ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে উচ্চশিক্ষিত প্রার্থীর সংখ্যা কমেছে আর ব্যবসায়ী প্রার্থী বেড়েছে। অর্থাৎ প্রার্থীদের মানের অবনতি ঘটেছে। রাজনীতি পুরোপুরি ব্যবসায় পরিণত হচ্ছে। এই নির্বাচনে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেয়া প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্নেষণ করে এসব তথ্য বের করেছে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন।
শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। আসন্ন নির্বাচন ও ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে প্রার্থীদের দেওয়া হলফনামার তথ্য বিশ্নেষণ করে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে বলে তিনি জানান।
এ সময় তিনি ঢাকার দুই সিটি ভোটে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে বলেন, এখানেও কারচুপির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন সুজনের সভাপতি এম হাফিজ উদ্দীন খান, ক্যামেলিয়া চৌধুরী, নাজিমউদ্দিন ও শফিউদ্দিন আহমেদ।
হলফনামার তথ্য উপস্থাপন করেন সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার। হাফিজ উদ্দীন খান বলেন, হলফনামার তথ্যের সঠিকতা যাচাই করা না হলে এসব তথ্য নেওয়ার কোনো অর্থ নেই। তিনি হলফনামার তথ্য যাচাই করার দাবি জানান।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, রাজনীতি ধনাঢ্য হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছে। ধনী প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। আবার উচ্চশিক্ষিত প্রার্থীর সংখ্যা কমছে। সব মিলে প্রার্থীদের মানে অবনতি ঘটছে। তিনি বলেন, কাউন্সিলর পদে নির্দলীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু দলগুলো দলীয় মনোনয়ন দিচ্ছে।
দলগত নির্বাচন হলে প্রার্থীর সংখ্যা কমে যায়। বেশি প্রার্থী থাকলে যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী খুঁজে পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয় ভোটারদের। তিনি বলেন, আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলেও এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের সক্রিয়তা নেই। এক নির্বাচন কমিশনারও বলেছেন, নির্বাহী হাকিমদের কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়। কেউ হয়তো এমন কিছু করতে চান না, যাতে সরকারি দল রুষ্ট হয়। এটা অশনিসংকেত।
ইভিএম ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থাহীনতার কারণেই ইভিএম নিয়ে বেশি বিতর্ক হচ্ছে। ইভিএমের ভোটে অডিট ব্যবস্থার সুযোগ নেই। ভোটার কাকে ভোট দিচ্ছেন, তা নিশ্চিত নয়। এক মার্কায় ভোট দিলে অন্য মার্কায় কাউন্ট হতে পারে। প্রিন্ট-আউটের ব্যবস্থা নেই। ভারতীয় ইভিএমের তুলনায় এগারো গুণ বেশি দামে কেনা হলেও প্রিন্টের ব্যবস্থা এতে নেই।
সুজনের দেয়া তথ্যে ঢাকা উত্তরের মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর মিলিয়ে মোট ৩৩১ প্রার্থীর মধ্যে অধিকাংশের (২০৩ জন বা ৬১ দশমিক ৩২ শতাংশ) শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি বা তার নিচে। ঢাকা উত্তরের ছয় মেয়র প্রার্থীর মধ্যে পাঁচজন (৮৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ) উচ্চশিক্ষিত। ঢাকা উত্তরের ৫৪টি ওয়ার্ডের ২৪৮ জন সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে অধিকাংশ প্রার্থীর (১৫৬ জন বা ৬২ দশমিক ৯০ শতাংশ) শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি বা তার নিচে। শুধু এসএসসির নিচেই রয়েছেন ১২৩ জন (৪৯ দশমিক ৫০ শতাংশ)। আর স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী প্রার্থী মাত্র ২২ জন।
সুজন বলেছে, মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিতের হার বেশি হলেও কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে স্বল্প শিক্ষিতের হার বেশি। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের তুলনায় এবার ঢাকা উত্তরে স্বল্প শিক্ষিত প্রার্থীর হার বেড়েছে। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ ছিল ৫৯ দশমিক ৪০ শতাংশ, এবার ৬১ দশমিক ৩২ শতাংশ। অন্যদিকে উচ্চশিক্ষিত প্রার্থীর সংখ্যা কমেছে। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ ছিল ২৭ দশমিক ৪১ শতাংশ, এবার উচ্চশিক্ষিত প্রার্থী ২৫ দশমিক ২৭ শতাংশ।
ঢাকা দক্ষিণের ৪০৯ প্রার্থীর মধ্যে অধিকাংশের (২৬৬ জন বা ৬৫ দশমিক ০৩ শতাংশ) শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি বা তার নিচে। স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী আছেন ৭৯ জন বা ১৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। সাত প্রার্থী শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখ করেননি। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনের প্রার্থীদের তুলনায় এবার দক্ষিণে স্বল্পশিক্ষিত প্রার্থীর হার সমান রয়েছে। তবে উচ্চশিক্ষিত প্রার্থীর হার কিছুটা কমেছে।
এ ছাড়া মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর মিলিয়ে ঢাকা উত্তর সিটির ৩৩১ প্রার্থীর মধ্যে ২৪১ জন বা ৭২ দশমিক ৮১ শতাংশের পেশা ব্যবসা। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে ব্যবসায়ী প্রার্থী ছিলেন ৬৭ দশমিক ২০ শতাংশ।
ঢাকা দক্ষিণে ৪০৯ প্রার্থী পেশা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে ৩০১ জনের (৭৩ দশমিক ৫৯ শতাংশ) পেশা ব্যবসা। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে এখানে ব্যবসায়ী প্রার্থী ছিলেন ৭১ দশমিক ২৮ শতাংশ।
ঢাকা উত্তরে ৩৩১ প্রার্থীর মধ্যে ৯৯ জনের (২৯ দশমিক ৯১ শতাংশ) বিরুদ্ধে মামলা আছে। এর মধ্যে ২৩ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা (৩০২ ধারায়) আছে। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দেরতুলনায় মামলায় আসামি প্রার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। ওই সময়ে এমন প্রার্থী ছিলেন ১৯ দশমিক ৬২ শতাংশ।
ঢাকা দক্ষিণে ৪০৯ প্রার্থীর মধ্যে ১০৯ জন বা ২৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা আছে। এর মধ্যে ৩০২ ধারায় মামলা আছে ১৭ জনের বিরুদ্ধে। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দেরনির্বাচনে ২০ দশমিক ৪৫ শতাংশ প্রার্থীর নামে মামলা ছিল।
ঢাকা উত্তরের ৩৩১ প্রার্থীর মধ্যে ১৮৬ জনের (৫৬ দশমিক ১৯ শতাংশ) বার্ষিক আয় ৫ লাখ টাকা বা তার কম। আয় উল্লেখ না করা ৩৪ জনকে হিসাবে ধরলে ৫ লাখের কম বা স্বল্প আয়ের প্রার্থী ৬৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ। গত নির্বাচনে স্বল্প আয়ের প্রার্থী ছিলেন ৭০ দশমিক ৭০ শতাংশ। অন্যদিকে গত নির্বাচনে কোটি টাকার বেশি আয় ছিল ৩ জনের; এবার কোটিপতি প্রার্থী ৭ জন।