যশোরের বাঘারপাড়ায় রায়পুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ কামরুজ্জামান জামাতের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিনা রশিদে টাকা আদায়, ক্রয় কমিটি ছাড়াই পণ্য ক্রয়, প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বিক্রিত দোকানের পজিশন নিয়ে চাঁদা দাবি, দোকানের পজিশন বিক্রির নামে টাকা আত্মসাৎসহ নানা রকম দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এসব কাজে প্রতিষ্ঠানের কিছু কর্তাব্যক্তি অধ্যক্ষকে সাহায্য করেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষা অফিসে অধ্যক্ষ কামরুজ্জামান জামাতের আত্মীয় রয়েছে। ফলে কেউ তার কিছুই করতে পারবেন না বলে প্রচারণা চালাচ্ছেন তিনি। একই সাথে ম্যানিজিং কমিটির অগোচরে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কাজ-কর্মে স্বেচ্ছাচারিতার দরুন ধীরে ধীরে নাম-যশ হারাতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্ঠানটি।
জানা যায়, সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে মডেল টেস্ট পরীক্ষা বাবদ ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ৭ম, ৮ম ও ১০ শ্রেণির সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১৫০, ২৫০ ও ৩০০ টাকা করে ৬২ হাজার ৭৫০ টাকা আদায় করা হয়েছে। তবে এ টাকা আদায়ের কোনো রশিদ তাদের দেয়া হয়নি। এমনকি সে টাকা কোন খাতে ব্যয় করেছেন তার কোনো হিসাবও কমিটিকে দেননি অধ্যক্ষ।
এদিকে, ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন প্রতিষ্ঠান কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ৯৯ বছরের জন্য প্রতিষ্ঠানটির মালিকানাধীন একটি দোকান লিজ নেন একই এলাকার ব্যবসায়ী আব্দুল আলীম। ১৮ বছর ধরে ব্যবসা পরিচালনা করলেও নতুন করে ডিড করার অজুহাত দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা চাঁদা দাবি করেছেন অধ্যক্ষ। ওই টাকা না দেয়ায় দোকানের কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি। এছাড়া, একই এলাকার শাহীনুরের কাছ থেকে দুই বছর আগে ৯০ হাজার টাকা পজিশন বিক্রির কথা বলে তৎকালীন ম্যানেজিং কমিটির সদস্য মোহাম্মদ জাফরের মাধ্যমে ৯০ হাজার নিয়েছেন অধ্যক্ষ। অথচ ক্রয়কৃত জমি ক্রেতাকে বুঝিয়ে দেননি। এখন টাকা নেয়ার বিষয়টাও অস্বীকার করে উল্টো হুমকি ধামকি দিচ্ছেন। একই এলাকার ওবাইদুরও ওই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পজিশন কিনে বেকায়দায় পরেছেন। স্ট্যাম্প করা থাকলেও অধ্যক্ষকে খুশি না করতে না পারায় জমি বুঝে পাচ্ছেন না তিনি। এ ধরনের একাধিক অভিযোগ রয়েছে অধ্যক্ষ জামাতের বিরুদ্ধে।
শুধু আব্দুল আলীম, ওবাইদুর কিংবা শাহীনুর নয়, এর বাইরেও অনেক পজিশন ক্রেতায় জামাতের নানা কর্মকাণ্ডে অতিষ্ট হয়ে উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিষ্ঠানে কামরুজ্জামান জামাত যোগদানের পর থেকে বই চুরির ঘটনা বেড়েছে। গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর স্কুলের পিওন বাঘারপাড়ার জয়নগর গ্রামের সামদিয়াত হোসেন বস্তা ভর্তি বই চুরির ঘটনায় পুলিশের হাতে আটক হয়। এ ঘটনায় থানায় পুলিশ বাদী হয়ে পিয়নকে অভিযুক্ত করে মামলা করেন, যা এখনো বিচারাধীন। এ ঘটনায় ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ১১ এপ্রিল সাময়িকভাবে বহিষ্কারও করা হয় ওই পিয়নকে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে স্কুল কমিটির সিদ্ধান্ত ছাড়াই অধ্যক্ষ সামদিয়াততে প্রতিষ্ঠানে আসার সুযোগ করে দিয়েছেন।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, রায়পুর স্কুল মোড়ের মেইন রাস্তার ডানপাশে অন্তত ৫০টা দোকান। পাশেই বিশাল দুটি পুকুর। মেইন রাস্তার আরেকপাশে দুইতলা ব্যাংক। এছাড়া সারিবদ্ধ আরও ২০টি দোকান। তার পাশেই স্কুলের নামে মসজিদ, রয়েছে মাদরাসাও। মূল রাস্তার অদূরে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানের ভবন। কিন্তু যাওয়ার রাস্তা নেই। সামনের মাঠে হাটু সমান কাদা। বিল্ডিংয়ের দেয়ালের পলেস্তার নেই। কোথাও কোথাও থাকলেও তা ঝরে পরার উপক্রম। অথচ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে সংসদ সদস্যের সহযোগিতায় সরকারি ৮৪ লাখ টাকার নির্মাণ কাজ শেষ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
এ বিষয়ে আব্দুল আলীম দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান, তিনি ৫০ হাজার টাকা দিতে না পারায় ক্রয়কৃত জায়গার কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন অধ্যক্ষ। নানা মহলে ধরনা ধরে তিনি আজ ক্লান্ত হয়ে উঠেছেন।
সাবেক ম্যানেজিং কমিটির আহ্বায়ক শাহীনুর জামাতের মধ্যস্ততাকারী হাজী জাফর দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, অধ্যক্ষ তার মাধ্যমে শাহীনের কাছ থেকে জমি দেয়ার নামে টাকা নিয়ে তাকে বিপাকে ফেলেছেন। এখন পজিশন শাহীনুরকে বুঝিয়ে না দিয়ে নানা ধরনের অযুহাত দেখাচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে তিনি বিব্রত। বিষয়টি মীমাংসা করতে বহুবার অনুনয় বিনয় করেও কোনো লাভ হয়নি।
ভুক্তভোগী ওবায়দুর রহমান দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটির দোকানের পজিশনের জন্য টাকা জমা দেয়া রয়েছে। যার রশিদও তার কাছে আছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের রেজুলেশনেও সেসবের প্রমান রয়েছে। কিন্তু অধ্যক্ষ তা মানতে নারাজ। তাকে খুশি করতে না পারায় তার দোকানের পজিশনের দলিল দেয়া হচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে পরিচালনা পরিষদের সভাপতির কাছে একাধিকবার অভিযোগ করেছেন কিন্তু লাভ হয়নি।
এ বিষয়ে অধ্যক্ষ কামরুজ্জামান জামাত দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান, এসব অভিযোগ সবই ভিত্তিহীন। তিনি ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে যোগদানের পর থেকে উন্নয়নের জন্য একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেয়া হয়নি। এছাড়া পজিশনের জন্য কারো কাছে টাকা দাবি কিংবা টাকা আত্মসাৎ করেননি। আব্দুল আলীম যে পজিশন কিনেছে তার প্রমান পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে পাওয়া গেছে। ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কিনেছেন। ওবাইদুর ও জাফরের কাছ থেকে কোনো টাকা নেননি বলে জানান তিনি। তার বিরুদ্ধে একটি মহল ষড়যন্ত্র করে এসব অভিযোগ এনেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
প্রতিষ্ঠানের সভাপতি বিল্লাল হোসেন দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তার কাছে এসেছে। পজিশন বিক্রি নিয়ে দোকানদারদের সাথে তালবাহানার বিষয়টি নিয়ে তারা বিব্রত। বিগত দুই বছরে দুইবার প্রজেক্ট কমিটি করা হয়েছে স্কুল ভবন মেরামতের জন্য। কিন্তু অধ্যক্ষ নানা অজুহাতে ওই কাজ করেননি। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিনা রশিদে নানা অযুহাতে টাকা আদায়ের বিষয়টি কমিটির নজরে এসেছে। ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে।