বছরের শুরুতেই বই উৎসবের পাশাপাশি শিশুর স্কুলে ভর্তি উৎসব শুরু হয়। গত সাত বছর ধরে বছরের প্রথমদিন শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দিয়ে ‘পাঠ্যপুস্তক উৎসব’ উদযাপন করা হচ্ছে। বরাবরের মতো এ বছরের শুরুতে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ ও ভর্তি শুরু হলেও উভয় ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নভাবে নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। বিশেষ করে পাঠ্যপুস্তক বিতরণে অর্থ আদায় এবং নামিদামি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ভর্তিতে উচ্চহারে মাসিক বেতন ও ফি আদায়ের অভিযোগটি বিশেষভাবে নজরে এসেছে। অভিযোগগুলো অতি ব্যাপক আকারে না হলেও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট হওয়ায় সাধারণ মানুষের মনে তা বিশেষ দাগ কেটেছে। পাঠ্যপুস্তক বিতরণে শর্তারোপ করে অর্থ আদায়ে যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ ও জড়িত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার খবর পাওয়া গেছে। তবে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগের বাইরেও কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্ন কিছু অভিযোগ অনেকদিন থেকে পাওয়া যাচ্ছে।
ইদানীং প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্যের প্রশ্নটি প্রায়ই উত্থাপিত হচ্ছে। শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে ব্যবহারের নানা পাঁয়তারা বর্তমান সমাজে আমরা প্রায়ই লক্ষ্য করছি। সম্প্রতি ভর্তি বাণিজ্যসহ নানা রকম অভিযোগ পাওয়া গেছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। ইতিমধ্যেই রাজধানী ঢাকা ও বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের কয়েকটি নামি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে শিক্ষার্থীর কাছ থেকে উচ্চহারে মাসিক বেতন ও অন্যান্য ফি আদায় বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এমন নির্দেশনা ও নিষেধাজ্ঞার ঘটনাও এই ইস্যুতে হয়তোবা প্রথম হলেও এর আগে শিক্ষাসংক্রান্ত নানা ইস্যুতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নানাবিধ নির্দেশনা জারি করেছে। সেগুলোর সবগুলো যথাযথভাবে মেনে চলা হয়েছে কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন আছে যথেষ্ট।
যে কোনো প্রতিষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার পূর্বশর্ত হলো যথাযথ আইন-কানুন এবং সেগুলোর তদারকি ও প্রয়োগ। শিক্ষার আইন-কানুন পাকাপোক্ত করার ভিত্তি হিসেবে বাংলাদেশে একটি শিক্ষানীতি রয়েছে। বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও শিক্ষানীতিটি এখনও ‘শিক্ষা আইন’ হিসেবে সংসদে পাস হয়নি। অবশ্য নীতিগতভাবে বিবেচনা করলে সেটিও এক ধরনের আইন। সাধারণত যে কোনো আইন অমান্য হলো দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু শিক্ষানীতি অমান্য করলে শাস্তির ব্যবস্থা আদৌ হয় না। যে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিঃসন্দেহে একটি অলাভজনক ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে শিক্ষার প্রসারে বিনিয়োগ করা হয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্যও বিনিয়োগের ব্যবস্থা আছে এবং সরকার আরোপিত কিছু নিয়ম-নীতি রয়েছে। কোনো না কোনো কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ও তদারকির ভিত্তিতে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এক কথায় বলা যায়, যে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরই একটি রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ রয়েছে। সেটি সরকারি হোক আর বেসরকারিই হোক।
কাজেই সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ব্যতীত গভর্নিং বডির নিজস্ব এখতিয়ারে বাড়তি অর্থ আদায়ের বিষয়টি শিক্ষা বাণিজ্যিকীকরণ ও শিক্ষায় সরকারি নিয়ন্ত্রণহীনতার আরও একটি দৃষ্টান্ত। গণমাধ্যমের কল্যাণে জানতে পেরেছি, কোনো কোনো স্কুলে শিক্ষার্থী বেতন দ্বিগুণ করা হয়েছে। পে স্কেল বাস্তবায়নের কারণে শিক্ষকদের পেছনে ব্যয় বেড়েছে এই অজুহাতে সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা না করে অতিরিক্ত বেতন ও ফি বাড়ানোর বিষয়টি চরম অন্যায্যতার শামিল। এটি শিক্ষানীতির পরিপন্থী। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিকট-অতীতে সরাসরি বেতন ও ফি বর্ধিত করার কোনো অভিযোগ পাওয়া না গেলেও নানা ইস্যুতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করার বিচ্ছিন্ন অভিযোগের কথা শোনা যায়।
শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় শুধু প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক স্তরে নয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত উচ্চশিক্ষাতেও অতিরিক্ত অর্থ আদায়সহ নানা অভিযোগ বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে এসেছে। গত বছরেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্তে সারাদেশে প্রতিবাদমুখর অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। প্রতিবাদের মুখে ভ্যাট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। পরে ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়গুলোর ওপর আরোপিত ৭.৫ শতাংশ ভ্যাটও স্থগিত করেন হাইকোর্ট।
সাধারণত প্রতি বছরই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং এ ধরনের অন্যান্য কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ইচ্ছামতো বাড়ানো হয় শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি। এসব টিউশন ফি বৃদ্ধি কিংবা কমানোর ক্ষেত্রে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা যথাযথভাবে কার্যকর আছে কি-না তা বাস্তবে দৃশ্যমান হয় না। প্রায়ই গণমাধ্যমে টিউশন ফির অভিযোগসহ নানাবিধ ভয়াবহ অনিয়মের তথ্য প্রকাশ পায়। এমনকি দেশের অনেক বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর পাঠদানের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা বন্ধ হয়নি। আর এগুলো ইউজিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী বন্ধ করার দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরই। ইউজিসি বিভিন্ন সময়ে কালো তালিকা প্রকাশ করলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক বন্ধের উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায় না বললেই চলে।
এ ছাড়াও বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর কয়েক দফা কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কোচিং বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই কোচিং বাণিজ্যের রমরমা চলছে। এমনকি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ব্যাপক আকারে কোচিং সেন্টারগুলো তাদের ব্যবসা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আর এসবের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত রয়েছে সরকারি ও বেসরকারি স্কুল-কলেজের বহু শিক্ষক। অথচ এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ওই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে কি-না তা আমার জানা নেই। অভিযোগ আছে, কোচিং ও প্রাইভেটে ভর্তি হওয়া না হওয়ার ভিত্তিতে অনেক সময় শিক্ষার্থীদের ওপর মানসিক প্রভাব পড়ে। শিক্ষা কার্যক্রমের ওপর যথাযথ তদারকির ব্যবস্থা না থাকায় মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ ও শিক্ষায় কোচিং বাণিজ্য এবং অতিরিক্ত ফি আদায়ের অভিযোগগুলো বর্তমানে মাথাচাড়া দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
শিশুদের বিনামূল্যে বই দিচ্ছে সরকার। এ খাতে সরকার প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে। কিন্তু কতিপয় মহলের কারণে সরকারের সেই ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। এসবের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বড় অংশের ঝোঁকই মুনাফার দিকে চলে যাবে। বিশেষ করে যেসব প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ভর্তি ফি ও বেতন বৃদ্ধির মাধ্যমে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করেছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
ড. সুলতান মাহমুদ রানা : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।