মেয়েদের স্কুল-কলেজে না পাঠানোর জন্য হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফির ওয়াদা করানো এবং নারীশিক্ষার প্রতি কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। তারা আহমদ শফিকে নারীবিদ্বেষী, স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী ও সংবিধানবিরোধী অভিহিত করে তার বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানান।
শনিবার (১২ জানুয়ারি) বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও বিবৃতির মাধ্যমে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, নারীপক্ষ, বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্র, জাতীয় নারী জোট, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট এ দাবি জানায়।
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এমপি এক যৌথ বিবৃতিতে আহমদ শফির নারী শিক্ষাবিরোধী বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। তারা বলেন, শফি হুজুরের নারী শিক্ষাবিরোধী বক্তব্য সংবিধানবিরোধী, মৌলিক অধিকারবিরোধী, মানবাধিকার বিরোধী, নারী অধিকার বিরোধী, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। এমনকি ইসলামবিরোধী। ইসলামে কোথাও নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে কোনো কথা নেই। তারা বলেন, আহমদ শফি ধর্মের অপব্যাখ্যা করে মনগড়া ফতোয়া দিয়ে দেশ ও সমাজকে আলো থেকে অন্ধকারে নিতে চান। শফির নারী শিক্ষাবিরোধী ফতোয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান।
বিবৃতিতে বলা হয়, সরকার মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়ন, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ-খবরদারি-নজরদারিতে আনতে চায়। সরকার দাওরায়ে হাদিস সনদকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়েছে। এটাকে সরকারের দুর্বলতা ভেবে তেঁতুল হুজুররা বাড়াবাড়ি করলে, তার ফলাফল তাদের ভোগ করতে হবে।
নারীপক্ষের আন্দোলন সম্পাদক ফরিদা ইয়াছমিন স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, ১১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের হাটহাজারীর দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার বার্ষিক মাহফিলে অংশগ্রহণকারীদের হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফী মেয়েদের স্কুল-কলেজে না পাঠানোর জন্য ওয়াদা করিয়েছেন। পাঠালেও বিয়ের পরে স্বামীর টাকা-পয়সার হিসাব রাখা ও স্বামীর কাছে চিঠি লেখার জন্য কেবল চতুর্থ কিংবা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানোর কথা বলেছেন। মেয়েদের উচ্চশিক্ষার বিষয়ে তিনি আরও অনেক কদর্য ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন, যা দেশ ও জাতির জন্য অপমানকর। তিনি নিন্দা জানিয়ে বলেন, 'এমন পশ্চাৎপদ এবং নারী শিক্ষা বিস্তারের পক্ষে সরকারি নানামুখী পদক্ষেপ ও নীতির পরিপন্থী বক্তব্য দেওয়া ও ওয়াদা করানোর জন্য সরকার তার বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে তাও জানতে চায় নারীপক্ষ।'
বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্রের সভাপতি সীমা দত্ত বিবৃতিতে বলেন, যে সময়ে নারী-পুরুষের সবক্ষেত্রে সমান অধিকার ও সমমর্যাদা সময়ের দাবি, সে সময়ে হেফাজতের আমির শফী মেয়েদের চতুর্থ কিংবা পঞ্চম শ্রেণির বেশি না পড়ানোর কথা বলেছেন। এ ধরনের বক্তব্য সমস্ত নারী সমাজ এবং সচেতন মানুষের জন্য অসম্মানজনক। শিক্ষার উদ্দেশ্য যেখানে প্রকৃত মানুষ গড়ে তোলা, সেখানে শফীর এমন বক্তব্য নারীর জন্য অপমানজনক। অবিলম্বে শফীকে এ প্রতিক্রিয়াশীল বক্তব্য প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাইতে হবে। বিবৃতিতে তিনি আজ রোববার বিকেল ৪টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আল্লামা শফীর বক্তব্যের প্রতিবাদে এক বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
নারী শিক্ষাবিরোধী বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে জাতীয় নারী জোট। জোটের আহ্বায়ক আফরোজা হক রীনা আহমদ শফীর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান। সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি রওশন আরা রুশো ও সাধারণ সম্পাদক শম্পা বসু এক যৌথ বিবৃতিতে সংবিধান পরিপন্থী নারীবিদ্বেষী বক্তব্য দানকারী শফী হুজুরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।
এদিকে গতকাল 'একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন :পর্যালোচনা' শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বক্তারা নারীবিদ্বেষী আহমদ শফীকে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে বলেন। সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংগঠনের সভাপতি জিয়া উদ্দিন তারেক আলীর সভাপতিত্বে সভায় বক্তব্য দেন সংগঠনের প্রেসিডিয়াম সদস্য পঙ্কজ ভট্টাচার্য, অধ্যাপক ড. আজিজুর রহমান, অ্যাডভোকেট এসএমএ সবুর, অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, অ্যাডভোকেট অশোক সরকার, জয়ন্তী রায়, অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য একে আজাদ, অ্যাডভোকেট পারভেস হাসেম প্রমুখ।
সভায় সমাজ প্রগতির অগ্রযাত্রাবিরোধী হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফীকে অবিলম্বে তার ঘৃণিত বক্তব্য প্রত্যাহার ও জাতির কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানানো হয়।
সংবিধান পরিপন্থী নারীবিদ্বেষী বক্তব্যের জন্য শফি হুজুরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট। গতকাল সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ইমরান হাবিব রুমন এবং সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন প্রিন্স এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, শফী হুজুরের এই বক্তব্য নারী অধিকার পরিপন্থী। একই সঙ্গে সংবিধান পরিপন্থীও বটে। সংবিধানের ২৮(২) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে 'রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমান অধিকার লাভ করিবেন।' ২৮ (৩) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোনও নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না।' এর আগেও এই হুজুর নারী সমাজকে অবমাননা করে তাদের তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করে বক্তব্য দিয়েছিলেন। এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকার।