নেপালের প্রথম কভিড-১৯-এ আক্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন ৩২ বছর বয়সী এক শিক্ষার্থী। চীনের উহান ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে পড়াশোনা করছিলেন তিনি। সম্পূর্ণ সুস্থ এ ব্যক্তির অন্য কোনো বড় অসুখে (কোমরবিডিটি) ভোগার তেমন কোনো ইতিহাসও নেই। শনিবার (২৮ মার্চ) বণিক বার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি প্রথম তার শরীরে নভেল করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ দেখা দেয়। এর ছয়দিন পর নিজ দেশে ফিরে যান ওই শিক্ষার্থী। কাঠমান্ডুর সুকরারাজ ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজ হসপিটালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসেন ১৩ জানুয়ারি। সে সময় তার দেহের তাপমাত্রা খুব একটা বেশি ছিল না। ৩৭ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৯৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। আর ছিল শুকনো কাশি। এছাড়া আর কোনো লক্ষণের তেমন একটা উপস্থিতি ছিল না। উহানের তথাকথিত ওয়েটমার্কেটের সঙ্গেও তার কোনো সংস্রব পাওয়া যায়নি। এর পরও সন্দেহ হওয়ায় তার গলা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে হংকংয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়। সেখানে রিয়েল টাইম আরটি-পিসিআর অ্যাসে পরীক্ষা করানোর পর ধরা পড়ে ওই শিক্ষার্থী নভেল করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত।
দ্রুত ওই শিক্ষার্থীকে আইসোলেশনে নিয়ে যাওয়া হয়। বেশকিছু অ্যান্টিবায়োটিক ও থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা শুরু হয় তার। ভর্তির ৬ ঘণ্টা পর তার মধ্যে মৃদু শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। কমে যায় অক্সিজেন গ্রহণের মাত্রা। ভর্তির সময়ে করানো বুকের রেডিওগ্রাফি চিত্রে দেখা যায়, ফুসফুসের বাম দিকের ওপরের অংশ মারাত্মকভাবে সংক্রমিত হয়েছে। পরদিন ১৪ জানুয়ারি তার দেহের তাপমাত্রা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৮ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে (১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। ১৫ জানুয়ারি একেবারে সটান শুয়ে থাকা অবস্থায়ও শ্বাস গ্রহণ কঠিন হয়ে পড়ে তার জন্য। ওইদিনই ফুসফুসের ডান দিকের নিচের অংশে ঘড়ঘড়ে ভাব চলে আসে (ক্রেপিটেশন) তার। ১৬ জানুয়ারির মধ্যে তার পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে। সে সময় তার দেহে আর জ্বরের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। ল্যাবরেটরি টেস্টে আর কোনো অস্বাভাবিক কিছু পাওয়া না যাওয়ায় পরদিনই স্বেচ্ছা ঘরবন্দিত্বের উপদেশ দিয়ে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরপর ২৯ ও ৩১ জানুয়ারি ফলোআপ পরীক্ষা চালিয়ে তার শরীরে নভেল করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া যায়নি।
নেপালের প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগীর সংক্রমণ খুব একটা মারাত্মক কিছু ছিল না। পূর্ণ পরিচর্যা ও যথোপযুক্ত চিকিৎসার পরও তাকে সুস্থ করতে সময় লেগেছে ১৩ দিন।
ওই শিক্ষার্থীর পর নেপালে এখন পর্যন্ত কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে আর মাত্র তিনজন। গতকাল পর্যন্ত দেশটিতে নভেল করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত মোট রোগী পাওয়া গেছে সাকল্যে চারজন।
বিষয়টি আশ্চর্যজনক, এতে সন্দেহ নেই। কারণ যেখানে উহানে প্রথম সংক্রমণের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নেপালে প্রথম কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে, সেখানে পরের দুই মাসে আর মাত্র দুজন শনাক্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিতভাবেই যে কারো ভুরু ওপরের দিকে তুলে দেবে।
অনেকেই দাবি করে থাকেন, নেপালিদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা অনেক বেশি। তার পরও করোনা সংক্রমণের এ তথ্য নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে খোদ দেশটির অভ্যন্তরেই। এ নিয়ে দেশটির স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অধীন এপিডেমিওলজি অ্যান্ড ডিজিজ কন্ট্রোল ডিভিশনের সাবেক পরিচালক বাবুরাম মারাসিনির বক্তব্য, কভিড-১৯-এর ঘটনা কম থাকার বিষয়ে গোটা বিশ্বই এখন নেপাল নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। এর আগেও চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া দুই মহামারী—২০০২ খ্রিষ্টাব্দের সার্স এবং এইচ১এন১ (এক ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা) সংক্রমণের সময়েও নেপালে মৃত্যুর তালিকায় লিপিবদ্ধ হয়েছিল মাত্র তিনজনের নাম। আমার ধারণা, যদি এখানে কার্যকর একটি পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালু থাকত তাহলে কভিড-১৯-এর আরও ঘটনা সামনে আসত।
মারাসিনি জানান, স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের এরই মধ্যে নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্টের সমস্যা নিয়ে নেপালি হাসপাতালগুলোয় ভর্তি রোগীদের পরীক্ষা করে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। বাবুরাম মারাসিনি বলেন, যদি গত বছরের এ ধরনের রোগীর সংখ্যার সঙ্গে এ বছরের তথ্য তুলনা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে এবার এ সংখ্যা বেড়েছে। নভেল করোনা ভাইরাস যে নেপালে বিদ্যমান, এটিই হলো তার পরোক্ষ প্রমাণ।
অন্যদিকে দেশটির সেন্টার ফর মলিকিউলার ডায়নামিকসের কর্মকর্তা সমীর দীক্ষিত জানান, তিনি এরই মধ্যে এ দুই বছরের সংখ্যা তুলনা করে দেখেছেন। এবং এপিডেমিওলজি অ্যান্ড ডিজিজ কন্ট্রোল ডিভিশনের তথ্যেও ফ্লু-জাতীয় রোগীর সংখ্যা বাড়েনি। প্রসঙ্গত, দেশটির ২০-২৫টি সরকারি, বেসরকারি ও কমিউনিটি হাসপাতাল প্রাক-সতর্কতা ও দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়ার আওতায় এপিডেমিওলজি অ্যান্ড ডিজিজ কন্ট্রোল ডিভিশনে এ ধরনের রোগীর তথ্য সরবরাহ করে থাকে।
অন্যদিকে অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা সামনে তুলে ধরে সমীর দীক্ষিত বলেন, কভিড-১৯-এ যারা আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের মধ্যে মারাত্মক পরিস্থিতিতে গেছেন মাত্র ১০-১৫ শতাংশ। এখন পর্যন্ত কমসংখ্যক পরীক্ষা করানোর বিষয়টি একটি বড় ব্যাপার হতে পারে, কিন্তু আপনারা কি মনে করেন না, যদি এটি সেভাবে ছড়িয়েই পড়ত; তাহলে বয়স্কদের মধ্যে মারাত্মক অসুস্থ রোগীর সংখ্যা ভয়াবহ হারে বেড়ে যেত? কিন্তু তা হচ্ছে না। প্রতি রাতে ঘুমানোর সময় আমিও ভেবে অবাক হই, কেন হচ্ছে না? এবং এটি আমাকে ভাবিয়েই মারছে।
ইমিউনোলজি অ্যান্ড বায়োটেকনোলজির পোস্টগ্র্যাজুয়েট সমীর দীক্ষিতের বিশ্বাস, মানুষ ভয়াবহ পর্যায়ে আক্রান্ত না হওয়ার কারণ হচ্ছে, নেপালে ভাইরাসটির স্ট্রেইন তুলনামূলক দুর্বল এবং/অথবা নেপালিদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা অনেক বেশি।
তিনি বলেন, পরীক্ষা না করানোটাও আক্রান্তের সংখ্যা না বাড়ার একটি বড় কারণ হতে পারে। আমি মনে করি, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা উন্নয়নশীল দেশগুলোয় একটি বড় ভূমিকা রাখছে। আমি জানি এটি শুনতে অদ্ভুত মনে হতে পারে, অনেকে শুনে হাসতেও পারেন, কিন্তু এ নিয়ে এক ধরনের হাইজিন হাইপোথিসিস (পরিচ্ছন্নতার তত্ত্ব) রয়েছে।
এ তত্ত্ব বলছে, যারা তুলনামূলক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বড় হয়ে থাকেন, তাদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা তুলনামূলক বেশি হয়। তবে ভাইরাসজনিত মহামারীর ক্ষেত্রে এ ধরনের তত্ত্বের সত্যতা পরীক্ষা করে দেখা হয়নি এখনো বলে জানালেন সমীর দীক্ষিত। তবে এর স্বপক্ষে আগেকার কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন তিনি।