করোনা সংক্রমণ বাংলাদেশে ক্রমেই বেড়ে চলছে—সংবাদপত্রের ভাষায় ‘ঊর্ধ্বমুখী’। এর সূচনাটি ঘটে সপ্তর্পণে, যখন বিশ্বের দেশে দেশে করোনাভাইরাস রুদ্ররূপ ধারণ করতে শুরু করেছে—কোথাও গুরুতর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চীনের প্রথম বার্তা শোনার পর থেকেই বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে এবং পর্যায়ক্রমে মারি থেকে মহামারি ও বিশ্বমারির ঘোষণা দেয় এবং করণীয় সম্পর্কে সংগত পরামর্শও দিতে থাকে এবং এখনো দিচ্ছে। বৃহস্পতিবার (২৩ এপ্রিল) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, শুরুটা যদিও চীনের উহানে এবং বছরের শুরুতে প্রত্যক্ষভাবে, এর সংগোপন সূচনা আরো কিছুদিন আগে, অনুরূপ রোগলক্ষণ দেখে তা-ই মনে হয়। চীন অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে গোটা প্রদেশটিকেই সমগ্র দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দ্রুতগতিতে অধিকতর দ্রুতগতির করোনা আক্রমণের মোকাবেলার প্রস্তুতি নেয়। সফলতা অবশ্য অনেক মৃত্যুর বিনিময়ে।
এরই মধ্যে গোটা বিশ্ব আক্রান্ত। দেশগুলো যে যার মতো করে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছে, সাফল্য সে অনুযায়ী। শতক ২০২০ যেন এক মারাত্মক অভিশাপরূপে বিশ্বে আবির্ভূত হয়েছিল, পরবর্তী দু-তিন মাসের ঘটনা তেমন প্রমাণই দেয়। এরই মধ্যে পরাক্রান্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বাধিক আক্রান্ত রাষ্ট্রে পরিণত, বিশেষ করে নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্য। মৃতের সংখ্যাও তা-ই।
ফেব্রুয়ারি-মার্চ বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভুবনে দুটি তাৎপর্যপূর্ণ মাস—অনুষ্ঠানবৈচিত্র্যে তার প্রকাশ। তদুপরি এবার মুজিববর্ষ (২০২০)। স্বভাবতই একুশের বইমেলা ও অনুষ্ঠানাদির মধ্যে করোনাবার্তা হারিয়ে যায়। এরপর স্বাধীনতার মাস মার্চ এবং এর অনুষ্ঠানাদি অনুরূপ গুরুত্বে সামনে দাঁড়িয়ে। কিন্তু এর মধ্যে করোনার প্রথম আক্রমণ (৮ মার্চ ২০২০) হঠাৎ বাজ পড়ার মতো ঘটনা। সঙ্গে সঙ্গে সতর্কতা জারি, বিচ্ছিন্নতাকরণ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম-রীতি অনুযায়ী।
সব অনুষ্ঠান, অফিস-আদালত বন্ধ ঘোষণা, ভারতীয় অতিথিদের জানান দেওয়া হলো। অবশ্য ভারতও এরই মধ্যে তাদের সতর্কতাব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। সম্ভবত ১৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা আক্রান্তের মৃত্যু। এরই মধ্যে যে বিষয়টি সতর্কতার অগোচরে থেকে গেছে তা হলো, বন্দরশহর-শিল্পশহর নারায়ণগঞ্জে ১৮ মার্চের মধ্যে পাঁচ হাজারের বেশি প্রবাসী বাঙালির করোনায় আক্রান্ত বিদেশ থেকে আগমন এবং জনারণ্যে মিশে যাওয়া।
স্বাস্থ্য বিভাগ এজাতীয় ঘটনার পরিণাম ও গুরুত্ব অনুভব করতে পারেনি। নারায়ণগঞ্জ এখন তার মাসুল গুনছে, কিন্তু গুনতে হবে অন্যদেরও। হয়তো তাই হাঁটি হাঁটি পা পা করে করোনার আক্রমণ ক্রমেই এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায়। ঢাকা বিমানবন্দরও তখন এদিক থেকে অরক্ষিতই ছিল।
দুই.
করোনা পর্বে প্রবেশ করার পর সতর্কবার্তা, করণীয় পরামর্শ সত্ত্বেও জনগণের মধ্যে সতর্কতাব্যবস্থা গ্রহণে যথেষ্ট মাত্রায় সচেতনতার অভাব লক্ষ করা গেছে। অন্যদিকে অপ্রস্তুত স্বাস্থ্য বিভাগ, চিকিৎসক ও সেবিকাদের জন্য যথেষ্ট প্রতিরোধক ব্যবস্থা (পিপিই) সরবরাহ করতে না পারায় চিকিৎসাসেবাদানে ঘাটতি দেখা গেছে, বিশেষ করে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে।
যে কারণে কয়েকটি করুণ বিয়োগান্ত ঘটনা স্পর্শকাতর চেতনার মানুষের মর্মবেদনার কারণ হয়ে ওঠে। এমনকি ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে প্রধানমন্ত্রীকেও। করোনা চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট হাসপাতাল আক্রান্ত রোগীর তুলনায় অপর্যাপ্ত ছিল না প্রথম দিকে। শুরুতে অভাব ছিল আন্তরিকতার ও মানবিক চেতনার। তাই কয়েকটি করুণ মৃত্যু।
তবে অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে, সন্দেহ নেই। চিকিৎসকরা অনেকে চেম্বার বন্ধ রেখেও টেলিফোনে রোগীর পরামর্শ ও ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছেন, ব্যক্তিগত সূত্রে এমন তথ্য জানি। জানি, বেশ কিছুসংখ্যক চিকিৎসক বিপজ্জনক পরিস্থিতি জেনেও চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন, সেবিকাদের অনেকে একই পথে। তাঁদের কেউ কেউ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। সম্প্রতি একটি বেসরকারি হাসপাতাল লকডাউন করা হয়েছে কয়েকজন ডাক্তার-নার্স আক্রান্ত হওয়ার কারণে।
শুরুতে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র করোনা কিট তৈরির প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে এসেছিল, তাদের কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক। সংবাদপত্র সূত্রে জানা গেছে, সপ্তাহখানেকের মধ্যে কাজটা সম্পন্ন হয়ে যেতে পারে—সে ক্ষেত্রে সেটা হবে করোনাযুদ্ধের ক্ষেত্রে বড় ধরনের একটি সাফল্য।
ভিন্ন ধারার আরেকটি বড় ধাপ অগ্রগতির সম্ভাবনা বসুন্ধরা গ্রুপের বিশেষ ধরনের করোনা হাসপাতাল তৈরির প্রস্তাব।
এ প্রস্তাবমাফিক সরকারের অনুমোদনক্রমে ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরাকে (আইসিসিবি) আপাতত দুই হাজার শয্যার আইসোলেশন কক্ষবিশিষ্ট হাসপাতালে রূপান্তর করার কার্যক্রম দ্রুতগতিতে চলছে, যা ব্যবহৃত হবে শুধু করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারণা, এপ্রিল মাসের মধ্যেই হাসপাতাল নির্মাণের কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হওয়ার কথা। বেসরকারি খাতে করোনা চিকিৎসা ও প্রতিরোধে এটা হবে একটি বড় অবদান।
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারায় যে বিশেষ অতিধনী একটি শ্রেণির জন্ম হয়েছে তাদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের মতো জাতীয় সংকটের বিভিন্ন ধারায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখার অর্থনৈতিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি বা গ্রুপের সংখ্যা খুব একটা কম নয়। তারা নিজ নিজ ধারায় সংকটের মোকাবেলায় এগিয়ে আসতে পারে।
কিন্তু সমাজ-হিতৈষণার ক্ষেত্রে এ ধরনের কর্মপ্রেরণার অভাব আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য। ইউরোপীয় উন্নত রাষ্ট্রগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, যেকোনো ধরনের জাতীয় সংকটে—হোক তা যুদ্ধ বা মহামারি বা প্লাবন বা অনুরূপ ব্যাপক প্রাকৃতিক অঘটনে রাজনৈতিক দল-মত বা ব্যক্তিক ধারণা নির্বিশেষে সব বিরোধ ভুলে তারা জাতীয় স্বার্থে একাত্ম হয়ে থাকে সংকটের মোকাবেলায়। এটাই স্বাভাবিক ঘটনা।
কিন্তু বাংলাদেশের সমাজ সেসব ধ্যান-ধারণা নিয়ে কমই মাথা ঘামায়। তারা শুধু নিজ স্বার্থ কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নিতে জানে। তবু কিছু ব্যতিক্রম তো থাকে এবং থাকবেই। তাই দু-একটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ তুলে ধরা হলো। সেই সঙ্গে প্রত্যাশা নিয়ে যে করোনা এরই মধ্যে আমাদের সমাজে শুধু চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রেই নয়, আনুষঙ্গিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে বিপর্যয়ের আশঙ্কা সৃষ্টি করে চলেছে, তা ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা আমাদের জানা নেই। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক টাইকুনদের জাতীয় সংকটের সমাধানে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে এগিয়ে আসতে হবে। আপাতত করোনা সংকট নিয়ে আমাদের এই প্রত্যাশা। প্রাকৃতিক, সামাজিক, মারিতাত্ত্বিক যেকোনো প্রকার সংকটে, অঘটনে দুস্থ মানুষ ত্রাণের জন্য, সাময়িক অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কেবল সরকারি ত্রাণের ওপর নির্ভর করবে—এটা একমাত্র যুক্তিসংগত কথা হতে পারে না। সমাজের অতিধনিক শ্রেণির সে ক্ষেত্রে সহায়তাদানের সামাজিক দায়বদ্ধতা রয়েছে।
করোনা সংকট উপলক্ষে আরো দু-একটি দাতব্য হাসপাতাল যেমন স্থাপন করা যায়, তেমনি স্থাপন করা যায় রোগ ও মারিতাত্ত্বিক গবেষণাকেন্দ্র, যেগুলো পরোক্ষে যেকোনো মহামারি নিরোধক বা প্রতিরোধক ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থাপনায় গবেষণাকেন্দ্রের বড় অভাব।
একসময় কলেরা ছিল বাংলাদেশের শ্রেণিবিশেষের জন্য নিত্য মহামারি, মূলত বিশুদ্ধ সুপেয় পানীয় জলের অভাবে, স্বাস্থ্যকর পরিবেশের অভাবে। অনেক মৃত্যু ঘটেছে তাতে। পাকিস্তান আমলে মার্কিন দাতব্যে পাক সিয়াটো কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল গবেষণা ও চিকিৎসা—এই উভয়বিধ চিন্তা নিয়ে। তবে এর পেছনে মার্কিনদের রাজনৈতিক কূটস্বার্থও লুকানো ছিল। সেটা এখন ভিন্ন প্রসঙ্গ।
বাংলাদেশে এজাতীয় ধারায় একাধিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হতে পারে সরকার ও ধনাঢ্যদের যৌথ উদ্যোগে। সে ক্ষেত্রে দেশে মেধার খুব অভাব আছে বলে মনে হয় না। প্রয়োজনে বিদেশি মেধাও আনা যেতে পারে।
করোনা প্রসঙ্গে জাতীয় প্রয়োজনে কিছু আনুষঙ্গিক ভিন্ন ধারার কথা বলা হলো, যা অহেতুক কথা নয়। এতে রয়েছে জাতীয় ও সামাজিক স্বার্থের দায়মোচনের প্রয়োজনীয়তা। আশা করব, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ কথাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখবেন। কারণ কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সর্বদা পরনির্ভরশীল হয়ে থাকবে, জাতির জন্য বা রাষ্ট্রের জন্য তা গৌরবজনক নয়।
বাহাত্তরের ধ্বংসস্তূপে কয়েকজন মানবপ্রেমী চিকিৎসকের চেষ্টায় যদি জনসেবার উদ্দেশ্যে গণস্বাস্থ্যবিষয়ক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায়, তাহলে প্রায় অর্ধশতাব্দী পর বর্তমান উন্নত অবস্থায় জনস্বাস্থ্যের প্রয়োজনে বেসরকারি খাতে ব্যক্তিগত বা সম্মিলিত চেষ্টায় একাধিক দাতব্য চিকিৎসালয় ও রোগ গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা যাবে না কেন? বিষয়টি একান্তই সদিচ্ছার।
লেখক : আহমদ রফিক, কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী।