এবার আমরা আমাদের আত্মপরিচয়ের প্রথম সংগ্রাম বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ৬৮ বছর পূর্তি পালন করছি। একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় জীবনের সম্ভবত পবিত্রতম দিন, অসাম্প্রদায়িক চেতনা উদ্যাপনের একটি দিন। প্রতিবারই নতুন নতুন প্রেক্ষাপটে একুশে আমাদের জীবনে আসে। আমরা নগ্নপদে শহীদ মিনারে গিয়ে ভাষা আন্দোলনে আত্মাহুতি দেওয়া আমাদের পূর্বসূরিদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি, সব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার জন্য নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করি।শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) কালের কন্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, শহীদ মিনারের কোনো অসম্মান বা অপবিত্রতা আমরা সহ্য করি না। স্বাধীনতাবিরোধী বা সাম্প্রদায়িক জঙ্গিগোষ্ঠীর কোনো স্থান নেই শহীদ মিনারে। একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ভেঙে মসজিদ বানাতে চেয়েছিল। তার পরিণতি কী হয়েছে, তা আজ আমাদের গৌরবের ইতিহাস।
এবারের একুশে পালিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের শুভদিনের ২৪ দিন আগে। স্বাভাবিকভাবেই বঙ্গবন্ধুর কথা আমাদের বেশি করে মনে পড়ে। ভাষার লড়াই থেকে স্বাধীনতাসংগ্রাম—সবখানেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব। তিনিই বাঙালিকে আত্মপরিচয় সম্পর্কে সচেতন করেছিলেন, অধিকার আদায়ে প্রেরণা জুগিয়েছিলেন এবং সবশেষে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।
১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর সাপ্তাহিক পূর্বাণীর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘শিল্পী-সাহিত্যিকরা আর মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী ব্যক্তিবর্গের জন্য সংস্কৃতিচর্চা করবেন না। দেশের সাধারণ মানুষ, যারা আজও দুঃখী, যারা আজও নিরন্তর সংগ্রাম করে বেঁচে আছে, তাদের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখকে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির উপজীব্য করার জন্য আমি শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’ একই বছর ২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বঙ্গবন্ধু পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে বলেছিলেন, ‘বাঙালিদের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে আরো রক্তদানের জন্য ঘরে ঘরে প্রস্তুত থাকুন। বাঙালি আর শহীদ হবে না। এবার তারা গাজি হয়ে বাঁচবে। যারা বুকের রক্ত দিয়ে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে, যারা নিজের রক্ত দিয়ে আমাকে মুক্ত করে এনেছে, মধ্যরাতে এই শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে আল্লাহর নামে শপথ নিয়ে বলছি, তাদের রক্তের ঋণ আমি শোধ করবই।’
বন্ধবন্ধু তাঁর কথা রেখেছিলেন। তাঁর জীবন দিয়ে এ রক্তের ঋণ শোধ করেছেন। কিন্তু বেদনার কথা, এত রক্তের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে বেঁচে থেকেও আমরা ভাষার জন্য যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের রক্তের ঋণ শোধ করতে পারছি না। আমরা কী সর্বস্তরে বাংলা চালু করতে পেরেছি? এত কথা বলার পরও উচ্চ আদালতে কি বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করেতে পেরেছি? বাংলা ভাষা শিক্ষার দুর্বলতা দেখলে হতাশ লাগে। জীবনের সব ক্ষেত্রে বাংলা ব্যবহারে আমরা কুণ্ঠাবোধ করি। বিয়ের কার্ড এখনো আমরা ইংরেজিতে ছাপি। এটা কি নিজেদের সমাজের ওপরতলায় উন্নীত করার জন্য? প্রশ্নের পর প্রশ্ন করা যায়। উত্তরও আমাদের জানা। কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন নেই।
গণমাধ্যমে বাংলা ভাষার যে লাগাম ছাড়া ব্যবহার, তাতে শিশু-কিশোররা কী শিখবে? এফএম রেডিওতে বাংলার যে বিকৃত উচ্চারণ ও শ্রোতার রক্তচাপ বৃদ্ধিকারী বাক্ভঙ্গি, তা শুনলে প্রমিত বাংলাই একদিন আমরা ভুলে যাব। ভাষার ওপর খবরদারি চলে না। কিন্তু একটা সময় আসে, যখন ভাষার মান রক্ষার জন্য কিছু কঠোর পদক্ষেপ নিতে হয়।
আমাদের শহীদ দিবস আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আমাদের দেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট স্থাপিত হয়েছে। এর কাজ কি শুধু বিশ্বের নানা ভাষার জন্ম উৎস বা বর্ণলিপি প্রদর্শন? সেটা প্রতিষ্ঠানটির ভাষা জাদুঘর অংশের কাজ হতে পারে। আমাদের বাংলা ভাষা ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষার বিকাশে আমরা কী গবেষণা করছি? পৃথিবীতে এখন ছয় হাজারের মতো ভাষা আছে বলে ধারণা করা হয়। বলা হয়ে থাকে, প্রতি ১৪ দিনে একটি ভাষার মৃত্যু ঘটে। একটি ভাষার মৃত্যু মানে একটি সংস্কৃতির অবলুপ্তি।
পৃথিবীতে এখন দেড় হাজার ভাষা আছে যেসব ভাষার প্রতিটিতে এক হাজারেরও কম মানুষ কথা বলে। এক শজন করে মানুষ আছে সাড়ে চার শ ভাষার, আর ১৫১টি ভাষা আছে, যার প্রত্যেকটিতে দশজনের কম মানুষ কথা বলে। সুতরাং ভাষা অবলুপ্তির এই চমকপ্রদ ও আতঙ্কিত হওয়ার মতো তথ্য আমাদের জানিয়ে দেয় পৃথিবীর ভাষাবৈচিত্র্য কী দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে।
আমাদের মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে পৃথিবীর ভাষা সংরক্ষণের মতো বিশাল কাজ আমরা করতে পারব না। তবে আন্তর্জাতিক পণ্ডিতদের সহায়তায় গবেষণা করে প্রস্তাব করতে পারি বিভিন্ন দেশ কী পদক্ষেপ নিতে পারে। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মাতৃভাষা সংরক্ষণের পদক্ষেপ নেওয়া আমাদের প্রাথমিক কর্তব্য। সরকার এর মধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে; কিন্তু সে প্রচেষ্টা আরো জোরদার করা প্রয়োজন। ভাষার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষা আরো বেশি জরুরি। বাংলাদেশের এই সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আমাদের গর্ব। কোনোভাবেই আমরা এ বৈচিত্র্য হারিয়ে যেতে দিতে পারি না।
আমাদের দেশের প্রকাশনাশিল্প আবর্তিত হয় অমর একুশের বইমেলাকে কেন্দ্র করে। এ বছরও হয়তো পাঁচ হাজারের মতো নতুন বই প্রকাশিত হবে এ ফেব্রুয়ারি মাসে। কিন্তু এর মধ্য থেকে মানসম্পন্ন পাঁচ শ বই খুঁজে বের করা কষ্ট হবে। আমরা এখন সর্বত্র সংখ্যায় বিশ্বাসী, গুণগত মানে নয়। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে তাই দেখি সর্বত্রই এক শর ছড়াছড়ি। বই হোক, গান হোক, স্মারক বক্তৃতা হোক, আবৃত্তি হোক—সব কিছুতেই এক শ না হলে আমাদের মর্যাদা রক্ষা হয় না। মান কেমন হবে সেটা বিবেচ্য নয়। বই প্রসঙ্গে বলতে চাই, আমাদের প্রকাশকদের উচিত সংখ্যা নয়, মানসম্পন্ন বই প্রকাশে উদ্যোগী হওয়া। সম্পাদনা, শুদ্ধ বানান ও বাক্যগঠনের দিকে মনোযোগী হওয়া।
এবারের একুশেতে এসব বিক্ষিপ্ত চিন্তা পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নিলাম এ প্রত্যাশায়, আসুন, সবাই মিলে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে আরো বিকশিত করি, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করি। শহীদ স্মৃতি অমর হোক। চিরঞ্জীব বঙ্গবন্ধু।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব