শিল্প, সাহিত্য, শিক্ষা, মননশীলতা, সম্পদের প্রাচুর্য— সব দিক দিয়েই ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সভ্যতার একটি। এর মধ্যে বাঙালিরা ছিল এ উপমহাদেশের সবচেয়ে অগ্রসর জাতি। জাতি গঠন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও স্বাধীনতা অন্দোলন সর্বক্ষেত্রে বাঙালিরা ছিল অগ্রণী ভূমিকায়। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিখ্যাত অবাঙালি নেতা গোপাল কৃষ্ণ গোখলে তাই বলেছিলেন, ‘বাঙালি আজকে যা ভাবে, ভারতবর্ষ তা ভাবে আগামীকাল।’ কিন্তু আজ বাঙালি, বিশেষ করে তত্কালীন পূর্ববঙ্গ তথা স্বাধীন বাংলাদেশের বাঙালিরা তাদের সেই ঐতিহ্যকে কতটা সমুন্নত রাখতে পেরেছে?
একসময় আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা অল্পসংখ্যক ডিসিপ্লিনে বিভক্ত ছিল। বর্তমানে অসংখ্য ডিসিপ্লিন জ্ঞানের শাখা-প্রশাখাকে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করে চলছে। আধুনিক, যান্ত্রিক ও তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ব্যবহারিক শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। বর্তমানে যে দেশ ব্যবহারিক কিংবা কারিগরি শিক্ষায় যত উন্নত, সে দেশ আর্থিকভাবে ততটাই সমৃদ্ধিশালী। তবে নৈতিক, সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধের উন্নয়নের জন্য কারিগরি শিক্ষার পাশাপাশি মানবিক আর উদারনৈতিক শিক্ষার ব্যাপারেও শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দিতে হবে।
মানের বিবেচনায় যা-ই হোক না কেন, গত কয়েক দশকে আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক প্রসার ও আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। একসময় উচ্চশিক্ষার জন্য কেবল কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নির্ভর করতে হতো। ফলে অনেকেই যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও উচ্চশিক্ষা নিতে পারত না। তবে গত দুই দশকে পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। ৫০টির বেশি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি কলেজগুলোয় অনেক বিষয়ে অনার্স, মাস্টার্স চালু হয়েছে।
অভিভাবকদের মধ্যেও ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। স্বল্প আয়ের মা-বাবারাও তাদের আয়ের এক বড় অংশ ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট টিউটর আর কোচিংয়ের পেছনে ব্যয় করছেন। শিক্ষার্থীরা ভালো স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার তীব্র প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হচ্ছে। ছেলেদের সঙ্গে মেয়েরাও সমানতালে এগিয়ে চলছে। ড্রপ আউট অনেক কমে গেছে। দেশের নারীশিক্ষার হার ও ড্রপ আউটের নিম্নহার আমাদের প্রতিবেশী অন্য দেশগুলোর চেয়ে অনেক আশাব্যঞ্জক।
কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কতটা মানসম্পন্ন? একসময় সৎ আর মেধাবী শিক্ষার্থীরাই শিক্ষকতা পেশায় আসত। বর্তমানে সেই সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। কারণ বর্তমানে শিক্ষক নিয়োগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত অর্থ, পেশিশক্তি আর রাজনৈতিক প্রভাবের জয়জয়কার। ফলে একসময়কার কিংবদন্তিতুল্য শিক্ষকের দেখা আর মিলছে না। গবেষণায় ব্রতী কোনো শিক্ষক পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ছে। গবেষণার পথ ক্রমে সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। গবেষণার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ ফেরত যাচ্ছে। শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক চাহিদা অপাত্রের হাতে পড়ে আজ একটা ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত হয়েছে। ফলে শিক্ষকের প্রতি ছাত্রছাত্রীরাও বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা খুব কমই দেয়া হচ্ছে। ফলে শিক্ষকরূপী লম্পটরা নিজের ছোট বোন কিংবা সন্তানতুল্য ছাত্রীদের শ্লীলতাহানি ঘটাচ্ছে। এ ধরনের হাজারো ঘটনার খুব কমই আমরা জানতে পারছি।
শিক্ষা আজ এক মহাবাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। শিক্ষকরা ক্লাসে পড়ানোর চেয়ে কোচিং নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকেন। শিক্ষার্থীরা ক্লাসে বেশি নম্বর পাওয়ার আশায় অনেকটা ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হয়ে শিক্ষকদের কাছে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। একসময় দেখা যেত শুধু অংক, বিজ্ঞান আর ইংরেজি শিক্ষকদেরই বাড়তি আয় ছিল সবচেয়ে বেশি। বাংলা আর ধর্মীয় শিক্ষকদের অবস্থা ছিল করুণ। কিন্তু বর্তমানে তাদের পালেও ব্যাপক হাওয়া লেগেছে। গোল্ডেন এ প্লাস যাতে ছুটে না যায়, সেজন্য শিক্ষার্থীরা একই সঙ্গে একাধিক বাংলা আর ধর্মীয় শিক্ষকের কাছে পড়ছে। শিক্ষার্থীদের মাঝেও জ্ঞানার্জনের চেয়ে গোল্ডেন এ প্লাস কিংবা এ প্লাস পাওয়া অথবা কোনোমতে পাস করাটাই যেন মুখ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় একদিকে যেমন আধুনিকতার নামে নিত্যনতুন অশ্লীলতা আর মাদকাসক্তির ব্যাপক প্রসার ঘটছে, আবার একই সঙ্গে ধর্মীয় চরমপন্থারও একটা লালন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। উচ্চশিক্ষার ব্যাপক চাহিদার কারণে একশ্রেণীর অর্ধশিক্ষিত কিংবা স্বল্পশিক্ষিত লোক অদ্ভুত অদ্ভুত নামকরণে রাতারাতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে ফেলছে। নামসর্বস্ব এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি, কারিকুলাম আর শিক্ষার পরিবেশ একেবারেই নিম্নমানের। অনেক সময় দেখা য়ায়, একটা মাত্র ভবনে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। এগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় না বলে কোচিং সেন্টার বলাটাই শ্রেয়, যেখানে চলে শুধু সার্টিফিকেট বাণিজ্য।
বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ অপ্রতুল। নানা মহলের দাবি সত্ত্বেও সরকার এ ব্যাপারে কোনো মনোযোগ দিচ্ছে না। শিক্ষা খাতে ব্যাপক দুর্নীতি আর লুটপাটের কারণে আসল লক্ষ্য অর্জন বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৫০ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৯ শতাংশ এবং মোট বজেটের প্রায় ১২ দশমিক ৬ শতাংশ, যা সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশের চেয়ে কম। অথচ ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী এর পরিমাণ থাকা উচিত ছিল মোট জিডিপির ৪-৬ শতাংশ এবং মোট বাজেটের ১৫-২০ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে মালদ্বীপ তার মোট জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ, আফগানিস্তান ৩ দশমিক ৩, ভুটান ৭ দশমিক ৪, নেপাল ৩ দশমিক ৭, ভারত ৩ দশমিক ৮, পাকিস্তান ২ দশমিক ৬, শ্রীলংকা ২ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রেখেছে। তানজানিয়া, উগান্ডা, বুরুন্ডি, টোগো প্রভৃতি আফ্রিকান দেশ তাদের মোট বাজেটের প্রায় এক-চতুর্থাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করছে। লুক্সেমবার্গ প্রতি শিক্ষার্থীর পেছনে বার্ষিক ১৯ হাজার ৫০ মার্কিন ডলার ব্যয় করে, যা সারা বিশ্বে সর্বোচ্চ। এর পরই রয়েছে যথাক্রমে সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রিয়া আর ডেনমার্কের অবস্থান। আমাদের দেশে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ নিয়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হারকে বাড়িয়ে সস্তা বাহবা নেয়ার নির্লজ্জ চেষ্টার কোনো কমতি নেই। দীর্ঘমেয়াদে এতে শিক্ষার্থীদের যে কত বড় ক্ষতি হচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পাস করার পরও উচ্চশিক্ষার সুযোগ না পেয়ে অনেকে হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে। অনেকের শিক্ষাজীবন উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়েই শেষ হয়ে যাচ্ছে।
পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, নকলকে উৎসাহিত করা বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সবচেয়ে অন্ধকার দিক। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এর নজির আছে বলে আমার জানা নেই। কিছুসংখ্যক অসাধু দুষ্টু চক্র রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে, লোভে পড়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো জঘন্যতম কাজটি একের পর এক ঘটিয়ে চলছে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে এর প্রতিকারের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না; বরং দায়িত্বশীলদের নানা ধরনের কথায় অসাধু চক্রটি আরো উৎসাহিত হচ্ছে।
তথাকথিত ছাত্র রাজনীতি, শিক্ষক রাজনীতি বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার স্বাভাবিক গতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। ছাত্র-শিক্ষকদের মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা উচ্চশিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত করছে। ছাত্ররা তথাকথিত এ রাজনীতিকে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির মাধ্যমে বিনা পুঁজিতে অর্থ উপার্জন ও ভবিষ্যতে মন্ত্রী-এমপি হওয়ার সহজ রাস্তা হিসেবে মনে করছে। তাছাড়া হল দখল আর ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার তো আছেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক পদের আশায় কিংবা আর্থিক কোনো সুবিধা পাওয়ার আশায় নির্লজ্জভাবে মূলধারার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছে, যেটা একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে একেবারেই বেমানান। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সৎ আর মেধাবী শিক্ষার্থী-শিক্ষকরা একেবারে কোণঠাসা। ভালো ফল ও মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও তারা না পারছে শিক্ষকতায় যোগ দিতে আবার না পারছে তাদের ন্যায্য অধিকার আদায় করতে। দলীয় লেজুড়বৃত্তি আর পেশিশক্তির জোরে অযোগ্য আর অসৎ লোকেরাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য তারা ছাত্রদের ব্যবহার করছে।
একই সমান্তরালে একাধিক শিক্ষা ব্যবস্থা একটা প্রকট সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি করছে। মাদ্রাসা, ইংরেজি আর বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়েছে। সামাজিক অবস্থান ও কর্মক্ষেত্রে এর ব্যাপক প্রভাব লক্ষ করা যায়। মা-বাবারা তাদের অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী আর অবাধ্য সন্তানদের ভালো মানুষ হওয়ার আশায় মাদ্রাসায় ভর্তি করাচ্ছেন। কওমি মাদ্রাসার কারিকুলাম কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের জন্য একেবারেই অনুপযোগী। তারা মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জিন অথবা মাদ্রাসায় শিক্ষক হওয়া ছাড়া অন্য কোনো পেশায় নিজেদের জড়াতে পারছে না। সম্প্রতি সরকার কওমি মাদ্রাসার দাওরা ডিগ্রিকে মাস্টার্সের সমমানের স্বীকৃতি দিয়েছে। এতে চাকরির বাজারে তারা অন্তত প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে পারবে।
এত হতাশাজনক চিত্রের মাঝেও আমাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে উচ্চশিক্ষার ব্যাপক আগ্রহ একটা ইতিবাচক দিক। তাদের মেধা আছে কিন্তু সেই মেধাকে শাণিত করার উপযুক্ত পরিবেশ দরকার। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিজ্ঞানে, গবেষণায়, প্রকৌশলে, শিক্ষকতায় মেধার স্বাক্ষর রাখছে। উপযুক্ত পরিবেশ আর কর্মসংস্থান পেলে মেধাবীদের ব্রেন ড্রেন রোধ করা সম্ভব, যা আমাদের জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবে।
এ ধরনের অনিশ্চিত ও অরাজক পরিস্থিতি থেকে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে উদ্ধারের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দেশপ্রেম আর কিছু দৃঢ়, সাহসী সিদ্ধান্ত। ছাত্রদের ক্ষমতায় আরোহণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের মনোবৃত্তি থেকে সব রাজনৈতিক দলকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাজেটে শিক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। তথাকথিত ছাত্র রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেয়া বন্ধ করতে হবে এবং তাদের মূলধারার রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করতে হবে। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি আর আধিপত্য বিস্তারে সব পথ বন্ধ করতে হবে। নকল কিংবা প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো জঘন্যতম কাজগুলোয় জড়িতদের কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একটা প্রকৃত বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠার সব শর্ত পালনে বাধ্য করতে হবে। একটা সুখী, সমৃদ্ধ আর শিক্ষিত জাতি গড়তে এসব কাজের কোনো বিকল্প থাকতে পারে না।
লেখক: ব্যাংকার
সৌজন্যে: বণিক বার্তা