এনটিআরসিএ: নিধিরাম সর্দার - দৈনিকশিক্ষা

এনটিআরসিএ: নিধিরাম সর্দার

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

বেসরকারি স্কুল-কলেজে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে মনে হয় গ্যাঁড়াকলে পড়েছে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ বা ‘এনটিআরসিএ’। শিক্ষক নিয়োগের কাজে শুরুতেই সংস্থাটি বেশ বড় রকমের একটা হোঁচট খেয়ে পড়ে আছে বলে প্রতীয়মান হয়। নাকি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বলে কারো একান্ত নিজের ইচ্ছাকৃত অবহেলা?

এমনিতে দেশের বেসরকারি বলে চিহ্নিত স্কুল-কলেজে হাজার হাজার সমস্যার সমাহার। তদুপরি শিক্ষক স্বল্পতার কারণে এ সব প্রতিষ্ঠান মরি মরি করে কোনমতে বেঁচে আছে। এভাবে আর কতদিন বেঁচে থাকে- কে জানে?

এখন থেকে দশ-পনের বছর আগে স্কুল-কলেজে যে পরিমাণ শিক্ষার্থী ছিল, এখন এর চার-পাঁচগুণ অধিক। কিন্তু বেসরকারি স্কুল-কলেজের জনবল কাঠামো প্রায় অনেকটা সেরকম রয়ে গেছে। সে কী করে হয়? শিক্ষার্থী কয়েকগুণ বেড়েছে, বই দশটার জায়গায় পনেরটা হয়েছে অথচ স্ট্যাফিং প্যাটার্নের কোন সংস্কার নেই-সে কেমন কথা? অবস্থা দাঁড়িয়েছে এমন-আগে দু’শ জন শিক্ষার্থীকে যতজন শিক্ষক পড়াতেন, আজ এক হাজার জন শিক্ষার্থীকে সমান সংখ্যক শিক্ষক পড়ান। আবার উল্লিখিত সংখ্যক শিক্ষককে দশটার জায়গায় পনেরটা বই পড়াতে হয়। শিক্ষার মান কী আসমান থেকে বেড়ে এসে জমিনে পড়বে?

বেসরকারি স্কুল-কলেজে শিক্ষক নিয়োগের জন্য ‘পিএসসি’র আদলে একটি কর্তৃপক্ষ গঠনের জাতীয় প্রত্যাশা বহুদিন আগ থেকেই ছিল। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এ প্রত্যাশাটি স্পষ্ট করা হয়। এর আলোকে বেসরকারি স্কুল-কলেজে শিক্ষক নিয়োগের আংশিক দায়-দায়িত্ব এনটিআরসিএ’র ওপর ন্যস্ত করা হয়। কিন্তু, এ ক্ষেত্রে ‘এনটিআরসিএ’ আজো তেমন সফলতা দেখাতে পারেনি।

এর বহু কারণ থাকতে পারে।  শুরুতে ‘এনটিআরসিএ’ কেবল শিক্ষক নিয়োগের যোগ্যতা পরিমাপের জন্য একটি পরীক্ষা নিত- যা নিবন্ধন পরীক্ষা নামে পরিচিত। এভাবে তারা এ যাবত এগারটি নিবন্ধন পরীক্ষা গ্রহণ করে। এরপর শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশের ক্ষমতা লাভের পর তারা আরো দু’টো পরীক্ষা নেয়। সর্বমোট তেরটি নিবন্ধন পরীক্ষায় সারাদেশে কয়েক লক্ষ শিক্ষিত তরুণ-তরুণী কৃতকার্য হয়ে কর্মসংস্থানের অপেক্ষায়। ত্রয়োদশ শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার একটু আলাদা বিশেষত্ব এই যে- এতে প্রিলিমিনারী, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হয়। ইতোপূর্বে কেবল লিখিত পরীক্ষাই নেয়া হতো।

ত্রয়োদশ শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় যারা কৃতকার্য হয়েছেন তারা সরাসরি নিয়োগ পেতে চান। এ জন্য সম্ভবতঃ হাইকোর্টে রীট হয়েছে। আবার যারা ১ম-১১শ নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এখনো নিয়োগ পান নাই, তারা চান আগে তাদের নিয়োগ দিয়ে পরে অন্যদের নিয়োগ দেয়া হউক। তারা ও বোধ হয় মহামান্য আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। উভয়ের কথায় অকাট্য যুক্তি আছে। এখন ‘এনটিআরসিএ’ যায় কোন পথে?

নিয়োগের ক্ষেত্রে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিষ্ঠান প্রধান, সহকারি প্রধান ও কর্মচারি বাদে কেবল সাধারণ শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ প্রদানের ক্ষমতা এনটিআরসিএ-কে দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে এনটিআরসিএ’কে পূর্ণ ক্ষমতা দেয়া হয়নি। প্রতিষ্ঠান প্রধান, সহকারি প্রধান ও কর্মচারি নিয়োগের সকল ক্ষমতা পূর্বের ন্যায় এসএমসি কিংবা জিবি’র হাতে থেকে যায়। এসব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে এনটিআরসিএর টু শব্দ করার অধিকার বা ক্ষমতা নেই। শুরুতেই এনটিআরসিএ শিক্ষক নিয়োগে পরিপূর্ণ ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হয়। ক্ষমতার ভাগাভাগির কারণে সুচনায় হোঁচট খেয়ে বসে এ সংস্থাটি। এ ছাড়া, জানিনে এর গঠন কাঠামোতে কোন পরিবর্তন সুচিত হয়েছে কীনা-নাকি এর কাঠামো আগের মত রয়েছে? পিএসসি’র আদলে এনটিআরসিএ’র কাঠামো ও ক্ষমতা পুনরায় নির্ধারণ করে দেয়া উচিত। এ দিকে এমপিওবিহীন প্রতিষ্ঠানে এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দেবার আগে উক্ত রকম প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত না করলে জটিলতা বাড়ে বৈ কমে না। এছাড়া এনটিআরসিএ চুড়ান্ত নিয়োগ দিতে পারেনা। তারা কেবল নিয়োগের জন্য সুপারিশ পাঠায়। এসএমসি কিংবা জিবির ইচ্ছে না হলে নিয়োগ না ও দিতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে হচ্ছে ও তা-ই। প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত আর্থিক সুবিধার বিষয়ে ও এনটিআরসিএর কোন নির্দেশনা বা ক্ষমতা থাকেনা। আবার এ ভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকের এমপিওভুক্তির জন্য আগের মতো সকল ঝামেলা পোহাতেই হয়।

তাই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেবল নিয়োগের জন্য সুপারিশ নয়- নিয়োগদানের সকল ক্ষমতা এনটিআরসিএকে প্রদান করে পিএসসির আদলে এটিকে স্বাধীন সংস্থা হিসেবে দাঁড় করানো উচিত।

সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এমনিতে কয়েক হাজার শিক্ষকের পদ খালি পড়ে আছে। তদুপরি এ সকল প্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো হালনাগাদ করা হলে লাখ লাখ শিক্ষিত লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্ঠি হবে। এনটিআরসিএ’কে যথাযথ ক্ষমতা দিয়ে এর কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে পারলে দেশ ও জাতির উপকার। শিক্ষিত বেকারের চাপমুক্ত হবে প্রিয় স্বদেশ।

আরেকটা বিষয়, কোন শিক্ষকের পদ যথানিয়মে শুন্য হলে তা যেন তাৎক্ষণিক এনটিআরসিএ’র ই-মেইল কিংবা ওয়েবসাইটে দেয়া যেতে পারে- সে ব্যবস্থা থাকা চাই। তাহলে পুর্ব থেকেই শুন্য পদের হিসেব কর্তৃপক্ষ জেনে সময়মত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবে। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠান ও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি যথাসময়ে জানাতে পেরে স্বস্থি বোধ করে আশ্বস্থ হবে।

যাই হোক-এনটিআরসিএকে ঢাল নেই, তলোয়ার নেই-নিধিরাম সর্দার বানিয়ে রাখা ঠিক নয়। এতে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমুহের লাভের চেয়ে ক্ষতি বরং বেশি। সারাদেশে শিক্ষক সংকট দিন দিন বেড়ে গিয়ে শিক্ষায় চরম দুর্দিন দেখা দেবে। বিশেষ করে এ কারণে বেসরকারি স্কুল-কলেজ একদিন নিজে থেকে বন্ধ হয়ে যাবে। সে আমাদের কারো কাম্য হতে পারে না।

বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে ভাগাভাগি করে লুটেপুটে খাবার মানসিকতা জিইয়ে রাখা উচিত হবে না। প্রয়োজনে এনটিআরসিএর নাম ও কাঠামো পরিবর্তন করে এটিকে স্বাধীন ও শক্তিশালী একটি কর্তৃপক্ষ হিসেবে সকল শিক্ষক সরাসরি নিয়োগের ক্ষমতা প্রদান করা একান্ত অপরিহার্য। অন্যথায়, সকল বেসরকারি স্কুল-কলেজ শিক্ষক সংকটের ধকল সইতে না পেরে একদিন মারা পড়বে।

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী: অধ্যক্ষ চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ও দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.00736403465271