ফেব্রুয়ারির ১৫ থেকে ১৯ তারিখ পর্যন্ত সময়ে একাধিক দৈনিকে সরকারি পদে কোটাভিত্তিক নিয়োগের ক্ষতিকারক বিষয় সম্পর্কে অভিমত পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে একটি সংবাদ ছিল কোটার পক্ষে-বিপক্ষে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মতামত। যেকোনো বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করা স্বাভাবিক। তবে তা গ্রহণযোগ্য ও যুক্তিসংগত হতে হবে। বিদ্যমান কোটার পর্যাপ্ততা ও প্রাধান্য যৌক্তিক নয় বলে প্রতীয়মান হয়। চলমান বিতর্কের প্রধান দুটি যুক্তি ছিল—এক. কোটাভিত্তিক নিয়োগ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হতে পারে না এবং দুই. কোটাভিত্তিক নিয়োগের জন্য সংরক্ষিত পদে যোগ্য প্রার্থীও পাওয়া না যাওয়ার ফলে পদ শূন্য রাখা হচ্ছে।
এ কারণে মেধাসম্পন্ন যোগ্য প্রার্থীকেও নিয়োগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এ বিতর্কে আরো বলা হয়েছে, কোটাভিত্তিক নিয়োগ এক নির্বাহী আদেশবলে প্রথম প্রবর্তন করা হয়। এ বক্তব্য সঠিক হলেও এর প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে। কোটাভিত্তিক নির্বাহী আদেশ বা সিদ্ধান্তের শিরোনাম ছিল—অন্তর্বর্তীকালীন নিয়োগ নীতি (Interim Recruitment Policy)। এ নীতি তৎকালীন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে একটি সরকারি স্মারকে ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জারি করা হয়। অর্থাৎ ৪৬ বছর আগে। এরপর একই বছরের নভেম্বর মাসে সংবিধান প্রণীত ও গৃহীত হয়। অন্যান্য দেশের অনুরূপ রাষ্ট্রীয় কার্যাবলি পরিচালনায় জনপ্রশাসনের গুরুত্ব অনুধাবন করে সংবিধান প্রণেতারা এ বিষয়ে কিছু বিধানও সংবিধানে সন্নিবেশিত করেছেন।
এ সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক বিধান হলো অনুচ্ছেদ ২৯। কিছু শর্ত সাপেক্ষে সরকারি নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতাই এ অনুচ্ছেদের মূলকথা। এতে আরো বলা হয় যে ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের অযোগ্য হবে না কিংবা সে ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না। কিছু শর্ত সাপেক্ষে এ বিধান অলঙ্ঘনীয় এবং অবশ্যই পালনীয়। এসব বিধান বা উপবিধান সংবিধানের মৌলিক অধিকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে আজও উজ্জ্বলভাবে দৃশ্যমান।
এ বিধান কার্যকর করার লক্ষ্যে তিনটি শর্ত আরোপ করা হয়েছে। এক. নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশ, যারা প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব করতে পারে, তাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান রাষ্ট্র করতে পারবে। দুই. কোনো ধর্মীয় বা উপসম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের জন্য নিয়োগ সংরক্ষণের বিধানসংবলিত যেকোনো আইন রাষ্ট্র কার্যকর করতে পারবে। তিন. যে শ্রেণির কর্মের বিশেষ প্রকৃতির জন্য নারী বা পুরুষের পক্ষে বিবেচিত হয়, সেরূপ যেকোনো শ্রেণির নিয়োগ বা পদ যথাক্রমে পুরুষ বা নারীর জন্য সংরক্ষণ করা যাবে। তৃতীয় শর্তটি পালিত হয়েছে নারীদের জন্য ১০ শতাংশ সরকারি পদ সংরক্ষণের মাধ্যমে।
তবে এর জন্য পদের কোনো বিশেষ প্রকৃতি বিবেচনা করা হয়নি। নারী-পুরুষের সমান অধিকার দর্শনের আলোকে কোনো বিশেষ প্রকৃতি বিবেচনা না করে ভালোই হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থাকে যে সংবিধানে বর্ণিত অন্য দুটি শর্ত যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে কি না? উল্লেখ্য, প্রথম ও দ্বিতীয় শর্ত পালনের জন্য বিধান ও আইনের কথা শর্তে উল্লেখ করা হয়েছে সরকারি ক্যাডার সার্ভিসে নিয়োগের জন্য ১৯৮১ সালের জানুয়ারি মাসে। অর্থাৎ স্বাধীনতার ৩৭ বছর পর। এর কোনো বোধগম্য ব্যাখ্যা পাওয়া না গেলেও বলা যায়, এ বিধিতে কোটাভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে যা বলা হয়েছে, তা হলো সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদের শর্তাংশ। অর্থাৎ ১৯৭২ সালের অন্তর্বর্তীকালীন নিয়োগ নীতির কথা বিধিতে উল্লেখ করা হয়নি। এ সত্ত্বেও অন্তর্বর্তী নিয়োগ নীতি কেন অনুসৃত হবে, তার উত্তর সরকারি নীতিনির্ধারকদেরই দিতে হবে। কোনো গোষ্ঠীর জন্য সরকারি পদে নিয়োগ বৈষম্যমূলক হতে পারে না। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৯(২)-এ এ কথাই স্পষ্টভাবে বলা আছে। সংবিধানে বর্ণিত প্রথম শর্ত অনুযায়ী নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশের মধ্যে যাঁরা প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম, তাঁদের অনুকূলে বিশেষ বিধান প্রণয়ন করা যাবে। বিধানটি আজ পর্যন্ত হয়নি।
দ্বিতীয় শর্ত হলো, কোনো ধর্মাবলম্বী বা উপসম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের জন্য নিয়োগ সংরক্ষণের বিধানসংবলিত যেকোনো আইন কার্যকর করা যাবে। এ সম্পর্কে আইনটি কোথায়? সাধারণ যুক্তিতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ব্যক্তিরাই এ ধরনের সংরক্ষিত পদের জন্য নিয়োগ লাভে যোগ্য। তবে তা আইনের বিধান অনুসারেই করতে হবে।
প্রায়োগিক ক্ষেত্রেও বিষয়টি দৃশ্যমান যে অন্তর্বর্তীকালীন নিয়োগ নীতি অচল—অর্থাৎ এ নীতি প্রয়োগের কোনো অবকাশ নেই। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন এ বিষয়টি প্রমাণ করে। এসব প্রতিবেদন পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে ১৯৮৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সময়ে প্রায় প্রতিটি প্রতিবেদনে কোটা পদ্ধতি যৌক্তিককরণের বিষয় উত্থাপিত হয়েছে। এমনকি এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সুপারিশও পাবলিক সার্ভিস কমিশন করেছে। ১৯৮৭ সালের প্রতিবেদনে বলা হয় : এক. ১৯৮৩ সাল থেকেই মুক্তিযোদ্ধা কোটায় প্রার্থীর সংখ্যা হ্রাস পায়। এর জন্য এ খাতের কোটা কমিয়ে আনা প্রয়োজন। দুই. মহিলাদের ক্ষেত্রে সংরক্ষিত ১০ ভাগ কোটার বিপরীতে অনেক বেশি প্রার্থী আবেদন করেন বিধায় এ কোটার নিয়োগ জেলাভিত্তিক বা বিভাগভিত্তিক না করে জাতীয়ভিত্তিক করাই যৌক্তিক। তিন. ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও মহিলা প্রার্থীর অনুরূপ সুপারিশ করা হয়। কোটাভিত্তিক নিয়োগ পদ্ধতি যৌক্তিককরণের বিষয়ে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের আন্তরিক চেষ্টার কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু সব সময়ই বিভিন্ন দলের ক্ষমতাসীন সরকার এ বিষয়ে নীরব ছিল অথবা সামান্য কিছু পরিবর্তন করেছে। ১৯৯৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আবেদন হ্রাস পাওয়ার সমস্যা নিরসনে সরকার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরাও এ ক্ষেত্রে এ কোটার বিপরীতে নিয়োগ লাভ করবে।
এ সিদ্ধান্ত আজও বলবৎ রয়েছে, যদিও একই ক্ষমতাসীন সরকার কর্তৃক গঠিত উচ্চপর্যায়ের এক কমিশন কোটার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করেছিল। উল্লেখ্য, ২০০০ সালে গঠিত পাবলিক সার্ভিস সংস্কার কমিশনের স্পষ্ট অভিমত ছিল—কোটা পদ্ধতি সংবিধান অনুযায়ী একমাত্র মহিলা ও অনগ্রসর নাগরিকদের জন্য সংরক্ষণ করা বৈধ হবে। এ ছাড়া কমিশন আরো বলেছিল যে সরকারি নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতা ক্ষুণ্ন করা একটি দুর্বল বিকল্প প্রথা। প্রাসঙ্গিক যে ১৯৯৭ সালের পর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদনে নবঘোষিত কোটা পদ্ধতির কোনো মূল্যায়ন পাওয়া যায়নি। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে অনুসৃত কোটা পদ্ধতির সঙ্গে বাংলাদেশের পদ্ধতির কোনো মিল নেই। এ সত্ত্বেও একটি দেশের কোটা পদ্ধতির জন্য ওই দেশকে কী খেসারত দিতে হয় তার মূল্যায়ন ১৯৮৭ সালে একজন আন্তর্জাতিক গবেষক করেছেন। এ সম্পর্কে তাঁর অভিমত বাংলাদেশের জন্যও প্রযোজ্য। কোটা পদ্ধতির কুফল একাধিক। এক. এ পদ্ধতি মেধা বিসর্জনের সমতুল্য। দুই. এর ফলে যোগ্য প্রার্থীরা সরকারি নিয়োগ লাভে বঞ্চিত হন। এ কারণে জনপ্রশাসনে অদক্ষতাই বিরাজ করে। তিন. কোটা পদ্ধতি দুর্নীতির জন্ম দেয়। কারণ নিজ জেলার জন্য পদ বরাদ্দ করা না হলে সম্ভাবনাপূর্ণ অন্য জেলার অধিবাসী হয়ে কোনো প্রার্থী পদলাভে সাফল্য অর্জন করেন।
কোটাভিত্তিক নিয়োগের ফলে মেধাসম্পন্ন বঞ্চিত প্রার্থীদের সংখ্যা কত হবে? অতীতের এক গবেষণায় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ১৯৯৫-এর বার্ষিক প্রতিবেদনের পরিসংখ্যানভিত্তিক ফলাফল একেবারেই আশাব্যঞ্জক নয়। এ ফলাফলে বলা হয়েছে, কোটার ফলে জেনারেল ক্যাডারে ৩৫৩টি পদে ২৯০ জন মেধাসম্পন্ন প্রার্থী নিয়োগ লাভে বঞ্চিত হন। মেধাসম্পন্ন ব্যক্তির অর্থ পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী উচ্চ ক্রমিকের প্রার্থী। অর্থনৈতিক ক্যাডারে ৪২ পদের বিপরীতে ৩১ জন প্রার্থী বঞ্চিত হয়েছেন। স্বাস্থ্য ক্যাডারে ২৯৩ পদের বিপরীতে ১৬৭ জন বঞ্চিত হয়েছেন। কারিগরি ক্যাডারে ৮৪ পদের বিপরীতে ৬৯ জন বঞ্চিত হয়েছেন। জেলাভিত্তিক কোটার প্রভাব আরো ভয়াবহ। এ ক্ষেত্রে নিম্ন ক্রমিকের প্রার্থীরাই নিয়োগ পেয়েছেন। কোটার কারণে শূন্যপদের সংখ্যার কিছু পরিসংখ্যানও ১৮ ফেব্রুয়ারি একটি দৈনিকে প্রকাশ করা হয়।
এ ক্ষেত্রে শূন্যপদের সংখ্যার অর্থ—কোটাভিত্তিক যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ার কারণে সব পদ পরবর্তী পরীক্ষার জন্য সংরক্ষণ করা হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত এ প্রতিবেদন অনুযায়ী ২৮তম বিসিএস থেকে ৩৫তম বিসিএসের শূন্যপদের সংখ্যা পাঁচ হাজার ১১৩। এর মধ্যে তিন হাজার ৩৫৯টি ৩৫তম বিসিএসের দ্বিতীয় শ্রেণির পদ। তবে এ ক্ষেত্রে সুখবরটি হলো, মুক্তিযোদ্ধা কোটাভুক্ত প্রার্থীর শর্ত শিথিল করার কারণে ওই সব পদের সব কটি পূরণ করা সম্ভব হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বলা যায় যে শর্ত শিথিল স্থায়ী করলে ক্ষতির তুলনায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুফলই হবে অধিকতর। কারণ এর ফলে তিন হাজার ৩৫৯ জন শিক্ষিত তরুণ সরকারি নিয়োগ লাভে সক্ষম হন।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ