‘আপনার ক্লাস ছিল একটি উঁচু দরের সিম্ফনির মতো। সেখানে আপনিই একমাত্র বাজনাদার, আর আপনিই পরিচালক, যিনি ছড়ি উঠিয়ে নামিয়ে নানান সুরে, নানান লয়ে, নানান ধ্বনিতে নিজের বাজনাকেই ছড়িয়ে দিতেন আপনার শিক্ষার্থীদের মাঝে। আমরা উদ্বেলিত হতাম, ভেসে যেতাম, স্তব্ধ হয়ে যেতাম সে কলা-কৌশলে। কিন্তু আপনি শ্রেণীর সবচেয়ে দূরতম শ্রোতাটিকে মাথায় রেখে আপনার বাদন সংগত করতেন।’
বেশ কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০ বছর আগে অর্থনীতি বিভাগের আমার এক শিক্ষার্থী এক দীর্ঘ পত্রের মধ্যে লিখে পাঠিয়েছে উপর্যুক্ত কথাগুলো। ইংরেজিতে লেখা পত্র, ভাষান্তর করে লিখলাম। পশ্চিমের এক বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ততোধিক নামজাদা এক অধ্যাপক সে এখন। আমার দুই দশকের শিক্ষকতা জীবনে প্রাপ্ত নানা প্রশস্তির মধ্যে এ এক অনন্য সনদ। জানি, কী বলতে চেয়েছে সে তার বক্তব্যের শেষ লাইনটিতে। সত্যি, শ্রেণীর সবচেয়ে দুর্বলতম শিক্ষার্থীকে মনে রেখেই আমার বলা-কওয়া সাজাতাম। সে বক্তব্যের নানা দিক, মাত্রিকতা, ঘনত্ব অদল-বদল হতো নানান কিসিমের ভোক্তার জন্য কিন্তু কেন্দ্রে থাকত সেই দূরতম শিক্ষার্থীটিই, আমাকে যার সবচেয়ে প্রয়োজন ছিল।
কথাগুলো নতুন করে মনে পড়ল, যখন অর্থনীতি বিভাগের বর্তমান একাধিক শিক্ষার্থী সম্প্রতি আমাকে লিখেছে তাদের মন খারাপ করার কথা, হতাশার কথা, মুষড়ে পড়ার কথা। কেউ কেউ বলেছে, তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হচ্ছে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হওয়া। অনেকে বলেছে, সবকিছু খুব কঠিন লাগে, অনেকের মন সবসময় বিষণ্ন হয়ে থাকে। বড় কষ্ট হয়েছে এসব তরুণ বন্ধুর কথা ভেবে। এ কোন অনিশ্চয়তার জটাজুটে আটকে গেল তারা? এ কেমন বিষাদ গ্রাস করেছে তাদের? আহা। আমার প্রিয়তম বিভাগে আমারই তো উত্তরসূরি এরা।
সেই সঙ্গে তিনটি প্রাসঙ্গিক কথাও মনে হয়েছে আমার। প্রথমত, দেশের বাছাই করা সেরা মেধাবী শিক্ষার্থীরাই তো আসে অর্থনীতি বিভাগে, শিক্ষা গ্রহণ করে যোগ্যতম শিক্ষকদের কাছে। তাহলে সামলাতে পারছে না কেন তারা? আমাদের সময়ে—ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে—দেখেছি যে সবাই অর্থনীতি বিষয়টিকে সমানভাবে কব্জা করতে পারে না; বেশি-কমের তারতম্য থাকে। কিন্তু ‘একেবারে ডুবে যাচ্ছি’ এমনটি অর্থনীতিতে ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে ২৫ বছরের দীর্ঘ সময়কালে কখনো দেখিনি। দ্বিতীয়ত, নিশ্চয়ই এ ব্যাপারটির কিছু উপসর্গ শুধু অর্থনীতি বিভাগসাপেক্ষ কিন্তু এর বড় অংশ সম্ভবত সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিবেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তৃতীয়ত, আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন সাধারণ ছাত্রদের প্রতি, তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে, কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর জন্য নয়।
বৃহত্তর চালচিত্র দিয়েই শুরু করা যাক। গত এক দশকে প্রায় প্রতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক সেখানে কেমন যেন যান্ত্রিক হয়ে গেছে। শিক্ষকদের নিয়মকানুনের দিকে যতটা ঝোঁক, শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনের দিকে ততটা নয়। শিক্ষার্থীদের বিষয়ে তারা আইনের আলোচনা করেন কিন্তু আবেগের বিবেচনা করেন না। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক গতানুগতিকতায় ভরপুর কিন্তু প্রাণাবেগে শূন্য।
দ্বিতীয়ত, দুঃখের সঙ্গেই বলি, শিক্ষকরা তাদের ব্যক্তিগত কল্যাণের জন্য যতটা উদগ্রীব, ছাত্রদের ভালো-মন্দের ব্যাপারে ততটাই উদাসীন। ফলে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যকার দূরত্ব বেড়েই চলেছে। অনেকেই বলবেন, আমি শুধু শিক্ষকদের ঘাটতিই দেখে বেড়াচ্ছি, শিক্ষার্থীদের দোষ দেখছি না। সেটা ঠিক। না, আমি ছাত্রদের দোষের দিকে তাকাচ্ছি না। শিক্ষক হিসেবে আমি মনে করি, শিক্ষার্থীরা আমাদের সন্তানতুল্য। আমরা ভুল করলে তারা আমাদের ওপর রাগ করতে পারে, কিন্তু তারা অন্যায় করলে আমরা তো তাদের প্রতি মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারি না। তারা যদি আমাদের ওপর ভরসা না করতে পারে, আমাদের বিশ্বাস না করতে পারে, আমাদের কাছে না আসতে পারে, সে তো আমাদের ব্যর্থতা।
তৃতীয়ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় কেমন যেন বিভব-পক্ষপাত ও উন্নাসিকতা এসে গেছে। শুনতে পাই, চোস্ত ইংরেজিতে বিষয়বস্তু উপস্থাপন না করতে পারলে, চটপটে না হলে, নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে পারঙ্গম না হলে, সুবেশ ব্যক্তি না হলে বহু শিক্ষার্থীকেই তাচ্ছিল্যের শিকার হতে হয়েছে। এ কেমন কথা!
চতুর্থত, অর্থনীতির শিক্ষাদান যদি আকর্ষণীয় না হয়, সেখানে বিষয়ের প্রতি একটা বিরাগ জন্ম নেয়া স্বাভাবিক। সে শিক্ষাদান আমুদে হতে হবে এমন কথা নয়, কিন্তু সরস যেন হয়। তত্ত্বের কচকচানিতে অর্থনীতি বিষয়টি এমনিতেই ভারাক্রান্ত (এবং অনেক সময়েই বাস্তবতাবর্জিত), তাকে আরো নীরস করে লাভ কি? এতে যে অর্থনীতি একটি নিরানন্দ বিজ্ঞান, সেটাই প্রমাণিত হবে।
পঞ্চমত, গণিতবিদরা আমাকে ভুল বুঝবেন না, আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, গণিত আমার সারা জীবনের সহচর ছিল, তাই কোনো দুর্বলতা, ঘাটতি বা ভঙ্গুরতা থেকে বলছি না। অর্থনীতিকে গণিতময় করে অর্থনীতির শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বিভীষিকাময় পরিবেশের সৃষ্টি করেছি। অর্থনীতির জন্য গণিত একটি ভাষা মাত্র, কিন্তু গণিত অর্থনীতি নয়। ছোট্ট একটু অনুরোধ করব। দুনিয়া বদলানো দুটো অর্থনীতির ধ্রুপদ গ্রন্থ অ্যাডাম স্মিথের ‘দ্য ওয়েলথ অব নেশনস’ কিংবা কেইনসের ‘দ্য জেনারেল থিউরি’তে কতটুকু গণিতের ব্যবহার আছে, দেখবেন অনুগ্রহ করে। আমার দুই দশকের শিক্ষকতায় ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতি পড়াতে গিয়ে ন্যূনতম গণিতের ব্যবহার করেছি, তাতে শিক্ষাদানে, শিক্ষা গ্রহণে বা জ্ঞানার্জনে কোনো উনিশ-বিশ হয়েছে, কেউ কখনো বলেননি।
শেষের কথা বলি। আমাদের পাঁচ বছরের শিক্ষার্থী জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি মাত্র আত্মহননের কথা জানি। শুনেছি সেটা ছিল প্রেমঘটিত। তদানীন্তন জিন্নাহ হলের (বর্তমানের সূর্য সেন হল) আবাসিক ছাত্র হাসনাত (আশা করি, স্মৃতি আমার সঙ্গে প্রতারণা করেনি) আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন। শুনতে পাই, গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়জন তরুণ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। কেউ কেউ বলেছেন, আত্মহননের কথা বিবেচনা করেছে, সে সংখ্যা নাকি আরো অনেক বেশি। একটাই শুধু প্রশ্ন—আকাশ হতে পারত যাদের সীমানা, সম্ভাবনা হতে পারত যাদের নিয়তি, স্বপ্ন হতে পারত যাদের পাথেয়, তারা কেন ভাবছে আত্মহননই পরিত্রাণের একমাত্র উপায়? কেন?
লেখক: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
সূত্র: বণিক বার্তা