শারীরিক শিক্ষা মানব জীবনে শিক্ষার একটি অপরিহার্য অংশ। আগেকার দিনে কেবল শরীর সম্বন্ধীয় শিক্ষাকে শারীরিক শিক্ষা মনে করা হতো। বর্তমান সময়ে এ ধারণাটি পরিবর্তিত হয়েছে। শারীরিক শিক্ষা কেবল দৈহিক নয়, মানুষের মানসিক বিকাশ ও সামাজিক গুণাবলি অর্জনের উপায় নিয়ে আলোকপাত করে। আমরা জানি, দেহ ও মনের সম্পর্ক একান্ত ঘনিষ্ট। A sound mind lives in a sound body (সুস্থ দেহে সুন্দর মন)-এই প্রাচীন প্রবাদটি যুগ যুগান্তর থেকে সত্য বলে প্রমাণিত হয়ে আসছে। আজকাল শারীরিক শিক্ষা বলতে শারীরিক উন্নয়ন, মানসিক বিকাশ ও সামাজিক গুণাবলি অর্জনকে বুঝায়। আমাদের দেশেও 'সুস্থ দেহে সুন্দর মন' এই জীবনদর্শনকে সামনে রেখে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ইতোমধ্যে শারীরিক শিক্ষা বিষয়টি পাঠ্যসুচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
কয়েক বছর থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে 'শারীরিক শিক্ষা' বিষয় পাঠ্যসুচির অন্তর্ভুক্ত করা হলেও উচ্চ মাধ্যমিক তথা কলেজ পর্যায়ে বিষয়টি আজও অন্তর্ভুক্ত হয়নি। মজার বিষয় এই যে, বিদ্যমান জনবল কাঠামো অনুসারে প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি কলেজে একটি করে শরীরচর্চা শিক্ষকের পদ রয়েছে। বহু কলেজে 'শরীরচর্চা শিক্ষক' হিসেবে একজন করে শিক্ষক কর্মরত থাকলেও তাদের পড়ানোর জন্য শারীরিক শিক্ষা বা এ জাতীয় কোনো বিষয় কিংবা পাঠ্যবই নেই। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, বর্তমানে দেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলে প্রায় চার হাজার কলেজে একজন করে শরীরচর্চা শিক্ষক কর্মরত আছেন। তাদের পড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় কিংবা বই নেই। এটি আমার বোধগম্য নয় যে, প্রায় কলেজে একজন করে শরীরচর্চা শিক্ষক কর্মরত থাকলেও শারীরিক শিক্ষা নামের কোনো পাঠ্যবই নেই কেনো ?
কলেজ পর্যায়ে বিষয় ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয় বলে জানি। অর্থাৎ কলেজে যে সকল বিষয় পঠিত হয়, সে সকল বিষয়ের বিপরীতে শিক্ষক নেয়া হয়। কিন্তু, কোনো বিষয় ছাড়াই কলেজে শরীরচর্চা শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি কিছুতেই বোধগম্য নয়। কেবল খেলাধুলার জন্য কী শরীরচর্চা শিক্ষক অপরিহার্য ? শিক্ষার্থীদের কেবল শারীরিক বিকাশ কাম্য নয়। শারীরিক বিকাশের সাথে মানসিক বিকাশও অপরিহার্য একটি বিষয়। এই উভয় রকমের বিকাশ সাধনের জন্য শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার পাশাপাশি শারীরিক শিক্ষা গ্রহণও একান্ত প্রয়োজন। কলেজ পর্যায়ে শারীরিক শিক্ষা বিষয় চালু না করে কেবল শিক্ষক নিয়োগ দেবার ক্ষেত্রে সেই বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হয়নি।
শারীরিক শিক্ষা ব্যতিরেকে শিক্ষা কোনদিন পূর্ণতা অর্জন করতে পারে না। শিক্ষা শুধুমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ নয়। এর মাধ্যমে ব্যক্তির শারীরিক, সামাজিক, আবেগিক ও অন্যান্য দিকেরও সুষম বিকাশ ঘটে থাকে। শিক্ষা কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে অর্জিত হয় না। এটি একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। একজন শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্ব গঠনে শারীরিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় দৈহিক ও মানসিক বিকাশের উপর সমান গুরুত্ব আরোপ করা হয়ে থাকে। এই উভয় রকমের বিকাশ সাধনে শারীরিক শিক্ষার অন্য কোনো বিকল্প নেই। তাই শিক্ষার প্রতিটি স্তরে শারীরিক শিক্ষা বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরের পর এখন উচ্চ মাধ্যমিক তথা কলেজ পর্যায়ে শারীরিক শিক্ষা বিষয়টি চালু করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। পরবর্তিতে তা শিক্ষার উচ্চস্তর পর্যন্ত প্রসারিত করা উচিত।
শারীরিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বলে শেষ করার মতো নয়। শিক্ষার্থীর সার্বিক বিকাশের জন্য কলেজ পর্যায়ে শারীরিক শিক্ষা চালু করা এখন সময়ের দাবি। শারীরিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে গিয়ে মনীষি সি.এ বুচার বলেছেন, " শারীরিক শিক্ষা, শিক্ষার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শারীরিক শিক্ষা হলো সুনির্দিষ্ট শারীরিক কাজকর্মের মাধ্যমে শারীরিক, মানসিক, আবেগিক এবং সামাজিক দিক দিয়ে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা।" অন্য আরেকজন মনীষি জে.বি ন্যাশ বলেছেন, " শারীরিক শিক্ষা গোটা শিক্ষার এমন একটি দিক যা মাংসপেশির সঠিক সঞ্চালন ও এর প্রতিক্রিয়ার ফল হিসেবে ব্যক্তির দেহের ও স্বভাবের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধন করে।" সামগ্রিক বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, শারীরিক শিক্ষার মুল কথা হলো দেহ ও মনের সার্বিক উন্নতির লক্ষ্যে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সুষম উন্নয়ন, মানসিক বিকাশ সাধন, সামাজিক গুণাবলি অর্জন ও খেলাধুলার মাধ্যমে চিত্তবিনোদন। এক কথায়, আজকের শিক্ষার্থীদের আগামী দিনের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য শারীরিক শিক্ষা একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই, কলেজ পর্যায়ে শারীরিক শিক্ষা বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়া একান্ত দরকার।
কলেজ পর্যায়ে শারীরিক শিক্ষা বিষয়টি পাঠ্যসুচির অন্তর্ভুক্ত করা হলে নতুন করে শিক্ষক নিয়োগ দেবার প্রয়োজন হবে না। কেননা, প্রায় সব কলেজে শরীরচর্চা শিক্ষক নামে একজন করে শিক্ষক কর্মরত আছেন। অবশ্য, এসব শিক্ষকদের ছোট্ট একটি দাবি আছে। দাবিটি যে কারো কাছে যৌক্তিক বলে প্রতীয়মান হবে। তাদের দাবি এই, শরীরচর্চা শিক্ষকের পদটিকে প্রভাষক পদ হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। যেহেতু, কলেজ পর্যায়ে শিক্ষকদের প্রান্তিক বা প্রারম্ভিক পদ 'প্রভাষক' সেহেতু কলেজ পর্যায়ে শারীরিক শিক্ষা বিষয়টি চালু করে শরীরচর্চা শিক্ষকদের প্রভাষক হিসেবে অভিহিত করাই সমীচিন। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান কাম্য শিক্ষাগত যোগ্যতা কম হলে তা পরবর্তি উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতায় নির্ধারণ করা যেতে পারে। বর্তমানে কর্মরত প্রায় ৯০ শতাংশ শরীরচর্চা শিক্ষকের বিপিএড ডিগ্রি ছাড়াও 'প্রভাষক' পদের কাম্য শিক্ষাগত যোগ্যতা বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে। এ ছাড়া অনেকে ইতোমধ্যে টাইমস্কেল পেয়ে প্রভাষকদের প্রারম্ভিক স্কেলে উন্নীত হয়েছেন। কলেজ পর্যায়ে সব শিক্ষকের প্রারম্ভিক পদ 'প্রভাষক' হলেও শরীরচর্চা শিক্ষকগণ এ ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার। এ কারণে তারা প্রাপ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। বেতন-ভাতা যাই হউক না কেন, মর্যাদার দিক থেকে তারা এক ধাপ নীচে অবস্থান করছেন। ফলে মানসিক হীনমন্যতার মধ্যে তাদের দিনাতিপাত করতে হয়।
সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি কলেজ মিলে কয়েক হাজার শরীরচর্চা শিক্ষক একান্ত মনের কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। তারা ক্লাসে যেতে চান। ক্লাস করাতে চান। ক্লাস ও পাঠ্যবই না থাকায় তাদের বেশিরভাগ অলস সময় কাটাতে হয়। পৃথিবীর বহুদেশ বিশেষ করে ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, জাপান, আমেরিকাসহ আরো বহু দেশে কলেজ পর্যায়ে শারীরিক শিক্ষা বিষয়টি পাঠ্যসুচির অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
আধূনিক শিক্ষা চালু করে আগামীর উপযুক্ত নাগরিক তৈরি করার লক্ষ্যে কলেজ পর্যায়ে শারীরিক শিক্ষা বিষয়টি পাঠ্যসুচির অন্তর্ভুক্ত করে সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি কলেজে কয়েক হাজার কর্মরত শরীরচর্চা শিক্ষকের ন্যায্য ও মানবিক দাবিটি পূরণ করার জন্য বর্তমান শিক্ষা ও ক্রীড়া বান্ধব সরকারের ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে জোর দাবি জানাই। আশা করি, ঐতিহাসিক মুজিববর্ষকে স্মরণীয় করে রাখতে কলেজের শরীরচর্চা শিক্ষকদের মৌলিক দাবিটি এ বছরেই পূরণ করার উদ্যোগ নেয়া হবে।
লেখক : মুজম্মিল আলী, অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার সংবাদ বিশ্লেষক।