কিন্ডারগার্টেন স্কুল হলো শিশুদের প্রাক-বিদ্যালয় বা বিদ্যালয়-পূর্ব উপযোগী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আমাদের দেশে যা সংক্ষেপে কেজি স্কুল নামে পরিচিত। কিন্ডারগার্টেন শব্দটি জার্মানি শব্দ; যার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে শিশুদের বাগান। এ শব্দটি বিখ্যাত জার্মান শিশু-শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব ফ্রেডরিখ ফ্রোয়েবল সৃষ্টি করেন। তিনি আজ থেকে প্রায় ১৮২ বছর আগে ১৮৩৭ সালে ব্যাড ব্ল্যাংকেনবার্গে শিশুদের তাদের বাড়ি থেকে বিদ্যালয় পর্যন্ত গমন এবং খেলা ও প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণের ধারণাকে কেন্দ্র করে এ শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। রোববার (১ ডিসেম্বর) দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন ইসমাইল মাহমুদ।
ফ্রেডরিখ ফ্রোয়েবলের উদ্দেশ্য ছিল শিশুরা উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে প্রতিপালিত হবে এবং ‘শিশুদের বাগান’ হিসেবে কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোতে বাগানে রোপণকৃত চারাগাছের মতো পরিচর্যা পাবে। এছাড়া শিশুরা কিন্ডারগার্টেনে উপস্থিত হয়ে পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষা করাসহ একত্রে খেলাধুলা করবে এবং অন্যের সঙ্গে অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্যে শিক্ষা উপযোগী নানাবিধ কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করবে। কিন্ডারগার্টেনের শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করানোর সময় শিক্ষকবৃন্দ শিশুদের মনন উপযোগী বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা উপকরণ সঙ্গে রাখবেন। শিক্ষক উপকরণগুলোর বাস্তবমুখী কলা-কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে শিশুর মনোযোগ আকর্ষণ করবেন। উপযুক্ত ভাষা ও শব্দভাণ্ডার প্রয়োগের মাধ্যমে পড়বেন কিংবা শিক্ষার্থীকে পড়াতে উদ্বুদ্ধ করবেন। গণিত, বিজ্ঞানসহ সঙ্গীত, কলা, সামাজিক আচার-আচরণ শেখানোও শিক্ষকের প্রধান দায়িত্ব। খেলাধুলা এবং পার¯পরিক ক্রিয়া বা যোগাযোগের মাধ্যমে নিয়মিতভাবে সমজাতীয় শিশুদের মিলনক্ষেত্র হিসেবে এটি সুন্দর সুযোগ তৈরি করে।[insdie-ad]
প্রাক-বিদ্যালয় হিসেবে কিন্ডারগার্টেনে কোমলমতি শিক্ষার্থীর বয়সসীমা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ৩ থেকে ৫ বছরের হয়ে থাকে। তাদের মনের মাঝে সব সময় পারিবারিক পরিবেশ বিরাজমান থাকে। অনুকূল পরিবেশই তাদের শিক্ষাজীবনের মূল ভিত্তি। দেশের প্রায় প্রতিটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পারিবারিক পরিবেশে শিশুকে আনন্দময় পরিবেশে সুচারুরূপে পাঠদান করা হয়। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে বিদ্যালয়-পূর্ব শিক্ষা পদ্ধতিতে কিন্ডারগার্টেনকে শিশুর শৈশবকালীন শিক্ষার অংশ হিসেবে নেয়া হয়েছে। ১৮১৬ সালে স্কটল্যান্ডে রবার্ট ওয়েন নামীয় একজন দার্শনিক ও শিশু শিক্ষাবিদ নিউ ল্যানার্কে ‘ইনফ্যান্ট স্কুল’ বা শিশু বিদ্যালয় চালু করেন। এ ধরনের আরেকটি বিদ্যালয় ১৮১৯ সালে লন্ডনে প্রতিষ্ঠা করেন স্যামুয়েল ওয়াইল্ডারস্পিন। কাউন্টেস থেরেসা ব্রুন্সভিক ১৮২৮ সালে বুদাপেস্টে তার নিজ বাড়িতে ‘এঙ্গিয়েলকার্ট’ বা পরীদের বাগান নামের কিন্ডারগার্টেন প্রতিষ্ঠা করেন। তার এ ধারণাটি তৎকালীন হাঙ্গেরীয়ান রাজতন্ত্রের মধ্যবিত্ত সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
আমাদের দেশে প্রথম কবে কিন্ডারগার্টের স্কুলের যাত্রা শুরু হয় তার ইতিহাস জানা যায়নি। তবে সেই পাকিস্তান আমল থেকে এদেশে কিন্ডারগার্টের স্কুল চালু আছে। বর্তমান প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দেশে বর্তমানে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সংখ্যা প্রায় ৬৫ হাজারের অধিক। কিন্ডারগার্টেন স্কুল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন ঐক্য পরিষদের তথ্যমতেও সংখ্যাটি এমনই। তবে ২০১৮ সালে সর্বশেষ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর যে শুমারি করেছিল সে অনুযায়ী সারাদেশে কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা ২৪ হাজারের কিছু বেশি। এসব কিন্ডারগার্টেন স্কুল পরিচালনার জন্য নিবন্ধনের বিধান থাকলেও কঠিন নিয়মের বেড়াজালে নিবন্ধন ছাড়াই সারা দেশে চলছে অধিকাংশ কিন্ডারগার্টেন স্কুলের কার্যক্রম। এছাড়া প্রতিনিয়ত ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে এসব স্কুলগুলো।
১৯৬২ সালের রেজিস্ট্রেশন অব প্রাইভেট স্কুল অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী ২০১১ সালে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিবন্ধন বিধিমালা প্রণীত হয়। এ বিধিমালা প্রণয়নের ৮ বছর ইতোমধ্যে পেরিয়ে গেছে। কিন্তু আইন ও বিধিমালার কঠিন বেড়াজালে নিবন্ধনের আওতায় আসেনি কিন্ডারগার্টেনগুলো। ২০১১ সালের বিধিমালায় নিজস্ব মালিকানা বা ভাড়ায় স্কুলের জন্য নেয়া জমির পরিমাণ এলাকাভেদে ৮, ১২ ও ৩০ শতাংশ নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছিল। সংশোধিত বিধিতে বলা হয়, এর চেয়ে কম জমিতে হলেও বিদ্যালয়গুলো নিবন্ধন পাবে। বিধিমালা অনুযায়ী নিবন্ধনের ধাপ তিনটি।
প্রথম ধাপে প্রাথমিক অনুমতির জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বিভাগীয় উপ-পরিচালকের কাছে আবেদন করতে হয়। উপ-পরিচালক নিজে স্কুলটি ঘুরে দেখে এবং আবেদনের সঙ্গে জমা দেয়া কাগজপত্র পরীক্ষা করে অধিদপ্তরে তার মতামত পাঠান। এরপর অধিদপ্তর এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত মূল্যায়ন কমিটি ওই আবেদন যাচাই-বাছাই করে প্রাথমিক অনুমোদনের সুপারিশ করে। প্রাথমিক অনুমোদন পাওয়ার এক বছরের মধ্যে অস্থায়ী নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে হবে আর অস্থায়ী নিবন্ধন পাওয়ার তিন বছরের মধ্যে চূড়ান্ত নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে হয়। পাঁচ বছর পর নিবন্ধন নবায়ন করতে হয়। একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্কুল নিবন্ধন করতে হয়।
অভিজ্ঞমহলের অভিমত, এসব অনিবন্ধিত স্কুলের পাঠ্যক্রম স¤পর্কে ওয়াকিবহাল না থাকায় তাদের ইচ্ছামতো পাঠ্যপুস্তক নির্বাচন করেন তারা। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে বাধা সৃষ্টি হয়। এসব স্কুলের পাঠ্যক্রম তদারকির জন্য আলাদা মনিটরিং বোর্ড গঠন করা দরকার। এদিকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৬৩ হাজার ৬০১টি। এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহণ করছে ২ কোটি ১৯ লাখ ৩২ হাজার শিক্ষার্থী। আর ৬০ হাজার ৬০১টি বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকের সংখ্যা ৩ লাখ ২২ হাজার ৭৬৬ জন।
কিন্ডারগার্টেন স্কুল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন ঐক্য পরিষদের তথ্যমতে, দেশে অর্ধ লক্ষাধিক কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষাগ্রহণ করছে আনুমানিক দেড় কোটি শিক্ষার্থী। এসব কিন্ডারগার্টেন স্কুল গড়ে না উঠলে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর ললাটে দুর্ভোগ অবধারিত ছিল। কারণ হিসেবে তারা জানান, কিন্ডারগার্টেন স্কুল না থাকলে এসব শিক্ষার্থী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখার জন্য গমন করতো। এতে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়গুলোতে অধিক চাপ সৃষ্টি হতো। আর এতে মানসম্মত শিক্ষা হতো সুদূরপরাহত। দেশের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় (পিইসি) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো ভালো ফলাফল করছে বলে তারা জানান। অভিজ্ঞমহলের অভিমত, কিন্ডারগার্টেন স্কুল পরিচালনার জন্য নিবন্ধন প্রক্রিয়া আরও সহজসাধ্য এবং প্রচলিত আইন ও বিধিমালা সংশোধন করে একটানা তিন বছর যেসব কিন্ডারগার্টেন স্কুল সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়েছে সেগুলোকে দ্রুত নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসা আবশ্যক।