সেই কবে, কখন একটা গান শুনেছিলাম মনে নেই।তবে গানের দু’তিনটে মাত্র কলি মনে আছে। দেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট আর বৈশাখী ভাতার অনন্ত প্রহর গুণবার সাথে অশান্ত কোন এক প্রেমিকা-হৃদয়ের বেদনার ব্যঞ্জনায় তার প্রেমিকবরের জন্য নিবেদিত গানের কলি দু’টোর খুব মিল যেন খুঁজে পাওয়া যায়-
‘সকালের ট্রেন ও আইলো,
বিকেলের গাড়ি ও আইলো,
তুমি আইলা কই, বন্ধুরে——? ‘
অপেক্ষার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়। অপেক্ষা বড় কঠিন কাজ।অপেক্ষা কতো জনের সহে ? অপেক্ষায় ধৈর্য ধারণ করার শক্তিই বা ক’জনের থাকে ?
দেশে পাঁচ লক্ষ এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী। আট-নয় হাজার এমপিও বিহীন প্রতিষ্ঠানে আরো প্রায় লক্ষাধিক । এমপিওভুক্ত অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সৃষ্ঠ শাখা পদ, আইসিটি, উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ও বিপনন, লাইব্রেরিয়ান ইত্যাদি বিষয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের ১৩-১১-১১’র পরে কোন এমপিও নেই।এরা সকলে সাধারণতঃ ‘বেসরকারি শিক্ষক’ বলে পরিচিত হন। এমপিওভুক্ত, এমপিওবিহীন ও নন এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীর দুঃখ-দুর্দশা সঙ্গত কারণে ভিন্ন হলে ও কতেক অভিন্ন । কেননা, তারা ‘বেসরকারি’ নামের এক কালো সূতোয় একসূত্রে গাঁথা। দেশের বেসরকারি শিক্ষকদের মনে অনেক ব্যথা, অনেক কষ্ট। তাদের আজ যেন ‘বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না ‘র মতো অবস্থা। এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীর পাঁচ লক্ষ পরিবারে কম করে হলে ও কুড়ি লক্ষ পোষ্য জন । এতো জন মানুষের মনে একটি অভিন্ন কষ্ট । কষ্টটি আর কিছু নয়, সেটি বাঙ্গালির নববর্ষ বা বৈশাখি ভাতা ও ইনক্রিমেন্ট না পাবার কষ্ট । এ কষ্টটি ভুলে যাবার নয়, বাদ দেবার ও নয় । সবার কাছে বলা ও যায় না আবার সহা ও যায় না।
গাছের গোড়া কেটে ডগায় পানি ঢাললে যেমন গাছ বাঁচার আশা থাকে না, তেমনি শিক্ষকের কল্যাণ ছাড়া মান সম্মত শিক্ষার আশা গুড়ে বালি বৈ কিছু নয়।আমাদের শিক্ষার দৈন্য দশা ততদিন গুচবে না, যতদিন না আমাদের শিক্ষকগণ প্রফুল্ল চিত্তে স্বীয় পেশায় ব্রতী হতে পারবেন । বৈশাখী ভাতা আর বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট না পেলে মনের কষ্ট ঘুচে কী করে ? এ কী এমপিও শিক্ষকদের অন্যায় দাবী ? এ কী তাদের অপ্রাসঙ্গিক ও অযৌক্তিক চাওয়া ? আর যদি তা তাদের ন্যায্য পাওনা হয়ে থাকে, তবে তাদের এ সব থেকে বঞ্চিত রাখার মানে কী ? কারো ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে রাখা চরম এক জুলুম ছাড়া অন্য কিছু নয় ।
বৈশাখ,জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র পেরিয়ে এখন আশ্বিন মাস। শিশির স্নাত শরৎ আমাদের সবার আঙ্গিনায়। আরেক বোশেখের মাঝপথে আমরা।বৈশাখি ভাতা প্রাপ্তির উল্লাস সকলের মনে। কেবলি হতাশায় বার বার নিমজ্জিত এ দেশের পাঁচ লক্ষ এমপিও শিক্ষক-কর্মচারী ও তাদের পরিবার পরিজন। তারা আজো জানেন না, তাদের বৈশাখী ভাতা না পাবার হেতুটা কী ? তাদের একটু সান্ত্বনার স্বরে আজো বলেনি কেউ, ‘গত বার বৈশাখে ভুলে গিয়েছিলাম। আগামীতে দেয়া যাবে।’ একেবারে নিশ্চুপ সবাই। যেন তাদের চোখ,কান, মুখ কোনটিই নেই। থাকলে তারা দেখতে পেত, শুনতে পেত,আশ্বাসের বাণী শোনাতে পারতো। তাদের হৃদয় থাকলে উপলব্ধি করতে পারতো।
আমাদের এ দেশে শিক্ষকদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করবার এখনই উপযুক্ত সময় যাচ্ছে । স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি এখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়।মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত আমাদের বর্তমান সরকার। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সরকার, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এক-আধখান মাত্র জাতীয়করণ করা ছাড়া বড় ধরণের জাতীয়করণের গৌরব এ দেশে আর কোন সরকারের নেই। আছে আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার । জাতির জনক একত্রে ৩৭০০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং তাঁর কন্যা জননেত্রি শেখ হাসিনা এক সাথে ২৬০০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে এ দেশের ইতিহাসে অনন্য মর্যাদায় তাঁরা চির অমর হয়ে গেছেন।এখন আবার স্কুল-কলেজ জাতীয়করণের আরেক মহা উদ্যোগ সকলেই বিস্ময়ের সাথে প্রত্যক্ষ করছেন ।
জাতীয় বেতন স্কেলের সুস্পষ্ট নির্দেশনা ৫% বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট।গত জুলাই মাস থেকে জাতীয় বেতনস্কেলের আওতাভুক্ত একমাত্র এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী ছাড়া সবার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হয়েছে। সম্পূর্ণ জাতীয় বেতন স্কেলের অন্তর্ভুক্ত এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেলায় তার ব্যত্যয় কেন ঘটল, তা বুঝে ও বুঝে ওঠা যাচ্ছে না।
জুলাই গত হয়ে আগস্ট পেরিয়ে আমরা এখন সেপ্টেম্বরের শেষাশেষিতে।শুনা যাচ্ছে, আগামী ২৫ তারিখে এমপিও সভা অনুষ্ঠিত হবে। অনেক এজেন্ডার মধ্যে ইনডেক্সধারী শিক্ষকগণের বকেয়ার বিষয়টি ও আছে বলে জেনেছি । ইনুেক্সধারী মানেই এমপিওভুক্ত । অন্ততঃ, বকেয়ার কথা শুনে অনেকেই উচ্ছসিত হয়েছেন। সে কোন বকেয়া তা ভাল করে না জানলে ও অনেকের ধারণা সেটি বৈশাখি ভাতা ও ইনক্রিমেন্টের বকেয়া হবে । উৎসব ভাতা বকেয়া হিসেবে প্রাপ্য হয় কীনা জানিনে, তবে ইনক্রিমেন্টের বকেয়া তো জুলাই থেকে নিঃসন্দেহে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীগণ প্রাপ্য হন । উৎসব ভাতা বকেয়া না হলেও আগামী বৈশাখে যেন সকলের সাথে তারা যাতে পান, তা এখনি স্পষ্ট করা অপরিহার্য।
সামনে পূজোর মাস।শারদীয় দূর্গা পূজোয় দেশের হিন্দু শিক্ষক-কর্মচারীদের অনেক খরচ।হিন্দু ধর্মে অনেক পূজো-পার্বণ থাকলে ও দূর্গা পূজো সর্ববৃহৎ উৎসব তাদের। তাই সেপ্টেম্বর মাসের বেতনটি পূজোর আগে কেবল ছাড় নয়, প্রাপ্তির বিষয়টি ও নিশ্চিত করা না হলে তাদের পুরো পূজোর আনন্দটিই মাটি হয়ে যাবে ।
বৈশাখি ভাতা ও ইনক্রিমেন্টের বিষয়টি যেন অবিলম্বে আসন্ন এমপিও সভায় ফয়সালা হয় – সে প্রত্যাশাটুকু কেবল এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীর নয়, দেশের সকল মানুষের ও।
লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাই ঘাট, সিলেট