কিন্ডারগার্টেনগুলো এবং বর্তমানকালে চালু হওয়া প্রি-প্রাইমারি স্কুলগুলো শিশু শিক্ষার্থীদের মেধার প্রসার ঘটাচ্ছে নাকি মেধার স্বাভাবিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে? চার বছর বয়স হলে শিশুদের স্কুলে যেতে হচ্ছে যে কালচার আগে ছিল না। এই বয়সে শিশুরা কি প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার চাপ নিতে পারে? এখন চার বছর নয় তিন বছর সাড়ে তিন বছর হলেই অভিভাবকরা পাঠিয়ে দেন নিকটস্থ কিন্ডারগার্টেনে। এটিকে বর্তমানে আবার নাম দেওয়া হয়েছে ’ই সি ডি’ অর্থাৎ আর্লি চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট। একটি শিশুর পক্ষে শিক্ষার চাপ সহ্য করতে পারার কথা কমপক্ষে ছয় বছর বয়সে। কিন্তু তিন কিংবা সাড়ে তিন এমনকি চার বছর বয়সে স্কুল নামক সামাজিক প্রতিষ্ঠানে যখন শিশু শিক্ষার্থীদের যেতে হয়, তখন তার মস্তিষ্কের যে স্থায়ী ক্ষতিসাধিত হয় তার ক্ষতিপূরণ সারাজীবনেও করা সম্ভব হয় না।
দার্শনিক রুশো, অ্যারিস্টটল, প্লেটো থেকে শুরু করে আধুনিক দার্শনিক অগাষ্ট কোঁতে, ফ্রান্সিস বেকন, জন ডিউই প্রমুখ দার্শনিক শিশু শিক্ষার ব্যাপারে বস্তুনিষ্ঠ মতামত দিয়েছেন আর সেটি হচেছ শিশুদের ছয় বছরের আগে স্কুলে পাঠানো উচিত নয়। দার্শনিক রুশো চমৎকারভাবেই বলেছেন যে, শিক্ষা গ্রহণের জন্য শিশুকে প্রকৃতির হাতে ছেড়ে দিতে হবে। সে প্রকৃতি থেকে শিখবে, স্বাধীনভাবে শিখবে। যেমন আমাদের বাসার ছোট ছোট শিশুদের আমরা কি করতে দেখি? তারা যতক্ষণ জেগে থাকে ততক্ষণ একটির পর একটি বিষয় নিয়ে, জিনিস নিয়ে বাসার আসবাবপত্র নিয়ে সর্বদাই ব্যস্ত থাকে। একটির পর একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে, মুখের সামনে এনে দেখায়, জানতে চায় সেটি কি, কি কাজ করা হয় সেটি দিয়ে। সে একটি বস্তু নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা করে, আছাড় দেয়। সেখান থেকে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এগুলো প্রকৃতির শিক্ষা। এটিই তার সবচেয়ে বড় বিদ্যালয়, শেখার বড় জায়গা। সে স্বাধীনভাবে শেখে। গ্রামের বাড়িতে হলে বাড়ির উঠোনে অঙ্গিনায় ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, হাঁস মুরগী পশুপাখি দেখে , তাদের সাথে কথা বলে, ভাববিনিময় করে। শহরের বাড়িতে/ফ্ল্যাটে জায়গা নেই তবুও সারাদিন এই রুম থেকে সেই রুমে ঘুরে বেড়ায়, টিভি দেখে বাসার আসবাবপত্র দেখে, ধরে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে, ভাঙ্গে, আছাড় দেয়, আদর করে, লুকিয়ে রাখে, নিজের জায়গায় নিয়ে যায়। এসবই তার প্রাকৃতিক শিক্ষার অংশ। আমরা যে ইসিডি কেন্দ্র বলি বা প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় বলি সেসব স্থানে কি এগুলোর কোন কিছুই করার সুযোগ শিশুরা পায়? অবশ্যই পায়না। যে অর্থেই বলিনা কেন সেখানে শ্রেণিশাসিত দেখাশুনা, পড়াশুনা হয়ে থাকে যা তার স্বাভাবিক বিকাশ ও জানার জগত ও পথকে শুধু সীমিত নয়, বাধাগ্রস্ত করে।
একটি শিশু যতদিনে নিজে আগ্রহ করে কিছু শিখতে না চাবে ততদিন তার ওপর কোন কিছু শেখার জন্য চাপ প্রয়োগ করা বিজ্ঞানসম্মত নয়। সে যখন শারীরিকভাবে কিছু শেখার যোগ্যতা অর্জন করবে তখন সে নিজে শিখতে চাইবে, আর তখনই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু করা উচিত। মটর ডেভেলপমেন্ট বলে শিক্ষা বিজ্ঞানে যে কথাটি প্রচলিত আছে তার বাংলা অর্থ হচ্ছে অঙ্গ সঞ্চালনের উন্নতি। এই অঙ্গ সঞ্চালন হলো হাত, পা, পাকস্থলী, হৃৎপিন্ড, ¯œায়ুতন্ত্র, মস্তিষ্ক ইত্যাদি। শিক্ষাবিজ্ঞান কিংবা পেডাগজিতে মস্তিষ্ক উন্নয়নের কথা জোর দিয়ে বলা হয়েছে। শিশুবয়সে মানুষের পা, হাঁটু, কোমর নরম থাকে, শিশু দাঁড়াতে পারে না। জন্মের সময় শিশুর মস্তিস্ক থাকে খুবই নরম। ধীরে ধীরে তা মজবুত হতে থাকে। ওজন শরীরের উপর চাপ দেয়। এই চাপ মাথা, ঘাড়, মেরুদ-, কোমর, হাঁটু এবং পা বহন করে। একইভাবে বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষার চাপ বহন করে মগজ বা মস্তিষ্ক।
শিক্ষার চাপ বহন করার ক্ষমতা অর্জনের জন্য একটা ন্যুনতম বয়স প্রয়োজন। সেই বয়সের আগে চাপ প্রয়োগ করলে শিশুর যতটুকু মেধাবী হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, ততটুকু মেধাবী সে হতে পারে না। এমনকি তার অর্ধেকও নয়। অর্থাৎ শিশু হয়ে যায় মেধাহীন। জন্মের পর অন্যান্য অঙ্গের মতো আস্তে আস্তে শিশুর মগজের উন্নতি হতে থাকে। আস্তে আস্তে সে বাবা-মাকে চেনে, তারপর তার আশ পাশে যারা থাকে তাদের চেনে। তাদের মুখের কথা শুনতে শুনতে সে একটু একটু কথা বলতে শুরু করে। এভাবে দেখতে দেখতে এবং শুনতে শুনতে নিজে বলতে শেখে। এর জন্য শিক্ষকের প্রয়োজন হয় না, চারপাশের পরিবেশই তার শিক্ষক। যেহেতু সে নিজেই নিজের মতো করে শেখে, তাই তার ব্রেইনে কোন চাপ পড়েনা।এ ক্ষেত্রে সব শিশু সমানভাবে শেখে না, সবাই সমান সময় নেয় না। যার মেধা বেশি তার সময় কম লাগে, আর যার কম তার একটু সময় বেশি লাগে। এই মেধা শিশু জন্মের আগেই পেয়ে থাকে। জন্মের পর মগজ গঠন বা মগজ মজবুত হওয়ার পর্যাপ্ত সময় না দিলে শিশু জন্মগত মেধার বিশাল অংশ হারিয়ে ফেলে।
শিশুর জন্মগত মেধাই সর্বোচ্চ মেধা। এই মেধা বাড়ানো যায় না। শিক্ষার কাজ হলো এই মেধার বিকাশ ঘটানো। মানবশিশু অনেক বেশি মেধা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। আইনস্টাইনের মতো মহাবিজ্ঞানীও তার মেধার অতি সামান্য অংশ বিকশিত করতে পেরেছিলেন। এর অর্থ প্রতিটি শিশু বিশাল সম্ভাবনা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। শিক্ষা এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সাহায্য করে। কিন্তু মস্তিষ্ক গঠনের আগেই শিক্ষার জন্য স্কুলে লেখাপড়া শুরু করলে মেধার খুব কম অংশ বিকশিত হয়। এই একই শিশুকে পূর্ণ বয়সে, ৬কিংবা ৭ বছরে স্কুলে পাঠালে অনেক বেশি মেধার বিকাশ ঘটে।
বইপুস্তক ও হাতে কলমে শেখা শিশুর জন্য বাড়তি চাপ। এই চাপ শিশু কত বছর বয়সে সহ্য করতে পারে তা বিচার্য বিষয়। শিক্ষাবিজ্ঞানীরা মোটামুটি একমত যে, শিশুর বয়স কমপক্ষে ছয় বছর পূর্ণ হলে শিশুর মগজের যে উন্নতি হয় তাতে বর্ণ পরিচয়, শব্দ শিক্ষা এবং সহজ বাক্য পড়ার মতো ক্ষমতা অর্জন করে। ধীরে ধীরে গণিতের যোগ , বিয়োগ, গুণ, ভাগ এবং পাটি গণিতের অতি সহজ সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারে। কিন্তু ছয় বছরের পরিবর্তে তিন বা চার বছর বয়সে এই চাপ প্রয়োগ করা হলে শিশুর মগজের ক্ষতি হয়ে যায়। এই ক্ষতি সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়ে না। ধরা পড়ে পাঁচ ছয় বছর পর যখন সে ষষ্ঠ কিংবা সপ্তম শ্রেণিতে ওঠে। কারণ এ সময় কোর্স বৃদ্ধি পায়, কোর্স কঠিন হয়। তখন সে অনেক কিছুই কুলাতে পারেনা। অপ্রাপ্ত বয়সে স্কুলে ভর্তি হওয়ার কারণে শিশু অনেক ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলে আর অর্জন করতে পারে না।
শ্রেণিকক্ষে পড়াতে গিয়ে দেখা যায় কিছু ছেলেমেয়ে শিক্ষকের পাঠদান বুঝার চেষ্টা করে কিন্তু বুঝতে পারে না। পরখ করলে দেখা যায় শ্রেণির তুলনায় তাদের বয়স কম। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, এসব ছেলেমেয়ে তিন বা চার বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। বর্তমানে এ ধরণের ঘটনা প্রচুর ঘটছে। ব্রেইন বা মস্তিষ্কের ক্ষমতা নির্ভর করে মস্তিষ্কের পরিমাণের উপর নয়, এর মিলন বন্ধনীর উপর। যার মগজের মিলন বন্ধনী যত বেশি তার ব্রেইন তত উন্নত। সে বেশি মনে রাখতে পারে এবং সঠিক চিন্তা করতে পারে। যার ব্রেইনের বন্ধনী ঢিলা তার ব্রেইন দুর্বল। শুধু মানুষ নয়, প্রাণীর ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। গাধার মগজ বেশি কিন্তু ঢিলা, আবার শিয়ালের মগজ কম, কিন্তু মগজ মজবুত। শিশুর মস্তিষ্কে অল্প বয়সে শিক্ষার চাপ প্রয়োগ করা হলে এই মিলন বন্ধনী মজবুত হতে পারেনা।
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত। তাই যে কোন সচেতন ও সভ্য সমাজে শিশুকে দেওয়া হয় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। বয়স্করা চলে যাবে, শিশুরা সেই জায়গা দখল করবে, এটি প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। শিশুরাই জাতির ভবিষ্যত, তাদের মাধ্যমেই এই বিশ্বের নিরন্তর এগিয়ে যাওয়ার নিয়ম প্রতিফলিত হয়। যেসব শিশুরা দিব্যি মনের আনন্দে আর স্বাভাবকি চঞ্চলতা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে , তাদেরকেই যখন পড়তে বসানো হয় তখন দেখা যায় তারা পড়া বাদ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের দুষ্টুমিতে জড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন ধরনের বায়না ধরে, ঘুমের ভান করে। এই সময়ে বাবা কিংবা মা বিরক্ত হয়ে তাদের সাথে মেজাজ দেখান, রাগারাগি করেন এমনকি গায়ে হাত দিয়ে শাসন করেন। আসলে তাতে ফল হয় উল্টো। পড়ার বিষয়টি তার কাছে যেহেতু আনন্দদায়ক নয় এবং তার মতো করে কিছু হয়তো লেখা নেই কিংবা সেভাবে পড়ানো শুরু করা হয়নি বিধায় তারা এ ধরনের আচরণ করে থাকে। কাজেই বিষয়টি বাবা-মাকে অত্যন্ত সচেতনতার সাথে বিবেচনা করতে হবে। আমাদের ইসিডি সেন্টারগুলো বা শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়গুলো শিশুদের এই মনস্তত্ত্ব কতটা বিজ্ঞানসম্মতভাবে ডিল করে তা দেখার বিষয়।
লেখক: ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিত কর্মরত সাবেক ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজ শিক্ষক