্রগতি হলো ৪৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ।লক্ষ্যে পৌঁছাতে কয়েকটি প্রকল্পে কিছুটা ব্যর্থতা চিহ্নিত হলেও যেকোন মূল্যে ওইসব প্রকল্পের বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ের পরামর্শ দিচ্ছেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। এতে ঘন ঘন কর্মশালার আয়োজন করে মোটা অঙ্কের টাকা সম্মানীভাতা দেয়া হচ্ছে।

তবে শিক্ষা সচিব সোহরাব হোসাইন গত সপ্তাহে এক সভায় প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘অনিয়ম করলে কাউকেই ছাড় নয়, সরকারি অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতি করার ইচ্ছে থাকলে অন্যত্র চলে যান।’এদিকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে আরএডিপি’র জন্য এক হাজার কোটি বরাদ্দ দেয়ার প্রস্তাব করা হলেও ‘ব্যয় করা যাবে না’ এই অজুহাতে ওই প্রস্তাব নাকচ করা হয়।এ ব্যাপারে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) উপ-পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) এসএম বশীর উল্লাহ সংবাদকে বলেন, ‘অর্থবছরের প্রথমে এক হাজার কোটি টাকা বেশি দেয়া হলে আমরা তা ব্যয় করতে পারতাম।’শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অনুবিভাগের তথ্যানুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) মন্ত্রণালয়ের আওতায় ৭৩টি প্রকল্পের জন্য মোট চার হাজার ১২৬ কোটি ৫৩ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে।

প্রকল্পসমূহের অনকূলে গত জানুয়ারি পর্যন্ত মোট অবমুক্ত করা হয়েছে দুই হাজার ৮৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৫১ শতাংশ। এই সময়ে ব্যয় হয়েছে এক হাজার ২৪৩ কোটি এক লাখ টাকা, যা মোট বরাদ্দের প্রায় ৩০ শতাংশ। গত অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এডিপি বাস্তবায়নের অগ্রগতি ছিল ৪১ শতাংশ।

মন্ত্রণালয়ের এক নথিতে দেখা গেছে, গত ১ মার্চ পর্যন্ত মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) অধীন বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৩৪ শতাংশ, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের (ইইডি) ২৮ শতাংশ, কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের ২৬ শতাংশ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ২৬ শতাংশ, ব্যানবেইস এর ২৬ শতাংশ এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের অগ্রগতি ১৪ শতাংশ।

এর মধ্যে কারিগরি শিক্ষা অধিদফতর, ইউজিসি ও ব্যানবেইসের আর্থিক অগ্রগতি শতভাগ মিলে যাওয়ায় নানা প্রশ্ন উঠেছে।নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা অনুবিভাগের একজন কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, ‘তিন সংস্থার আর্থিক অগ্রগতি কোনক্রমেই শতভাগ হতে পারে না।

তিন সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা পরস্পর যোগসাজশে এই অগ্রগতি নির্ধারণ করে আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন। এটা প্রকৃত তথ্য নাও হতে পারে। এর মধ্যে অনিয়ম থাকতে পারে।’সেকায়েপ প্রকল্পে অনিয়মসরকারি ক্রয় নীতি উপেক্ষা করে দরপত্র ছাড়াই ‘সেকেন্ডারি এডুকেশন কোয়ালিটি অ্যান্ড অ্যাকসেস এনহ্যান্সমেন্ট প্রজেক্ট’র (সেকায়েপ) অধীনে প্রায় ৪৪ কোটি টাকার শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি (টিটিপি) ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে বইপড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার দায়িত্ব বেসরকারি সংস্থা ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র’কে দেয়া হচ্ছে। প্রকল্পের এ সংক্রান্ত বিষয়টি গতকাল ‘একনেক’র সভায়ও অনুমোদন দেয়া হয়েছে।অভিযোগ পাওয়া গেছে, কোন প্রকল্প ‘একনেক’ সভায় উপস্থাপনের আগে ‘প্রি-একনেক’ বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হয়।

এছাড়া দরপত্র ছাড়া বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রকে শিক্ষক প্রশিক্ষণের দায়িত্ব দেয়া যায় কিনা সে ব্যাপারে সিন্ধান্ত গ্রহণের জন্য বিষয়টি সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মন্ত্রণালয়।

এসব পদক্ষেপ উপেক্ষা করেই গতকাল (১০ মে) প্রকল্পটি একনেক সভায় উপস্থাপন করা হলে এর অনুমোদন দেয়া হয়। প্রকল্প কর্মকর্তা, মাউশি ও পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দরপত্র ছাড়া বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রকে কাজ দেয়ার বিরোধিতা করলেও একটি প্রভাবশালী মহলের চাপে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় তড়িঘড়ি করে প্রকল্প ‘একনেক’ সভায় তোলা হয়।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ‘সেকায়েপ’ প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক মোখতার আহমেদ সংবাদকে বলেন, ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রকে কাজ দেয়ার বিষয়ে একনেক সভা অনুমোদন দিয়েছে।’ তবে ‘প্রি-একনেক’ সভা ও মাউশি’র মতামত উপেক্ষা করে প্রকল্পটি একনেক সভায় উপস্থাপনের কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে প্রি-একনেক সভা হয়নি। ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতেও তোলা হয়নি_ এটা ঠিক। তবে একনেক সভায় অনুমোদন হলে প্রকল্পের পক্ষে কিছুই করার থাকে না।’

৫০টি কলেজের উন্নয়ন কাজ বন্ধপ্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার প্রায় সাড়ে তিন বছর পর ‘তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে নির্বাচিত বেসরকারি কলেজসমূহের (১,৫০০ কলেজ) উন্নয়ন প্রকল্প’র আওতাধীন ৫০টি কলেজের উন্নয়ন কাজ বন্ধ রেখেছে মাউশি। কারণ পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী না থাকা সত্ত্বেও ওইসব কলেজে ৪তলা ভবন নির্মাণের জন্য নির্বাচন করা হয়।

অভিযোগ রয়েছে, ওই ৫০টি কলেজের বেশির ভাগের গভর্নিংবডির সঙ্গেই স্থানীয় বিএনপি-জামায়াতের স্থানীয় নেতাকর্মীরা জড়িত রয়েছেন। এসব প্রতিষ্ঠানে ৪তলা ভবন নির্মাণের প্রয়োজনও নেই।

এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) এএস মাহমুদ মন্ত্রণালয়ের এক সভায় বলেন, ‘কলেজে ছাত্রছাত্রী না থাকলে ৪তলা ভবন করে তা যথাযথ ব্যবহার হবে না।

এক্ষেত্রে যে সকল কলেজে বেশি ছাত্রছাত্রী আছে এমন কলেজ নির্বাচন করা সমীচীন হবে।’মাউশি’র অধীনে বাস্তবায়ন হওয়া সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেসিপ) এর মাধ্যমে চলতি অর্থবছরে অ্যাকশন প্লান (কর্ম পরিকল্পনা) ১৬টি প্যাকেজের আওতায় ক্রয় কার্যক্রম (শিক্ষা উপকরণ কেনা ও এ সংক্রান্ত বিষয়) সম্পন্ন করার জন্য নির্ধারিত ছিল।

ইতোমধ্যে ১৬টি প্যাকেজের বিপরীতে টেন্ডার আহ্বান করা হলেও আইসিটি বিষয়ে একটি প্যাকেজের কার্যক্রম চলতি অর্থবছরে সম্পন্ন হবে না বলে প্রকল্প কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এজন্য তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে দায়ী করে বলেছেন, ‘চলতি অর্থবছরের আরএডিপিতে (সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) রাজস্ব ও মূলধন খাতে বরাদ্দ সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়নি।’ এছাড়াও সেসিপ প্রকল্পের একটি সিংহ ভাগ অর্থ ব্যয় হচ্ছে বিলাসবহুল গাড়ি কেনায়।কর্মকর্তাদের অদক্ষতা ও দূরদর্শিতার অভাবে ‘এস্টাবিস্নশমেন্ট অব অটিস্টিক একাডেমি’ প্রকল্পের কাজ এগুচ্ছে শম্বুক গতিতে।

এ নিয়ে মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা ও ব্যক্তিরা ক্ষুদ্ধ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রকল্পের অনুকূলে ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দের বিপরীতে গত মার্চ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে মাত্র এক কোটি ৩৪ লাখ ৯৯ হাজার টাকা, যা মোট রাদ্দের ৯ শতাংশ মাত্র। এই প্রকল্পের বরাদ্দকৃত আরএডিপি’র অর্থ সম্পূর্ণ ব্যয় করা সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে মাউশি’র মহাপরিচালক প্রফেসর ফাহিমা খাতুনও সন্দিহান। এজন্য মহাপরিচালক প্রকল্পের অনুকূলে অর্থছাড় এবং রাজউকের সাথে জমি রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য প্রকল্প পরিচালক সালমা আখতারকে নির্দেশ দিয়েছেন।

একই সঙ্গে তিনি প্রকল্পের জমি রেজিস্ট্রশন কাজে প্রকল্প পরিচালককে সহায়তা করার জন্য মাউশি’র উপ-পরিচালক ওসমান ভূইয়াকে দায়িত্ব দিয়েছেন।মোবাইল ব্যাংকিংয়ে উপবৃত্তির টাকা বিতরণে অনিয়মমাউশি’র পরিকল্পনা শাখার কর্মকর্তারা জানান, বিভিন্ন উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরের প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষার্থী উপবৃত্তির টাকা পায়নি। বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী দেরিতে টাকা পেয়েছে।

এ ব্যাপারে ‘মাধ্যমিক শিক্ষা উপবৃত্তি প্রকল্প, পর্যায়-২’ এর প্রকল্প পরিচালক আফজাল হোসেন বলেন, ‘মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ বিতরণ করায় চলতি বছরে কিছু জটিলতা দেখা দিলেও সামনের বছরগুলোতে আর এ ধরনের সমস্যা থাকবে না।”মাধ্যমিক শিক্ষা উপবৃত্তি প্রকল্প, পর্যায়-২’ প্রকল্পের অনুকূলে ২৭০ কোটি ৪১ লাখ টাকা বরাদ্দের বিপরীতে গত মার্চ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে এক কোটি ৯১ লাখ ৫০ হাজার টাকা, যা মোট বরাদ্দের শূন্য দশমিক ৭৮ শতাংশ টাকা মাত্র।

সূত্র : দৈনিক সংবাদ। ১১ মে, ২০১৬।

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.01599907875061