৪৬ থেকে ১৭ বিয়োগ করলে কত হয়? পঞ্চম শ্রেণির অর্ধেক শিক্ষার্থী এরকম দুই অঙ্কের বিয়োগের সমাধান জানে না। এ অবস্থা ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলের। ‘দি নেম অব দ্য ডগ ইজ পাপ্পি’- এই বাক্যের অনুবাদ জানে না কেনিয়া, তাঞ্জানিয়া ও উগান্ডার তৃতীয় শ্রেণির চার ভাগের তিন ভাগ শিক্ষার্থী । বিশ্বের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের অনেক দেশের প্রাথমিক শিক্ষার হাল এমন। প্রচুর শিক্ষার্থী স্কুলে যাচ্ছে, তবে কিছু শিখতে পারছে না। শিখতে না পারাটা তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সাফল্য আসছে না তাদের জীবনে। বেকার থাকছে অথবা কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক শিক্ষা খাতের এ সংকট নিয়ে দেশগুলোকে সতর্ক করে বলেছে, এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে ‘সবার জন্য শেখা’কে জাতীয় অগ্রাধিকার ঘোষণা করতে হবে।
বিশ্বব্যাপী এই গুরুতর সংকটকে বিশ্বব্যাংক তাদের এবারের ‘বিশ্ব উন্নয়ন রিপোর্ট’-এর উপজীব্য করেছে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, স্কুলে যাচ্ছে অথচ শিখছে না- এ বাস্তবতা শুধু উন্নতির সুযোগের অপচয় নয়, শিশু ও যুবকদের প্রতি বড় ধরনের অন্যায়। গতকাল রাতে ওয়াশিংটন থেকে ‘ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট-২০১৮’ নামে বিশ্বব্যাংকের এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বছরে একবার বিশ্ব উন্নয়ন রিপোর্ট প্রকাশ করে সংস্থাটি।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রাথমিক বা মাধ্যমিক পর্যায়ের কোনো শ্রেণির শিক্ষার্থীদের দক্ষতা নিয়ে জরিপভিত্তিক কোনো তথ্য নেই। তবে যেসব দেশ শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে সংকটে আছে, বাংলাদেশ তার বাইরে নয়। রিপোর্টের এক জায়গায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত অনেক দেশেই স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে শিক্ষার্থীরা স্কুলে কী শিখছে তার মূল্যায়ন করা হয় না।
রিপোর্টের তথ্য মতে, বাংলাদেশসহ অনেক দেশে স্বাক্ষরতার হার উম্নত দেশগুলোর মতো। তবে শিক্ষার্থীদের বড় অংশই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ঝরে পড়ে। বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয়ের ২৭ শতাংশ পায় দরিদ্রতম পরিবারের সন্তানরা। ধনীদের ক্ষেত্রে এ হার ১৩ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গিয়ে দেখা যায়, মাত্র ২ শতাংশ দরিদ্রতম পরিবারের সন্তানরা সরকারি ব্যয়ের উপকারভোগী হচ্ছে, যেখানে ধনী পরিবারের সন্তান সংখ্যা ৫৫ শতাংশ। এর কারণ, দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত খুব কম যেতে পারছে।
বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে বলা হয়, শেখা ছাড়া শিক্ষা ব্যবস্থা দারিদ্র্য বিমোচন ও সবার জন্য সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে স্কুলে যাওয়ার পরও লাখ লাখ শিশু লিখতে, পড়তে বা অঙ্কের মৌলিক বিষয়গুলো জানতে পারছে না। যারা এরই মধ্যে দারিদ্র্য, সংঘাত কিংবা প্রতিবন্ধিতার কবলে আছে, তারাই যুবক বয়সে গিয়ে বেশি সমস্যায় পড়ছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, শিক্ষার ক্ষেত্রে সংকট বাংলাদেশেও বড় আকারে রয়েছে। তিনি বলেন, এ দেশে শিক্ষিত যুবকদের একটা বড় অংশ চাকরির বাজারের উপযোগী হয়ে গড়ে উঠছে না। অনেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে ট্যাক্সি চালাচ্ছে, পিয়নের চাকরিতে ঢুকছে- এমন উদাহরণ অহরহ সৃষ্টি হচ্ছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে অঙ্ক ও ভাষা সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞান না নিয়ে যারা উচ্চ মাধ্যমিক বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যাচ্ছে, তারাই বেশি সমস্যায় পড়ছে। এটা শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যর্থতা। কেননা, শিক্ষার্থীদের ভালো সুযোগ দিলে তারা শিখতে পারবে। ড. জাহিদ হোসেনের মতে, সরকার শিক্ষা খাতের জন্য যে খরচ করছে, তার ফল পাচ্ছে না। শুধু টাকা খরচ করে গুণগত মান নিশ্চিত করা যায় না। বিনিয়োগের চেয়ে ব্যবস্থাপনা এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে বলা হয়, অনেকেই বছরের পর বছর স্কুলে গেলেও কার্যত অশিক্ষিত থেকে যাচ্ছে। শিক্ষা পদ্ধতির ধরনটা এমন যে, কে শিখছে আর কে শিখছে না- তার কোনো মূল্যায়ন হচ্ছে না। রিপোর্টের তথ্য মতে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া ১০০ জনের মধ্যে ৬১ জন নিম্ন মাধ্যমিক শেষ করতে পারে। আর ৩৫ জন উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত যায়।