আচার্যের কাছে খোলা চিঠি জাবি শিক্ষক-শিক্ষার্থীর - দৈনিকশিক্ষা

আচার্যের কাছে খোলা চিঠি জাবি শিক্ষক-শিক্ষার্থীর

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

মহাত্মন,

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকতর উন্নয়নের জন্য একনেক কর্তৃক ১ হাজার ৪৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়ার খবরে আমরা আনন্দিত হয়েছিলাম। সম্প্রতি প্রাথমিক পর্যায়ে পাঁচটি হল নির্মাণের জন্য ৩৬৭ কোটি টাকা ছাড় হয় এবং নির্মাণকাজের নানা প্রক্রিয়াও শুরু হয়। এ সময় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রণীত মহাপরিকল্পনায় বড় ধরনের অনেক ত্রুটি ধরা পড়ে। পাশাপাশি কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে এই প্রকল্পকে ঘিরে আর্থিক লেনদেনের খবর প্রকাশিত হয়। পত্রিকার মাধ্যমে আপনি নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে অবগত আছেন যে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে এসব বিষয় নিয়ে অসন্তোষ দানা বাঁধে এবং মহাপরিকল্পনার পুনর্বিন্যাস ও দুর্নীতির বিচারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। রোববার (৬ অক্টোবর) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক চিঠিতে এ তথ্য জানা যায়।

চিঠিতে আরও বলা হয়, প্রকল্প হাতে নেয়ার শুরু থেকেই লুকোছাপা, অস্বচ্ছতার খবর একের পর এক যেভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল, সেখান থেকেই আশঙ্কা ও অসন্তোষের শুরু। একটি বিশাল উন্নয়ন পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে, যা বিখ্যাত স্থপতি মাযহারুল ইসলাম প্রণীত পূর্বতন মাস্টারপ্ল্যানকে পর্যালোচনা ব্যতিরেকে বাস্তবায়ন করা আদৌ সম্ভব নয়। অথচ দেখা গেল নয়নাভিরাম জাহাঙ্গীরনগরের এই পরিবর্তন সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশীজনদের কেউই কিছু জানেন না। এই বিশ্ববিদ্যালয়েই বিভিন্ন বিশেষায়িত বিভাগ রয়েছে, সেখানে রয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সেই বিশেষজ্ঞদেরও অন্ধকারে রাখা হয় এবং এই মাস্টারপ্ল্যানে মূলত প্রশাসনের কতিপয় কর্তাব্যক্তির ইচ্ছার প্রকাশ ঘটে। দাবির মুখে উপাচার্য কিছু শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে কয়েকটি ভবনের নকশা দেখান এবং জানান, একনেকে পাস হয়ে গেছে বিধায় এই মাস্টারপ্ল্যান পরিবর্তন সম্ভব নয়। তিনি জানান, মাস্টারপ্ল্যান পরিবর্তন করতে গেলে বরাদ্দকৃত টাকা ফেরত চলে যাবে। এ পর্যায়েও দাবির মুখে অংশীজনদের পাশ কাটিয়ে নামমাত্র একটি পর্যালোচনা কমিটি গঠন করা হয়।

ইতিমধ্যেই পত্রিকার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে সরকারের নির্দেশনা উপেক্ষা করে ই-টেন্ডার না করে গতানুগতিক টেন্ডার চাওয়া হয়েছে। জানা যায়, টেন্ডার শিডিউল বিক্রির জন্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পুরো সময়টি টেন্ডার শিডিউল ব্যাংকে পাওয়া যাচ্ছিল না। কেবল শেষের কয়েক দিন শিডিউলটি পাওয়া যায়। এমনকি পত্রিকা থেকে আরও জানা যায়, একটি কোম্পানি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে লিখিত অভিযোগ করে যে, তাদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বলপূর্বক টেন্ডার দাখিল করতে দেয়া হয়নি। এসব বিষয়কে অমীমাংসিত রেখে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকে তোয়াক্কা না করে, কয়েক দফায় গাছ কেটে উন্নয়ন কার্যক্রম চালু রাখা হয়।

এত সবের মধ্যে এ বছর আগস্টের ২৩ তারিখ পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয় যে উপাচার্য ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের মধ্যে উন্নয়নের দুই কোটি টাকা ভাগ–বাঁটোয়ারা করেছেন। পত্রিকার দাবি, এই ভাগ–বাঁটোয়ারা উপাচার্যের বাসভবনে ঘটেছে ও তাঁর পরিবারের দুজন সদস্য তাতে অংশগ্রহণ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকেরা এই প্রসঙ্গে জানতে গেলে উপাচার্য স্বয়ং তাঁর অনুসারী কয়েকজন শিক্ষক নিয়ে সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতিগুলো থেকে নিন্দার ঝড় বয়ে যায়। টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারার ঘটনাটি সবিস্তারে দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন (২৩.৮. ২০১৯), দ্য ডেইলি স্টার (২৭.৮. ২০১৯) ও ঢাকা ট্রিবিউনে (৩০.৮. ২০১৯) প্রকাশিত হয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এই অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্তের দাবিসহ উন্নয়ন কার্যক্রমে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও অংশীদারত্ব নিশ্চিত করার সুনির্দিষ্ট দাবি নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যান। আন্দোলন চলাকালে দুই দফায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মারধরের ঘটনা ঘটে। সাংবাদিকদের নাজেহাল করা ও শিক্ষার্থীদের মারধর করাকে উপাচার্যের মরিয়া হয়ে আন্দোলন থামানোর প্রয়াস বলেই প্রতীয়মান হয়।

আন্দোলনের চাপের মুখে শেষাবধি প্রশাসন গত ১২ সেপ্টেম্বর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দুটি দাবি মেনে নেয়। এতে আন্দোলনকারীদের দাবির যৌক্তিকতাই প্রমাণিত হয়। তৎপরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বরাত দিয়ে এবং তাদের জড়িয়ে উপাচার্য, তাঁর পরিবার এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের আর্থিক লেনদেনের খবর জাতীয় দৈনিকগুলোয় প্রকাশিত হয়। এর পরপর ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও দৈনিক পত্রিকায় উপাচার্য ও সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতাদের চ্যালেঞ্জ-পাল্টা চ্যালেঞ্জের খবরগুলো প্রকাশিত হতে থাকলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দেশবাসীর সামনে খেলো হয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে ছাত্রলীগের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ১ নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং আরও দুজন সহসভাপতি ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে স্বীকার করেন যে তাঁরা উপাচার্যের বাসায় তাঁর পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারার মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন এবং তাঁরা টাকার ভাগ পেয়েছেন। তাঁরা এমনও দাবি করেন, ‘উপাচার্যের স্বামী ও পুত্রের মুঠোফোনের ৮ থেকে ১০ আগস্টের কললিস্ট পরীক্ষা করলেই প্রমাণ মিলবে’। এসব বাগ্‌বিতণ্ডায় প্রতীয়মান হয় যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অনৈতিক লেনদেনে জড়িত। উপাচার্য কেবল একটি পদ নয়, এটি প্রতীকী অর্থে নৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব। উপাচার্যের কালিমালিপ্ত হওয়া আমাদের সবার নৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সর্বোচ্চ নির্বাহীর প্রতি এহেন অভিযোগ আমাদের সবাইকেই জাতির সামনে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এবং এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। উপাচার্যের নৈতিক স্খলনজনিত এ অপরাধের কারণে আমরা মনে করি, তিনি তাঁর স্বপদে বহাল থাকতে পারেন না। তাঁকে আমরা স্বেচ্ছায় পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছিলাম, কিন্তু তিনি পদত্যাগ করেননি। এ কারণে আপনার মাধ্যমে আমরা তাঁর অপসারণ চাই।

আমরা আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে বিন্দুমাত্র বিঘ্ন না ঘটিয়ে আমাদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন জারি রেখেছি। এই রকম অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বেশি দিন চলতে দিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হবে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হিসেবে অবিলম্বে আপনার বিচক্ষণ হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করি।

(সামান্য সংক্ষেপিত)

লেখক: আবদুল জব্বার হাওলাদার, মো. খবির উদ্দিন, মোহাম্মদ কামরুল আহসান, মো. সোহেল রানা, সাঈদ ফেরদৌস, মির্জা তাসলিমা সুলতানা, নাজমুল হাসান তালুকদার, তারেক রেজা, সায়েমা খাতুন, এ এস এম আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া, শামীমা সুলতানা, জামাল উদ্দীন, মো. নূরুল ইসলাম, রায়হান রাইন, মুসফিক উস্ সালেহীন, সুস্মিতা মরিয়ম, খান মুনতাসীর আরমান, নজির আমিন চৌধুরী জয়, আশিকুর রহমান ও মাহাথির মোহাম্মদ

*লেখকেরা ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ আন্দোলনের সংগঠক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী।

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0056900978088379