শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনেই চলতি বছরের পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন করা হয়। কার্যত পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল গত বছরের এপ্রিলে। ওই সময়েই এ বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে (এনসিটিবি) একটি গোয়েন্দা সংস্থার তৈরি করা প্রতিবেদন হস্তান্তর করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ওই প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ ছিল, সেগুলোর পুরোপুরি বাস্তবায়ন ছাড়াই ঢালাওভাবে পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন আনা হয়। এতে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা বইয়ের পাঠ্যসূচি প্রণয়ন ও সম্পাদনায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনসহ প্রগতিশীল শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে কমিটি করার সুপারিশ ছিল। জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, এই কমিটি করা হয়নি।
এদিকে ষষ্ঠ শ্রেণির ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বইয়ে ভুলের বিষয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আলেমদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ ছিল। এই কমিটিও করা হয়নি বলে জানান চেয়ারম্যান।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্যপুস্তকে ব্যাপক পরিবর্তন কার নির্দেশে এবং কীভাবে হয়েছে, তা এত দিন আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ স্বীকার করেনি। এ নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়। সংশ্লিষ্ট দুই মন্ত্রণালয়ও এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলেনি।
এনসিটিবির একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেছেন, ওই প্রতিবেদনের পর গত বছরের আগস্ট মাসে জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির (এনসিসিসি) সভায় পরিবর্তনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। সেখানে এনসিটিবিকে আরেকটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়। পদাধিকারবলে এনসিসিসির সভাপতি মাধ্যমিকের কমিটিতে শিক্ষাসচিব (বর্তমানে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব) এবং প্রাথমিকের কমিটিতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষাসচিব।
কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক সংগঠন পাঠ্যবই থেকে যেসব বিষয় বাদ দেওয়ার দাবি করেছিল, এবারের পরিবর্তন তার সঙ্গে প্রায় হুবহু মিলে গেছে। ১৭টি লেখা যুক্ত ও ১২টি লেখা বাদ দেওয়া হয়েছে। পরিবর্তনের এসব বিষয়বস্তু নিয়ে গত জানুয়ারিতে একটি দৈনিকে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
এত দিন এই পরিবর্তনের জন্য সবাই এনসিটিবিকে দোষারোপ করছিল। কিন্তু এখন জানা গেল, এর সঙ্গে মন্ত্রণালয়ও যুক্ত ছিল। জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা গত মঙ্গলবার তাঁর কার্যালয়ে বলেন, বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে এনসিসিসির সভায় এই পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত হয়। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনেই পরিবর্তন করা হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইন গত মঙ্গলবার বলেন, এনসিসিসির সিদ্ধান্তের আলোকেই পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিষয়টি বিচারাধীন থাকায় এর বাইরে তিনি কিছু বলতে রাজি হননি।
এনসিটিবির একজন সদস্য বলেন, এবারের বই নিয়ে বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আগামী বছরের পাঠ্যবইয়ে কিছু পরিবর্তন আনতে তাঁরা মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দেবেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং এনসিটিবির সূত্র জানায়, গত বছরের এপ্রিলে এনসিটিবিতে একটি বিশেষ প্রতিবেদন পাঠায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একটি গোয়েন্দা সংস্থার তৈরি করা ওই প্রতিবেদনে পাঠ্যপুস্তক ও পাঠ্যসূচি নিয়ে হেফাজতে ইসলামসহ কয়েকটি ইসলামপন্থী সংগঠনের দাবিদাওয়ার বিবরণ তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে পাঠ্যবইয়ে আগের যেসব বিষয় বাদ দিয়ে নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তারও বর্ণনা ছিল।
তবে ওই প্রতিবেদনে সরাসরি কোনো বিষয় বাদ বা যোগ করার সুপারিশ করা হয়নি। এতে পাঠ্যসূচিতে ইসলামি চেতনা ও শিক্ষামূলক গল্প, কবিতা ও রচনা বৃদ্ধি করা যেতে পারে বলে সুপারিশ করা হয়।
প্রতিবেদনে পাঠ্যবইয়ে ভুলত্রুটির জন্য এনসিটিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দায়ী করা হয়। এ জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়। প্রয়োজনে এনসিটিবির প্রধান সম্পাদক পদে পরিবর্তন আনার সুপারিশ করা হয়। উল্লেখ্য, এবারে পাঠ্যবইয়ে ভুলের জন্য ইতিমধ্যে সংস্থাটির প্রধান সম্পাদক প্রীতিশ কুমার সরকার এবং আরও একজন কর্মকর্তাকে সরিয়ে দিয়ে ওএসডি করা হয়েছে।
এনসিটিবির দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ওই বিশেষ প্রতিবেদনের পর আগস্টে মন্ত্রণালয় তড়িঘড়ি এনসিসিসির সভা ডাকে। সেখানেই সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ‘রেফারেন্স’ দিয়ে বইয়ের বিষয়বস্তুতে পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত হয়।
সৌজন্যে: প্রথম আলো