আমাদের দেশে শিক্ষার মান নিয়ে আজ ক’বছর ধরে নানা কথা উঠেছে। মানসম্মত শিক্ষা আমাদের দেশ থেকে যেন উঠেই যাচ্ছে । শিক্ষায় সরকারের নানামুখী উদ্যোগের পর ও এর কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয়ে উঠছে না । কিন্তু, কেন ?
মানসম্মত শিক্ষার জন্য সর্বাগ্রে মানসম্মত শিক্ষক প্রয়োজন।এ সত্যটি আমাদের সকলকে উপলব্ধি করতে হবে। মানসম্মত শিক্ষকই কেবল মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারেন । মানসম্মত শিক্ষকের অভাব ও শিক্ষকের মর্যাদার ঘাটতির কারণে আমাদের দেশে শিক্ষার মান আজ ক্রমহ্রাসমান গতিতে নিম্নগামী ।
শিক্ষার একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে। যখন শিক্ষা তার নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়,তখন আমরা সে শিক্ষাকে মানহীন শিক্ষা বলি। শিক্ষা যদি মানুষের মধ্যে মনুষত্ববোধ জাগ্রত করতে না পারে, তবে সে শিক্ষার অর্থ কী ? শিক্ষার মাধ্যমে যদি দেশপ্রেম ও ন্যায়বোধ সৃষ্টি না হয়, তাহলে সে শিক্ষার কী প্রয়োজন? শিক্ষা যখন কাউকে স্বার্থপর করে কিংবা নিজের দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে পারেনা, তখন সে শিক্ষা মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে বাধ্য ।
আমাদের শিক্ষায় মানসম্মত শিক্ষকের অভাবে যা হবার তাই হচ্ছে। এ দেশে শিক্ষা যেন অনেকটাই খোড়া ও পঙ্গু আজ।সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা সত্যিকার অর্থে কতটুকু প্রতিফলিত ?
গোটি কয়েক সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষক ছাড়া দেশের অবশিষ্ট শিক্ষকদের দিকে তাকালে আজ তাদের প্রতি রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় উদাসীনতা সহজেই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।মানসম্মত শিক্ষকের অভাব উদ্বেগজনকরুপে প্রকট। এতোদিনের ট্রাডিশনাল নিয়োগ প্রক্রিয়া, চাকুরীর নিরাপত্তাহীনতা এবং সর্বোপরি বেতন বৈষম্যের কারণে আমাদের দেশে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট হননি । অনন্যোপায় হয়ে যে সব মেধাবী শিক্ষকতায় আসেন, তারা ও নানা বৈষম্যের শিক্ষার হয়ে আগ্রহের খেই হারিয়ে ফেলেন।তাহলে মানসম্মত শিক্ষক আমরা পাবো কোথায় ? সমাজে শিক্ষকদের কেবল মুখে মুখে প্রশংসা করে তাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয় । কোন শিক্ষককে হীনমন্যতায় ভোগিয়ে সে শিক্ষকের কাছে মানসম্মত শিক্ষা প্রত্যাশা করা দুরাশাই বটে । একজন শিক্ষক যখন উদ্বেগ,উৎকন্ঠা কিংবা দুশ্চিন্তা নিয়ে ক্লাসে যান, তখন তিনি কতটুকু তার শিক্ষার্থীগণের মাঝে নিজেকে মেলে ধরতে পারেন ? নিশ্চয় পারার কথা নয়।
শিক্ষকতার মতো জটিল, কঠিন আর কষ্টের কাজ দ্বিতীয়টি নেই। এ এক মহৎ ও মহান কাজ। এ কাজে যিনি নিয়োজিত হবেন, তিনি সকল হীনমন্যতা ও দুশ্চিন্তার ঊর্ধে থেকে কাজ করবেন।তিনি যদি নিপুন ও নিখুঁত হস্তে জাতি গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করতে না পারেন, তবে জাতির সর্বনাশ। একজন শিক্ষককে জাতি গঠনের অনুকূল সুযোগ সৃষ্টি করে দেবার দায়িত্ব গোটা জাতির ও রাষ্ট্রের ।
তা না হলে শিক্ষার মান নিয়ে যে কথা আজ উঠেছে, তার দায়ভার তো শিক্ষক সমাজ নিতে পারেন না।এ দায় দেশ ও জাতির।
আজ জাতীয়করণের বিষয়টি জোরেসোরেই আলোচনায় এসেছে। স্কুল-কলেজ জাতীয়করণের তালিকা হচ্ছে ও। এ ভাবে বিচ্ছিন্ন আকারে স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ সারা দেশে নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে । জাতীয়করণের মতো মহৎ উদ্যোগটি আজ প্রশ্নবানে জর্জরিত । আমাদের জাতির জনক যখন প্রাথমিক বিদ্যালয় একত্রে জাতীয়করণ করেন, তখন তো কেউ কোন প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগই পায়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনা একত্রে ২৬০০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন। সে সময় ও কোন প্রশ্ন উঠেনি। এভাবে একত্রে জাতীয়করণের সুফল আজ জাতি ঘরে তুলছে। তা হলে আজ বিচ্ছিন্ন জাতীয়করণ কেন ? একত্রে জাতীয়করণের বিষয়ে আজ নানা স্থানে মানববন্ধন হচ্ছে । গতদিন হবিগঞ্জে পুলিশের সাথে এ নিয়ে শিক্ষক- শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি । সে এক প্রতীকি অপ্রীতিকর উদাহরণ । এ ভাবে আরো নানা রকম ঝামেলা হচ্ছে ।
এ করে করে যদি সারা দেশ এক সময় এক সাথে উত্তাল হয়ে উঠে ? কেননা- জাতি বুঝতে শুরু করেছে যে, শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য শিক্ষকদের মর্যাদা সর্বাগ্রে প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য । আর এর জন্য অবিলম্বে একত্রে জাতীয়করণের বিকল্প কোন পথ নেই।
লেখক : অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিয়মিত কলাম লেখক ।