বাংলাদেশে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের জাতীয় শিক্ষাক্রমের তিনটি আবর্তন সম্পূর্ণ হয়েছে। অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুল জব্বার এ সবক’টি আবর্তনের শিক্ষাক্রম তৈরি ও পরিমার্জনের নেতৃত্ব দিয়ে এ দেশের শিক্ষাক্রমের গুরু হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। বাংলাদেশ শিক্ষাক্রমের এ পথিকৃৎ জন্মেছিলেন ময়মনসিংহ শহরে ১৯৩১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। ২০১৬ সালের ১৫ জানুয়ারি প্রায় ৮৫ বছর বয়সে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আজ তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী।
স্বাধীন বাংলাদেশে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের (১৯৭৪) আলোকে দেশের প্রথম-দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়নের জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন কমিটি গঠিত হলে (১৯৭৬) অধ্যাপক জব্বার এ কমিটির পরিচালক ও সদস্য সচিব নিযুক্ত হন। কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন প্রথমে অধ্যাপক শামসুল হক, পরে ড. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। কমিটির দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে অধ্যাপক জব্বার শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়নের কাজের (যার অধিকাংশ রচিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরে বসে) নেতৃত্বে থেকে সাত খণ্ডে প্রকাশিত দেশের প্রথম আবর্তনের শিক্ষাক্রম দলিল প্রস্তুতির মূল দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীন দেশের শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা ও পরিমার্জনের জন্য National Curriculum Development Centre (NCDC) প্রতিষ্ঠিত হলে (১৯৮১) এর প্রথম পরিচালক নিযুক্ত হন এমএ জব্বার। দুঃখজনক হচ্ছে, ১৯৮৪ সালে NCDC টেক্সটবুক বোর্ডের সঙ্গে একীভূত হয়ে যে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (জাশিপাবো) রূপ লাভ করে তার গুদামঘরসদৃশ গ্রন্থাগারে বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি দলিলের শুধু তৃতীয় খণ্ডের (মাধ্যমিক স্তর) একটি কপি আছে, বাকি সব উধাও হয়ে গেছে!
নবরূপে গঠিত জাশিপাবোতে অধ্যাপক এমএ জব্বার প্রথম সদস্য (শিক্ষাক্রম) নিযুক্ত হন ১৯৮৪ সালেই। তিনি এ পদে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। পরে জাশিপাবোর ভাগ্যে শিক্ষাক্রম জানা-বোঝা সদস্য (শিক্ষাক্রম) কমই জুটেছে। জাশিপাবোর সদস্য (শিক্ষাক্রম) হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে অধ্যাপক এমএ জব্বার ১৯৮৭ সালে শিক্ষা ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতিষ্ঠিত National Institute of Educational Administration, Extension and Research (NIEAER)-এর প্রধান (পরিচালক) নিযুক্ত হন। পরে এ প্রতিষ্ঠানের নাম সংক্ষিপ্ত করে National Academy for Educational Management (NAEM) করা হয়। নায়েমের পরিচালক পদেই অধ্যাপক জব্বারের সরকারি চাকরি শেষ হয় ১৯৮৮ সালে, ৫৭ বছর বয়সে।
সক্রিয় কর্মজীবন শেষ করলেও অধ্যাপক জব্বার শিক্ষাক্রমের কাজ থেকে কখনও নিজেকে বিযুক্ত করেননি। বাংলাদেশ শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের দ্বিতীয় আবর্তন প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত চলেছে। শিক্ষাক্রম পুনর্বিন্যাসের এ পর্যায়ের সঙ্গে তিনি আরও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন; কখনও পরামর্শক, কখনও সিনিয়র পরামর্শক, কখনও তথ্যজ্ঞ ব্যক্তি (Resource Person) বা কোনো কমিটির চেয়ারম্যান পদে। প্রাথমিক শিক্ষাক্রমের তৃতীয় আবর্তনের (১৯৯৮-২০০২) পরিমার্জন প্রক্রিয়ায়ও তিনি যুক্ত ছিলেন।
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণীত হলে এর আলোকে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম পরিমার্জন সম্পর্কে প্রথম জাতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয় ২০১১ সালের জুলাইয়ে Bangladesh Institute of Administration and Management (BIAM) মিলনায়তনে। এ সভায়ও অধ্যাপক এমএ জব্বার উপস্থিত ছিলেন এবং তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নিয়েই শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের পরিকল্পনা গৃহীত হয়। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এর আলোকে ২০১১-১২ সালে প্রাথমিক শিক্ষাক্রম চতুর্থবারের মতো পরিমার্জিত হয় এবং নিন্মমাধ্যমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের তৃতীয় আবর্তন চলে। এ পরিমার্জন প্রক্রিয়ায় জাতীয় পরামর্শকের দায়িত্বে ছিলেন আইইআর থেকে সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান। শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের এ সর্বশেষ ধাপেও অধ্যাপক এমএ জব্বার শিক্ষাক্রমের কারিগরি (বিষয়ভিত্তিক) কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন।
এমএ জব্বার ১৫ জানুয়ারি ২০১৬ এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায়ের আগের দিন পর্যন্ত নিজেকে শিক্ষাক্রমের প্রতি নিবেদিত রেখেছেন। এ জাতি বাংলাদেশ শিক্ষাক্রমের প্রয়াত এ গুরুকে যথাযথ সম্মান দেখায়নি। যে জাশিপাবো ও নায়েমে এমএ জব্বারের পরিণত বয়সের কর্মজীবন কেটেছে, দেরিতে হলেও অন্তত এর একটির গ্রন্থাগার তার নামে উৎসর্গ করে আমরা তার স্মৃতি চিরভাস্বর রাখতে পারি।