সহায়ক ও অতিরিক্ত বইয়ে ভারাক্রান্ত শিক্ষার্থীরা - দৈনিকশিক্ষা

সহায়ক ও অতিরিক্ত বইয়ে ভারাক্রান্ত শিক্ষার্থীরা

রাকিব উদ্দিন |

সরকারের অতিরিক্ত বই ও স্কুলের চাপিয়ে দেয়া সহায়ক বইয়ের ভারে ভারাক্রান্ত কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা। শিক্ষানীতি-২০১০তে শিশুদের কাঁধে বইয়ের বোঝা কমানোর কথা বলা হলেও ২০১৭ শিক্ষাবর্ষে পাঠ্যবইয়ের বোঝা আরও বেড়েছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব উদ্যোগে সহায়ক পুস্তকের সংখ্যাও বাড়িয়েছে। শিক্ষা প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে শিশুদের বোর্ডের বইয়ের চেয়ে বেশি পড়তে হচ্ছে সহায়ক বই, যা কিনতে হয় অত্যন্ত চড়া দামে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত কয়েক বছর ধরেই শিশুদের বইয়ের বোঝা কমানোর তাগিদ দিয়ে আসছেন। কিন্তু ২০১৭ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যক্রমে এর বিপরীত চিত্র ফুটে উঠেছে।প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর শিশুদের তিনটি (আবশ্যিক বাংলা, ইংরেজি ও গণিত) করে বোর্ডের বই (বিনামূল্যে) পড়তে হয়। কিন্তু রাজধানীসহ প্রায় সারাদেশেই পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি শিশুদের আরও তিন থেকে পাঁচটি সহায়ক বই বাধ্যতামূলক পড়তে হচ্ছে। এর মধ্যে রাজধানীর প্রায় সব স্কুলেই প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর শিশুদের আবশ্যিক তিন বইয়ের পাশাপাশি সাধারণ জ্ঞান, ড্রয়িং বা চিত্রাঙ্কন ও ধর্ম শিক্ষা বই পড়তে হয়।এছাড়া বর্তমানে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম এবং নবম-দশম শ্রেণী পর্যন্ত ১৪টি করে বই পড়তে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের, যা ২০১৬ শিক্ষাবর্ষে ছিল (১০ থেকে ১২টি)।

মাধ্যমিক স্তরে পাঠ্যপুস্তক কমানোর জন্য শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের পক্ষ্য থেকে দাবি রয়েছে। শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্টজনরাও পাঠ্যপুস্তক কমানোর সুপারিশ করেছেন।সহায়ক বইয়ের নামে অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক পুস্তকের মানসিক ও শারীরিক চাপে নূ্যব্জ হয়ে পড়েছে কোমলমতি শিশুরা। অনৈতিক আর্থিক সুবিধা পাওয়ার লোভেই শিশুদের ঘাড়ে বাড়তি পুস্তক চাপিয়ে দিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ, যার সুবিধা পাচ্ছেন স্থানীয় অসাধু শিক্ষক নেতা ও শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব প্রফেসর শেখ ইকরামুল কবীর বলেন, ‘শিক্ষানীতিকে পাশকাটিয়ে কারিকুলাম তৈরি করা হয়েছে। এক্ষেত্রে শিশুদের কাঁধ থেকে বইয়ের বোঝা কমাতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাও উপেক্ষা করা হয়েছে। এই সুযোগে নোট-গাইড ব্যবসায়ীরা সারাদেশে সহায়ক বইয়ের বাজার আরও সম্প্রসারণ করেছে।’কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ ও সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের কর্মকর্তারা শিক্ষানীতি যথাযথভাবে বুঝতে পারছেন না- মন্তব্য করে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) সাবেক এই মহাপরিচালক বলেন, ‘শিক্ষানীতিতে বলা আছে- শারীরিক শিক্ষা বিষয় থাকবে, যার অন্তর্বর্তীকালীন পরীক্ষা হবে, কিন্তু এ বিষয়টিকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং পাবলিক পরীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

এভাবে স্বাস্থ্য শিক্ষাসহ আরও কিছু বিষয় শিক্ষার্থীদের চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।’তিনি আরও বলেন, ‘ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রামসহ- এ ধরনের প্রেক্ষাপট যথাযথভাবে উপস্থাপনের কথা বলা হয়েছে শিক্ষানীতিতে, কিন্তু কারিকুলামে এসব বিষয় ব্যাপকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি ওভারলিপিং অর্থাৎ যে বিষয় পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ানো হচ্ছে, সেটি আবার ষষ্ঠ শ্রেণীতেও রাখা হয়েছে, যে বিষয় ষষ্ঠ শ্রেণীতে শিক্ষার্থীরা পড়ছে, সেটি আবার তারা সপ্তম শ্রেণীতেও পড়ছে। এগুলো শিক্ষানীতির পরিপন্থী কাজ।’এদিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া শিক্ষার্থীর শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ভারি ব্যাগ বহন করা যাবে না বলে গত বছর উচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছিল তাও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। রায়ের কপি পাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে এ বিষয়ে আইন করতে সরকারকে নির্দেশ দেয়া হলেও সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলে মাউশি’র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বিনামূল্যে সারাদেশের ছাত্রছাত্রীদের যেসব বই বিতরণ করে, এর বাইরে সহায়ক বই পাঠ্য করার কোন নিয়ম নেই। দেশের প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যের বইয়ের বাইরে অন্য কোন বই পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও এর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে এনসিটিবি।কিন্তু দেশব্যাপী সরকারি-বেসরকারি স্কুলে সহায়ক আবশ্যকীয় বই পড়ানো হলেও এনসিটিবি, মাউশি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় নির্বিকার। এনসিটিবির অনুমোদিত বই ছাড়া অন্য কোন বই স্কুলে পাঠ্য করা যাবে না- সরকারের এমন নির্দেশনা বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

মাউশি ও এনসিটিবিতে কর্মরত শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারাই নোট, গাইড ও সহায়ক বই লিখেন বলে অভিযোগ রয়েছে।এ ব্যাপারে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেছেন, ‘অননুমোদিত বই যাতে স্কুলে পাঠ্য করা না হয় এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে এনসিটিবিরি পক্ষ থেকে মাউশিকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। তারা কোন পদক্ষেপ নিয়েছে কিনা আমাদের জানায়নি।’জানতে চাইলে মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) প্রফেসর এলিয়াছ হোসেন  বলেন, ‘অননুমোদিত বইয়ের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব এনসিটিবি’র। আমাদের এই ধরনের অভিযান পরিচালনার জনবল নেই। এনসিটিবি এ বিষয়ে দায়িত্ব এড়াতে পারে না। তবে সুনির্দিষ্টভাবে কোন প্রতিষ্ঠানে সহায়ক বই পড়ানোর প্রমাণ পেলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।’এনসিটিবির তথ্য অনুযায়ী ২০১৭ শিক্ষাবর্ষে প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত মোট ৫৭৪টি বিষয়ের পাঠ্যবই ছাপানো হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমের ৩৩টি ও ইংরেজি ভার্সনের ২৩টি, ৬ষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমের ১০২টি ও ইংরেজি ভার্সনের ৬৫টি, এসএসসির (ভোকেশনাল) ট্রেড বই ৬১টি, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ব্রেইল বই ১০৯টি, শিক্ষক নির্দেশিকা (টিজি) ৫৬টি, মাদ্রাসার ইবতেদায়ীর ৩৬টি ও দাখিল স্তরের ৭৯টি এবং পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুর জন্য ১০টি বিষয়ের বই ছাপানো হয়েছে।এই বইয়ের পাশাপাশি প্রতিটি শ্রেণীতেই সমসংখ্যক সহায়ক বই পড়তে হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের। সরকার থেকে বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ করা হলেও গড়ে এক শিক্ষার্থীর অভিভাবককে দেড় থেকে তিন হাজার টাকার পর্যন্ত বাড়তি বই কিনতে হচ্ছে। এই অতিরিক্ত বইয়ের ভাড়ে নূ্যব্জ হয়ে পরছে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা।

সরকার ২০১০ সাল থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরেও বিনামূল্যের বই বিতরণ করছে। ২০১৩ সাল থেকে বাংলা ব্যাকরণ ও ইংলিশ গ্রামার বইও বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত কোন বাড়তি বই স্কুলে পড়ানো যাবে না- এমন নির্দেশনা রয়েছে এনসিটিবির। কিন্তু ওই নির্দেশনার নূ্যনতম তোয়াক্কা করছে না স্কুলগুলো। এমনকি বিনামূল্যের ব্যাকরণ ও ইংলিশ গ্রামার বইয়ের সঙ্গেও এই ধরনের অতিরিক্ত বই কিনতে বাধ্য হচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা।সহায়ক বইয়ের বাণিজ্যখোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ বছর নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দ্বিতীয় থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত প্রায় ৬০ লাখ টাকার সহায়ক বই বিক্রি করেছে একটি প্রকাশনী। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অনৈতিক যোগসাজশে সহায়ক বই বিক্রিতে সহযোগিতা করেছেন কয়েকজন শিক্ষক নেতা, প্রতিষ্ঠান প্রধান ও পরিচালনা পরিষদের সদস্যরা। তাদের চাপিয়ে দেয়া এসব বই কিনতে বাধ্য হন অভিভাবকরা।নাম প্রকাশ না করার শর্তে আড়াইহাজার সদরের একটি হাই স্কুলের পরিচালনা পরিষদের সদস্য বলেন, ‘আমরা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে ডোনেশন পেয়েছি চার লাখ টাকা।

এর বিনিময়ে ওই প্রকাশনীর সহায়ক বই বিক্রি করেছি প্রায় ১২ লাখ টাকার।’ তিনি জানান, এই উপজেলার প্রায় সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই এভাবে সহায়ক বই বিক্রি করে আসছে।ঢাকার আরমানিটোলা এলাকার একটি বেসরকারি স্কুলের প্রতিটি শ্রেণীতে অনুমোদনহীন বই পাঠ্য করা হয়েছে। ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত প্রতি শ্রেণীতে অননুমোদিত বই তিনটি। তবে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত প্রতিটি শ্রেণীতে- এমন বইয়ের সংখ্যা ৭টি থেকে ৯টি। অনুমোদনহীন এসব সহায়ক বই কেনার জন্য শিক্ষার্থীদের হাতে তালিকা ধরিয়ে দেয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। আর স্কুল কর্তৃপক্ষ পরিচালিত ও স্কুল ভবনের আশপাশে প্রতিষ্ঠিত নির্দিষ্ট বইয়ের দোকান থেকে এসব বই কেনা বাধ্যতামূলক করা হয়। বই কিনতে ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিত তাগাদা দেন শ্রেণী শিক্ষকরা।রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা কাওছার নাসরীন বলেন, ‘আমার মেয়ে ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। এ বছর মেয়ের জন্য প্রায় তিন হাজার টাকার সহায়ক বই কিনতে হয়েছে।’

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0080180168151855