ভাল করছে গ্রাম - দৈনিকশিক্ষা

ভাল করছে গ্রাম

বিভাষ বাড়ৈ |

১৭ উপজেলায় প্রাইমারীতে কোন খুদে শিক্ষার্থী ফেল করেনি, ১০৫ উপজেলায় ইবতেদায়ীতে সবাই পাস বিনামূল্যের বই সঠিক সময়ে পৌঁছা, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সচেতনতাই শহরকে পেছনে ফেলে গ্রামে জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছে

যে কোন পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরই গ্রাম ও শহরের ফলে বৈষম্যসহ শিক্ষা সংকটের একটি উদ্বেগজনক চিত্র সামনে চলে আসে। আর এ ক্ষেত্রে শহরের চেয়ে সব সময়েই অনেক পেছনে থাকে গ্রামের অবস্থান। কিন্তু এবারের দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত দেশের সর্ববৃহৎ দুই পাবলিক পরীক্ষা পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণী সমাপনীর ফলে পাওয়া গেল ব্যতিক্রমী এক চিত্র। ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রাথমিক সমাপনীতে ১৭ উপজেলায় একজন খুদে শিক্ষার্থীও ফেল করেনি। ইবেতেদায়ীতে ফেল করেনি ১০৫ উপজেলার কোন শিশু। আলো ছড়িয়েছে এসব উপজেলার সকল শিশু। পাসের হারে আগের মতো তফাৎ নেই এক জেলার সঙ্গে অন্য কোন জেলারই। প্রায় একই চিত্র অষ্টম শ্রেণীর জেএসসিতেও। ৯১ শতাংশেরও বেশি পাস করেছে প্রায় সব জেলা-উপজেলাতেই।

প্রাথমিক শিক্ষার ফলের এই চিত্রকে শহর-গ্রামের বৈষম্য নিরসনে বড় ধরনের অগ্রগতি অভিহিত করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষার এই চিত্র ইতিবাচক। শিক্ষাবিদদের অভিমত, বছরের প্রথম দিনই বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিতরণ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, সকল বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে পড়ালেখা এবং পরীক্ষায় পাস না করলে পরবর্তী ক্লাসে ভর্তি হওয়া যাবে না এমন চিন্তুা থেকে পড়ালেখায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের আগ্রহ বৃৃদ্ধি পাওয়া এই সাফল্যের পেছনে কাজ করেছে। এখন শহরের মতো গ্রামের একটি শিশু ও তার পরিবারকে ভাবতে হচ্ছে পরীক্ষায় পাস না করলে পরবর্তী ক্লাসে ভর্তি হওয়া যাবে না। তবে একই সঙ্গে বিশেষজ্ঞরা এও বলছেন, তবে এই ‘ভাল ফলে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। শিক্ষার মানোন্নয়নে বিশেষভাবে জোর দিতে হবে।’ বৃহস্পতিবার একই দিনে প্রকাশ হয় দেশের সর্ববৃহৎ দুটি পাবলিক পরীক্ষার ফল। এবার প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছে খুদে শিক্ষার্থীরা।

পাস করেছে ৯৮ দশমিক ৫১ শতাংশ। সমমানের মাদ্রাসার ইবতেদায়ী শিক্ষা সমাপনীতে পাস করেছে ৯৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ। মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে দুই লাখ ৮৭ হাজার ৮৪৬। সাত বিভাগের মধ্যে ৯৯ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ নিয়ে শীর্ষে বরিশাল, ৬৪ জেলার মধ্যে ৯৯ দশমিক ৯২ শতাংশ নিয়ে শীর্ষে আছে মুন্সীগঞ্জ। ৫০৮ উপজেলা/থানার মধ্যে ১৭টিতে শতভাগ শিশু পাস করেছে। অর্থাৎ এসব উপজেলায় কোন শিক্ষার্থী ফেল করেনি। অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে অষ্টম শ্রেণীর জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষার্থীরা। জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় এবার পাস করেছে ৯৩ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা এতদিন যেখা গেছে, প্রতিটি পরীক্ষায় ফল ভাল করা প্রতিষ্ঠান ও এলাকার মধ্যে থাকে রাজধানী ঢাকা ও বিভাগীয় শহরের কিছু নামী দামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এবারের প্রাথমিক, ইবতেদায়ী ও জেএসসি পরীক্ষার ফল নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় জেলাওয়ারি ফলে দেখা গেছে, ১৭ উপজেলায় শতভাগ পাস ছাড়াও প্রায় প্রতিটি জেলাতেই পাসের হার ৯৭ শতাংশের ওপরে। অর্ধেকেরও বেশি জেলায় পাসের হার ৯৮ শতাংশের বেশি। যেসব উপজেলায় কোন শিশুই ফেল করেনি সে উপজেলাগুলো হচ্ছে-যশোরের চৌগাছা, মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখান ও লৌহজং, নাটোরের লালপুর, বাগাতিপাড়া, কুষ্টিয়ার খোকসা, নবাবগঞ্জের নাচোল, পিরোজপুরের নাজিরপুর ও জিয়ানগর, ব্রাহ্মণবাডিয়ার নবীনগর, নওগাঁর আত্রাই ও সাপাহার, দিনাজপুরের পার্বতীপুর ও কাহারোল, ঝালকাঠির রাজাপুর, ফরিদপুরের ভাঙ্গা এবং কিশোরগঞ্জের নিকলী।

এছাড়া জয়পুরহাটে পাস করেছে ৯৮ দশমিক শূন্য শতাংশ, বগুড়ায় ৯৮ দশমিক ৭৮, নওগায় ৯৯ দশমিক ৫৪, রাজশাহীতে ৯৭ দশমিক ৮০, নাটোরে ৯৯ দশমিক ৫২, সিরাজগঞ্জে ৯৮ দশমিক ৮১, জিনাইদহে ৯৯ দশমিক ২১, নড়াইলে ৯৯ দশমিক ২২, সাতক্ষিরা ৯৯ দশমিক ৩৫, টাঙ্গাইলে ৯৯ দশমিক ৯৯ দশমিক ৩৭ পাস করেছে।

এছাড়া গাজীপুরে ৯৯ দশমিক ৫৩, মানিকগঞ্জে ৯৯ দশমিক ৪৮, নারায়ণগঞ্জে ৯৯ দশমিক ৬৩, মুন্সীগঞ্জে ৯৯ দশমিক ৯২, গোপালগঞ্জে ৯৯ দশমিক ৪৬, ব্রাহ্মণবাডিয়ায় ৯৯ দশমিক ৭৭, চাঁদপুরে ৯৯ দশমিক ৬২, নোয়াখালীতে ৯৯ দশমিক ৯, কক্সবাজারে ৯৯ দশমিক ৬০, রাঙ্গামাটি ৯৯ দশমিক ১৯, বরিশালে ৯৯ দশমিক ১৭, পিরোজপুরে ৯৯ দশমিক ৪৩, ঝালকাঠিতে ৯৯ দশমিক ৩৬, বড়গুনায় ৯৯ দশমিক ২৯, পঞ্চগড়ে ৯৯ দশমিক ১৪ শতাংশ শিশু শিক্ষার্থী পাস করেছে। এছাড়া ২৬ জেলায় ৯৮ শতাংশের বেশি এবং ৯ জেলায় ৯৬ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী পাস করেছে। এদিকে ১৮ উপজেলায় শতভাগ পাস ছাড়াও দেখা গেছে, ২৩৩টি উপজেলায় ৯৯ শতাংশেরও বেশি শিক্ষার্থী পাস করেছে। বাকি অর্ধেক উপজেলায় ৯৮ শতাংশ এবং বাকি উপজেলায় ৯৭ শতাংশ শিক্ষার্র্থী পাস করেছে। ইবতেদায়ী শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় ১০৫ উপজেলায় শতভাগ পাস ছাড়াও বাকি প্রায় সব উপজেলায় ৯৮ শতাংশের বেশি পাস করেছে।

ফলাফলে সকল জেলা ও উপজেলায় ভাল ফলের প্রায় একই চিত্র অষ্টম শ্রেণীর জেএসসিতেও। ৯১ শতাংশেরও বেশি পাস করেছে প্রায় সকল জেলা-উপজেলাতেই। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের ১৯ জেলার জেএসসি পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঢাকা মহানগরীতে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৯ হাজার ২১৪ এবং গড় পাসের হার ৯৫ দশমিক ৭০ শতাংশ, ঢাকা জেলায় জিপিএ-৫ পেয়েছে চার হাজার ৬২৬ এবং গড় পাসের হার ৯১ দশমিক ৩৪ শতাংশ, গাজিপুরে জিপিএ-৫ আট হাজার ৩৭৯ এবং গড় পাসের হার ৯৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ, নারায়ণগঞ্জে জিপিএ-৫ চার হাজার ১৪১ এবং গড় পাসের হার ৯২ দশমিক ১৬ শতাংশ, নরসিংদীতে জিপিএ-৫ চার হাজার ২১৬ জন এবং গড় পাসের ৯৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ, মুন্সীগঞ্জে জিপিএ-৫ ৭৫১ এবং গড় পাসের হার ৮৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ।

এছাড়া মানিকগঞ্জ জিপিএ-৫ পেয়েছে ৮৯৫ এবং গড় পাসের হার ৮৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ, টাঙ্গাইলে জিপিএ-৫ ৯ হাজার ৯৫৯ জন এবং গড় পাসের হার ৯৫ দশমিক ০৩ শতাংশ, ফরিদপুরে জিপিএ-৫ এক হাজার ৫৮৭ জন এবং পাসের হার ৮৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ, মাদারীপুরে জিপিএ-৫ এক হাজার ৪৫৬ জন এবং গড় পাসের হার ৯১ দশমিক ৭১ শতাংশ, শরীয়তপুরে জিপিএ-৫ ৫৭৪ জন এবং গড় পাসের হার ৮৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ, রাজবাড়ীতে জিপিএ-৫ পেয়েছে এক হাজার ১৫০ জন এবং গড় পাসের হার ৮৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ, গোপালগঞ্জে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯০৮ জন এবং পাসের হার ৯০ দশমিক ০৫ শতাংশ, ময়মনসিংহে জিপিএ-৫ ছয় হাজার ৯২১ জন এবং পাসের হার ৯১ দশমিক ৩৭ শতাংশ, কিশোরগঞ্জে জিপিএ-৫ এক হাজার ৯৪৪ জন এবং গড় পাসের হার ৮১ দশমিক ৮১ শতাংশ, নেত্রকোনায় জিপিএ-৫ এক হাজার ২৯৬ জন এবং পাসের হার ৮৩ দশমিক ২৫ শতাংশ, জামালপুরে জিপিএ-৫ পাঁচ হাজার ৭৪১ জন এবং পাসের হার ৯৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ এবং শেরপুরে জিপিএ-৫ পেয়েছে দুই হাজার ৫০৮ জন এবং এখানে গড় পাসের হার ৯৫ দশমিক ৫২ শতাংশ।

শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী ডা. মোস্তাফিজুর রহমান দু’জনেই বলেছেন, এবার পরীক্ষাগুলোর সব সূচকেই ভাল করেছে শিক্ষার্থীরা। দুজনেই তাদের প্রতিক্রিয়ায় বললেন, ফলাফলের সব সূচকে ভাল করায় আমরা সন্তুষ্ট। বিনামূল্যে সঠিক সময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই পৌঁছে দেয়া, নকলবিরোধী প্রচারণাসহ সরকারের বিভিন্নমুখী উদ্যোগ ও তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারেই পাসের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষার মানে উন্নতি ঘটেছে। সারাদেশেই শিক্ষার্থীরা ভাল করেছে।

জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শেখ একরামুল কবির বলছিলেন, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল মনে করেন, বিনামূল্যের পাঠ্যবই, শিক্ষক প্রশিক্ষণ যেমন আছে তেমনি পরীক্ষায় পাস না করলে পরবর্তী ক্লাসে ভর্তি হওয়া যাবে না এমন চিন্তুা থেকেই পড়ালেখায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বৃৃদ্ধি পেয়েছে। এসব কারণে কেবল রাজধানী নয়, উপজেলা পর্যায়েও ফলের ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শেখ একরামুল কবীর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, শিক্ষার পরিবেশ এবং সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, গোড়াতেই শিক্ষার্থীরা যে উৎসাহ পাচ্ছে এটা ধরে রাখতে হবে।

সুত্র: জনকণ্ঠ

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0041248798370361