প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে উৎসে দৃষ্টি দিন - Dainikshiksha

প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে উৎসে দৃষ্টি দিন

এস এম নাদিম মাহমুদ |

কয়েকদিন আগে আমরা ক্যাফেটেরিয়াতে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলাম। ওই সময় আমার সঙ্গে ছিলেন আমার এক বাঙালি বন্ধু ও এক জাপানি সহপাঠী। আমরা খাচ্ছিলাম আর সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলাম। গবেষণার বিষয় ছাড়াও আমরা সেদিন সাম্প্রতিক সময়ে দেশের প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে কথা বলছিলাম। আমাদের দুই বাঙালির কথা ওই জাপানি সহপাঠী কিছু বুঝছিল না। সে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে আমাদের মুখের দিকে তাকিয়েছিল। এভাবে আমাদের কথাচ্ছলে সে হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা নাদিম তোমরা কী বিষয়ে কথা বলছ? তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে, তোমরা কোনো সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কথা বলছ? আমি তো অবাক হয়ে গেলাম। কী উত্তর দেব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কারণ, আমি যদি তার সঙ্গে এই জঘন্য বিষয়টি শেয়ার করি, তাহলে ও নিশ্চয় আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে খারাপ ধারণা পোষণ করবে।

একটু ভেবে বললাম, ওকে বিষয়টি সরাসরি শেয়ার করা যাবে না। তাই একটু ঘুরিয়ে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, আমরা সেদিন একটি মুভি দেখেছিলাম, সেই মুভির একটা সিকোয়েন্স নিয়ে কথা বলছিলাম। ছেলেটির নাম ইয়োশিমাসা ইকেচি। যাই হোক কিছুক্ষণ মুভির বিষয়ে আলোচনার পর হঠাৎ আমার মাথায় প্রশ্ন এলো, ওকে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলাম। ওকে বললাম, ডু ইউ নো লিক অব কোয়েশ্চেন পেপার? আই নো অনলি কোয়েশ্চেন পেপার বাট আই ডোন্ট নো লিকিং? হোয়াট দি রিলেশন বিটুইন লিক অ্যান্ড কোয়েশ্চেন পেপার? হঠাৎ করে তার একটা জরুরি ফোনকল আসায়, আমার উত্তর দেওয়ার আগে সে চলে গেল। এরপর বেশ কয়েকদিন কেটে গেল। আমার সঙ্গে দেখা হলেও সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়নি। একদিন আমার ডেক্সে এলো ইকেচি। সে গুগুল করছে, কোয়েশ্চেন পেপার লিক। আর যে পেজগুলো সাজেস্ট করেছে গুগুল তার সব বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রের শিরোনাম। যেখানে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সংবাদগুলোই ছিল। এরপর সে আমাকে বলল, নাউ আই আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াইট ইজ কোয়েশ্চেন পেপার লিকিং। বাট ইট ইজ টোটালি আননোন টু আস। উই ডোন্ট নো দি মেনিং অব দিজ।

আমি লজ্জায় পড়ে গেছি। সে শুধু এটুকু বলল, ইয়াবাই দামে (জাপানিজ)। তার মানে এটি সত্যি খারাপ বিষয়। এরপর তার স্কুলে ঘটে যাওয়া একটি বিষয় শেয়ার করল। সে যখন জুনিয়র স্কুলের ছাত্র, তখন স্কুলে তার পরীক্ষা চলাকালে তার প্রশ্নপত্রটি বাতাসে উড়ে অন্য এক শিক্ষার্থীর কাছে চলে গিয়েছিল। সে প্রশ্নপত্রটি আনতে গিয়ে দেখেন, তার উত্তরপত্র নিয়ে নেওয়া হয়েছে। শিক্ষক ভেবেছিলেন, ইকেচি তার সহপাঠীর কাছে কিছু জানতে গিয়েছিল। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ওই ঘটনায় তাকে পরীক্ষা দিতে দেওয়া হয়নি। ওই স্মৃতি মনে করে সে বলছিল, পরীক্ষা মানে হলো পরীক্ষা। এখানে কে কতটা উত্তর দেওয়ার চেয়ে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, কে কতটা নিয়মের মধ্যে থেকে লিখছে সেটাই মুখ্য বিষয়। তাই স্টিল আমি লিকিং কোয়েশ্চেন পেপার বিষয়টি নিয়ে অন্ধকারে রয়েছি। তবে এটুকু বুঝেছি, ডিস্টিট এক্সামিনেশন কন্ডিশন চলেছে।

একজন জাপানি সহপাঠীর কাছ থেকে বিষয়টি শোনার পর সত্যিই আমার অনেক কষ্ট লেগেছে। দিনের পর দিন সিরিজ প্রশ্নপত্র ফাঁসে আমাদের পাবলিক পরীক্ষার যে গৌরব-সম্মান ছিল, তা ধুলোয় লুটিয়ে গেছে। এখন পরীক্ষাগুলো প্রহসনের উজ্জ্বলবর্তিকা। আমাদের দেহে দুই ধরনের স্নায়ু থাকে। মজ্জাগত স্নায়ুগুলোকে মূলত মেরুদণ্ডের শক্ত হাড়গোড়ে ঢাকা থাকে, যাতে বাইরের কোনো আঘাত না লাগে। শিক্ষা হলো তেমনি একটি দেশের স্নায়ু, যার আঘাত থেকে রক্ষার দায় একটি রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র যখন সেই স্নায়ুর নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, তখন ধরে নেওয়াই শ্রেয়, এই রাষ্ট্রের কপালে দুঃখই রয়েছে। একটা জাতিকে ধ্বংস করতে আর কী লাগে? আজ যারা ক্ষমতায় আছেন, তারা হয়তো একদিন ক্ষমতায় থাকবেন না; কিন্তু যে প্রজন্মগুলো তৈরি হচ্ছে, সেই প্রজন্মগুলোকে তো এই জাতি অস্বীকার করতে পারবে না। তারা এক সময় দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যাবে। অপশিক্ষা গ্রহণের খেসারতে হয়তো দেশে অপশাসন পাবে, তাতে আর সন্দেহ নেই। আপাতদৃষ্টিতে প্রশ্নপত্র ফাঁস খবরগুলো দেখে মনে হয়েছে, আগের মতো প্রশ্নপত্র আর মধ্যরাতে ফাঁস হচ্ছে না। যা হচ্ছে, তা পরীক্ষার কয়েক ঘণ্টা আগে। তার মানে হলো, সরকার কিছুটা হলেও বিজি প্রেসের প্রতি কঠোরতায় গেছে, যার কারণে প্রশ্নপত্র ফাঁস কেবল কেন্দ্র থেকে হচ্ছে।

এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে এই প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানো যায়? প্রশ্ন ফাঁস রোধে কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি-

১. পরীক্ষা শুরুর দেড় ঘণ্টা আগে পরীক্ষা কেন্দ্রে শিক্ষার্থীদের উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক করা হোক; ১ ঘণ্টা আগে সব গেট বন্ধ থাকবে;

২. পরীক্ষার কেন্দ্রে ঢোকার আগে শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন জমা রাখা, যাতে করে তারা পরীক্ষা শুরুর আগে ব্যবহার করার সুযোগ না পায়;

৩. পরীক্ষার দায়িত্বরত কর্মচারী, শিক্ষক, পরীক্ষক সবার মোবাইল ফোন সংগ্রহ করা, যাতে করে তারা কোনো মোবাইল ফোন বহন করতে না পারে। যেসব কর্মচারী-কর্মকর্তার কাছে মোবাইল ফোন, ক্যামেরা কিংবা ডিজিটাল ডিভাইস পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। একই সঙ্গে চাকরিচ্যুত করা;

৪. প্রশ্নপত্র নিয়ন্ত্রণ করবেন একজন ম্যাজিস্ট্রেট। প্রতিটি কেন্দ্রের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন। তিনি প্রশ্নপত্র বিতরণ করবেন। তার দায়িত্ব থাকবে ঠিক ২০-৩০ মিনিট আগে প্রশ্নপত্র পাঠানো, যাতে করে কেউ প্রশ্নপত্র ফাঁস করতে না পারে। আর এমন অভিযোগ যদি পাওয়া যায়, তবে সেই ম্যাজিস্ট্রেট ও তার অধীনদের দায়ী করে মামলা ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা;

৫. কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র বিতরণের পুরো এলাকা ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ সিসিটিভির মাধ্যমে মনিটর করা, যাতে অভিযোগ উঠলে সঙ্গে সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা যায়;

৬. যদি ফেসবুকে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়, তা শৃঙ্খলা বাহিনীরা সংশ্নিষ্ট আইডিগুলো ট্র্যাকিং করে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা;

৭. অভিন্ন প্রশ্নপত্র ফাঁস পুরো দেশের জন্য হুমকি। এক জায়গায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে তা পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। তাই এই সিদ্ধান্ত থেকে বের হতে হবে। আগের মতোই শিক্ষা বোর্ডগুলোর অধীনে ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়াই শ্রেয়। আমরা যদি এই বিষয়গুলো নজরে রাখতে পারি, তাহলে প্রশ্নপত্র ফাঁস পুরোপুরি না হলেও তা রোধ করা যাবে বলে বিশ্বাস করি।

 

সৌজন্যে: সমকাল

চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পরীক্ষার আগেই হবু শিক্ষকদের হাতে পৌঁছে যায় উত্তরপত্র: ডিবি - dainik shiksha পরীক্ষার আগেই হবু শিক্ষকদের হাতে পৌঁছে যায় উত্তরপত্র: ডিবি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0062801837921143