আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষার দুরবস্থা ও সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণে চাই আন্তরিকতা - দৈনিকশিক্ষা

আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষার দুরবস্থা ও সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণে চাই আন্তরিকতা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বর্তমান সরকার আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষার যে মহৎ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, তা সঠিক পরিকল্পনার অভাবে ভেস্তে যেতে বসেছে। আদিবাসী-অআদিবাসী অভিজ্ঞদের নিয়ে শিশুদের উপযোগী পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, ছাপানো এবং স্থানীয় পর্যায়ে শিশুদের মাঝে পাঠ্যবই বিতরণও সম্পাদিত হয়েছে। সবকিছুই সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হলেও মূল জায়গায় অর্থাৎ শিক্ষকের অভিজ্ঞতা, পারদর্শিতা, কিংবা ভাষার ওপর তাদের দখল প্রত্যাশিত; কিন্তু ছেলেমেয়েরা শিক্ষকদের কাছ থেকে মাতৃভাষায় তেমন কিছুই অর্জন করতে পারেনি।

হাজার হাজার বই-পুস্তক প্রিন্টিং এবং বিনামূল্যে বিতরণের পর শিক্ষকদের প্রতি আমাদের উদাসীনতা, অবহেলায় কিংবা প্রয়োজনীয় ভাষা জ্ঞানের অভাবেই অথবা প্রশিক্ষণে যুগোপযোগী কৌশলের অভাবে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের ছেলেমেয়েরা মাতৃভাষার স্বাদ আস্বাদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।  শনিবার (১৫ জুন) দৈনিক সংবাদের নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিব্ন্ধনটি লিখেছেন মিথুশিলাক মুরমু।

২০১৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ, গারো, উরাঁও জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও ছেলেমেয়েদের শিক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে। এই তালিকায় উত্তরবঙ্গের সর্বাধিক জনগোষ্ঠী সাঁওতালদের নাম থাকলেও বর্ণমালা বিতর্কের ইস্যুতে আজ পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের কার্যক্রম আলোর মুখ দেখেনি। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মাতৃভাষায় পাঠদান ও শিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কে সম্প্রতি দেশের জাতীয় দৈনিকের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, প্রতিবেদনে বলা হয়-

‘পার্বত্য এলাকায়, বিশেষ করে রাঙামাটিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা ভাষার পাঠ্যবই দেয়া হলেও গত তিন বছরে তাদের ভাষা শিক্ষার ফলাফল শূন্য। মাতৃভাষায় স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ পড়তে শেখেনি তারা। তাদের মধ্যে অনেকেই এখনও নিজের নাম লিখতে ও পড়তে পারে না। মাতৃভাষার জ্ঞান না থাকায় অভিভাবকরাও নিজের সন্তানকে এ বিষয়ে বাড়িতে পড়াতে পারছেন না। বিদ্যালয়ে পাঠদান হচ্ছে কি না, তা-ও খোঁজখবর নিতে পারছেন না। তিন বছর আগে রাঙামাটির প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এই কার্যক্রম শুরু হলেও দক্ষ শিক্ষক না থাকায় কর্মসূচি এগোচ্ছে না। মাতৃভাষা শিক্ষায় পরীক্ষা ছাড়াই শিক্ষার্থীরা এক শ্রেণী থেকে আরেক শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হচ্ছে। এ কারণে শিক্ষার্থীদের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। পাঠ্যবই দেওয়া হলেও শিক্ষক সংকট, অনিয়মিত পাঠদান ও পাঠ্যসূচি না থাকায় শিক্ষার্থীদের ভাষাশিক্ষায় কোন অগ্রগতি হচ্ছে না। পরীক্ষা ছাড়াই এক শ্রেণী থেকে আরেক শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাতৃভাষা শিক্ষায় আগ্রহ বাড়ছে না।’

আমরা বরাবরই দাবি করে আসছি, মাতৃভাষায় পাঠদান করার পূর্বশর্ত হচ্ছেই সেই ভাষার শিশু উপযোগী পাঠ্যপুস্তক, ভাষা শিক্ষার ধারাবাহিকতা, অভিজ্ঞ শিক্ষক, শিক্ষার পরিবেশ, ব্যাকরণ, অভিধান, বয়স্ক শিক্ষাসহ সর্বত্র ব্যবহারের ক্ষেত্র অর্থাৎ প্রতিদিনের জীবনপ্রবাহেÑ ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানাদি এবং এতদ্সংক্রান্ত মাতৃভাষায় পুস্তকাদি বিতরণ করে মাতৃভাষার গুরুত্ব তুলে ধরা।

উত্তরবঙ্গের আদিবাসী সাঁওতালদের মাতৃভাষায় পাঠদান কার্যসূচি আবারও পিছিয়ে পড়ল একটি বছর। কেউ বলেছেন সাঁওতালী বর্ণমালায়, কেউ বলেছেন বাংলা বর্ণমালায় আবার কেউবা দাবি করেছেন অলচিকি বর্ণমালা।

যারা সাঁওতালী বর্ণমালার পক্ষে অবস্থান করেছেন, তাদের যৌক্তিকতাই হচ্ছে- যে বর্ণমালার যাত্রা শুরু হয়েছে ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে এবং এই বর্ণমালায় শিক্ষার যাবতীয় উপকরণ, কৌশল, পদ্ধতি, প্রক্রিয়াসমূহ বিদ্যমান, সেটিকে বাদ দিয়ে কেন আমরা নতুনের দিকে ধাবিত হচ্ছি। সাঁওতালী বর্ণমালা ব্যতিত অন্য বর্ণমালায় প্রণীত হলে সম্পূর্ণ নতুন বর্ণমালার পরিচয়, প্রসারতা, শিক্ষকদের অজ্ঞতাসহ নানা ধরনের সমস্যায় জরাগ্রস্ত হয়ে সরকারের সদিচ্ছার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। রাষ্ট্রীয় সীমানার অধিবাসীদের বৃহদাংশের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানানো উচিত। আদিবাসী সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষাকে রাজনীতির বৃত্ত থেকে বের করে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় যে শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, তা আশু বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করতে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি।

সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) কর্তৃক প্রতিবেদনে দেশের আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যের চিত্র ফুটে উঠেছে। দেশের আদিবাসীরা সামাজিক জীবনযাপন করতে গিয়ে যে বৈচিত্র্যময় বৈষম্যের মুখোমুখি হয়ে থাকেন, সেটিকে এখন আর কেউ তেমন আমলে নেন না বরং বৈষম্যের বাধাকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণাই সর্বস্তরে পরিলক্ষিত হয়। কালেভাদ্রে দু’একটি বৈষম্যের প্রতিবেদন আমাদেরকে আন্দোলিত করলেও অনেক ঘটনাই জীবনের চাকায় চাপা পড়ে যায়।

টিআইবি দেশের ২৮টি জেলায় বছরব্যাপী (২০১৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) গবেষণা চালিয়েছে। আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভূমি, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি এবং স্থানীয় সেবা বিষয়াটি গবেষণার বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করা হয়। টিআইবি’র গবেষণার সারবস্তু হলো- সংবিধানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের পৃথক জাতিসত্তা ও দলিতদের পরিচয়ের স্বীকৃতি নেই। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ দলিত সম্প্রদায়ের শিশুদের অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা নেই।

এছাড়া অন্তর্ভুক্তিমূলক স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টিও নেই। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতে সব ধরনের কোটা তুলে দেয়া হয়েছে। সেখানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের পাঁচ শতাংশ কোটা ছিল। গবেষণায় বলা হয়, কোটা সংস্কারের দাবি অগ্রাহ্য করে এই ৫ শতাংশ কোটাও বিলুপ্ত করা হয়েছে। ভূমি ব্যবহার নীতি ২০১১ তে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের প্রথাগত ভূমির মালিকানা নেই।

কিছু ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও দলিত সম্প্রদায়ের সন্তানেরা স্কুলে ভর্তিতে বাধা পায়। নিজ ধর্মশিক্ষা ও মাতৃভাষায় পড়ার সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হয়। স্বাস্থ্যসেবা পেতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও দলিত সম্প্রদায়ও নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিতে বাধ্য হয়ে থাকে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া চিকিৎসক ও নার্সরা এ জনগোষ্ঠীর কোন রোগীকে স্পর্শ করতে চান না। শয্যা ও প্রয়োজনীয় ওষুধ না দেয়ার ঘটনাও ঘটে। গর্ভকালীন সেবা ও শিশুরা টিকা সেবা থেকেও বঞ্চিত হয়ে থাকে। এ বিষয়ে সরকারের সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী জনাব শরীফ আহমেদও বলেছেন,

‘বিভিন্ন প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর মানুষের প্রতি সরকারি সব দফতরে যেন ন্যায্য আচরণ করা হয়, এ বিষয়ে একটি চিঠি আমরা দিয়েছি। এই চিঠি বিভিন্ন দফতরে পৌঁছে যাবে। অস্পৃশ্যতা বা কোন কারণেই কারও প্রতি অন্যায় আচরণ সহ্য করা হবে না।’

আমার দেশের সচেতন নাগরিকগণ দ্বিমত পোষণ করতে পারেন কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে, আমরা যারা আদিবাসী-অন্ত্যজ জনগোষ্ঠী রয়েছি; কখনও বৈষম্যকে গুরুত্বারোপ করিনি। সামাজিক বৈষম্যকে নিরসনে, দূরীকরণে জ্ঞানভিত্তিক আলোচনা, সচেতনতা সৃষ্টিতে ব্যাপৃত রয়েছি। স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের মধ্যে বৈষম্যের যে রেখাচিত্র, এটি ক্রমশঃই সাধারণ মানুষের আলোচনায় উঠে এসেছে। বিশ্বাস করি, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, উঁচু-নিচু, সাদা-কালো, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, আদিবাসী-অন্ত্যজের মধ্যে সন্তোষ অচিরেই বিলুপ্ত হবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) কতগুলো সুপারিশও তুলে ধরেছে- ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের পৃথক পৃথক জাতিসত্তা ও দলিতদের সাংবিধানিক পরিচয়ের স্বীকৃতি, সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে কোটা পুনর্বহাল, বিদ্যমান আইন ও নীতিকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও দলিতদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক করা, মাতৃভাষায় পাঠদান ও তার জন্য শিক্ষক নিয়োগ, সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা প্রদানে দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো।

অক্সফাম বাংলাদেশ-এর পলিসি ম্যানেজার এসএম মনজুর রশীদ এক গোলটেবিল বৈঠকে বলেছেন, ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, হিজড়া, প্রতিবন্ধীদের মতো সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর যুবকদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ তৈরি করতে সরকারের প্রতি আহবান জানান’ (প্রথম আলো ১৫.৩.২০১৯)।

আমরা বলতে চাই, শ্রেণী, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। যেসব আইন ও নীতি মানুষে মানুষে বৈষম্য তৈরি করছে, সেসব আইন ও নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। আদিবাসী ও দলিত সম্প্রদায়ের সব নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে প্রয়োজন সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হবে। এ বিষয়ে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মহান সংসদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। রাষ্ট্রকে মানবিক করতে, মানুষে মানুষে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে যা যা দরকার সেটাই করতে হবে।

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.005018949508667